Advertisement
০৪ মে ২০২৪
মেহতাবদের চোখ এ বার আই লিগ

২১২০ দিন ধরে কলকাতা লিগ লাল-হলুদ

কোচ ট্রেভর জেমস মর্গ্যান ছিলেন না। যিনি ছিলেন লাল-হলুদের সেই স্টপগ্যাপ কোচ রিচার্ড ড্রাইডেন ম্যাচ শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রওনা দিলেন বিমানবন্দরের দিকে। পৌনে আটটার সময় তাঁর বাড়ি ফেরার ফ্লাইট!

ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

ইস্টবেঙ্গল-১ (ডং-পেনাল্টি)

মহমেডান-০

কোচ ট্রেভর জেমস মর্গ্যান ছিলেন না। যিনি ছিলেন লাল-হলুদের সেই স্টপগ্যাপ কোচ রিচার্ড ড্রাইডেন ম্যাচ শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রওনা দিলেন বিমানবন্দরের দিকে। পৌনে আটটার সময় তাঁর বাড়ি ফেরার ফ্লাইট!

মর্গ্যান অবশ্য ম্যাচের পরেই অস্ট্রেলিয়ার বাড়ি থেকে বলে দিয়েছেন, ‘‘জানতাম ওরা পারবে। লিগ জয় নিয়ে আমার কোনও টেনশন ছিল না।’’ টেনশনহীন লিগই কি তা হলে লিগ জয়ের সেই সেলিব্রেশন কেড়ে নিল?

মর্গ্যানদের মতো ‘পেশাদার’দের কাছে ইস্টবেঙ্গল কোচ হওয়াটা একটা চাকরি। কিন্তু বঙ্গজীবনের অঙ্গ কলকাতা লিগ যাঁদের কাঁদায়-হাসায়, আবেগে ভাসায়, তাঁরা কোথায় গেলেন? ম্যাচের আগে যাঁরা ‘ইস্টবেঙ্গল সাতে সাত/বাকি সব কুপোকাত’ বা ‘ডং আমাগো আগুনে গোলা/গোল করব কোরিয়ান পোলা’— লেখা ফেস্টুন টাঙিয়ে রেখেছিলেন, ম্যাচ শেষ হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে তাঁরাও যে চলে গেলেন স্টেডিয়াম ফাঁকা করে!

অতীতে এই সব লিগ জয়ের দিনে ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম গমগম করত খেলা শেষে। এ দিন অবিনাশ রুইদাসরা ম্যাচ শেষে সামান্য মিষ্টিমুখ করেই যে বাসে উঠে পড়লেন!

পুজোর আগে ইস্টবেঙ্গলের লিগ জয় মানেই তো এত দিন ময়দান দেখে এসেছে ইলিশ হাতে লাল-হলুদ রং মাখা সমর্থক, তাসা পার্টি, হাতে হাতে খবরের কাগজ মুড়িয়ে মশাল জ্বালানো, মাঠে ঢুকে স্বপ্নের তারকাকে একটু ছুঁয়ে দেখার আকুতি—আরও কত সব বিচিত্র সেলিব্রেশন। ঐতিহাসিক হেপ্টা লিগ জয়ের দিনে ওঁরা গেলেন কোথায়? আইএফএ সরকারি ভাবে ঘোষণা না করলেও এ দিন জয়ের পর নয় ম্যাচে ২৭ পয়েন্ট হল লাল-হলুদের। যা বাকি টিমগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে। (মোহনবাগানের না খেলা ডার্বির তিন পয়েন্ট ধরে) কেউ বলছেন দেশে টানা সাত বার লিগ জয়ের এই নজির নেই। কেউ বলছেন বিদেশ খুঁজেও এই নজির পাওয়া যাবে না। হেপ্টার ইতিহাস ছাড়া বৃহস্পতিবারের এই ম্যাচ থেকে প্রাপ্তির কিছুই ছিল না। কিন্তু মনে থাকবে লাল-হলুদের ৩৮তম তম কলকাতা লিগ জয়ের দিনে মুঠো মুঠো আনন্দের মুহূর্তগুলো ডোডো পাখির মতো উবে যাওয়ার কথা।

ইতিহাস গড়ে ডং-মেহতাব।

এর কারণটা কী? লিগ জয়ের সেলিব্রেশন ময়দান থেকে সরে কল্যাণী চলে যাওয়া? সদ্য হাঁটু অপারেশন করানো ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য যা মেনে নিয়ে ফোনে বলছিলেন, ‘‘ম্যাচ জেলা শহরে সরেছে। জার্নিটা ফ্যাক্টর। তেমনই কল্যাণীতে দর্শক তো মোটে হাজার আটেক। তাই হয়তো ওরা টিভিকেই বেছে নিয়েছে।’’ সোনাঝরা সত্তর দশকে লাল-হলুদে হেক্সার রেকর্ড যাঁরা গড়েছিলেন তাঁদের অন্যতম শ্যাম থাপা আবার বলে বসলেন, ‘‘রান্নায় যেমন নুন না দিলে স্বাদ হয় না, সে রকম মোহনবাগানকে হারিয়ে এই রেকর্ড না হওয়ায় সমর্থকরা হয়তো প্রাণ খুলে আনন্দ করল না।’’

যা শুনে ডু ডংয়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আই লিগে তো মোহনবাগানকে পাব। তখন দেখা যাবে। এখন ইতিহাস গড়ার সেলিব্রেশন।’’ বলেই মেহতাবের সঙ্গে হাতের সাত আঙুল দেখিয়ে ভিকট্রি পোজ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এ দিন দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গলের পেনাল্টি পাওয়া নিয়ে মহামেডান শিবির ম্যাচের পর ক্ষোভে ফুটছিল। মহমেডান কোচ মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায় ময়দানের পোড় খাওয়া কোচেদের অন্যতম। এ দিন তিনি বুদ্ধি করে ৪-৩-৩ ছকে নামা ইস্টবেঙ্গল রক্ষণকে বোকা বানাতে তাঁর দুই উইং অতীন্দর ও দীপেন্দুকে স্কোরিং জোনে বক্স কাট করাচ্ছিলেন। আর যে দিকের উইং সেটা করছিল সে দিকের স্ট্রাইকার উইংয়ে সরে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের অর্ণব বা ক্যালামকে টেনে আনছিলেন। লাল-হলুদের সেই ফাঁক কাজে লাগিয়েই মহমেডান প্রথমার্ধে তাই ঝলমলে। দ্বিতীয়ার্ধে প্রণীতের কভারিংয়ের ভুলে ডংয়ের থেকে বল পেয়ে ডিকা বক্সে ঢুকে পড়তেই পেনাল্টি। তবে মৃদুলের প্রশংসা করতেই হবে। এক ঝাঁক আনকোরা ফুটবলার নিয়ে তিনি যে লড়াই এ দিন মেহতাবদের দিকে ছুড়ে দিলেন তা দেখার মতো।

হেপ্টা লিগ ঘরে তুলে মেহতাবরা যখন ড্রেসিংরুমে আনন্দে মেতেছেন তখন সল্টলেকের বাড়িতে ধরা গেল সত্তর দশকে লাল-হলুদের হেক্সা লিগ জয়ের কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাড়িতে বসে এ দিন পুরো খেলা দেখেছেন। নতুন রেকর্ড গড়ার দিনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘রেকর্ড তো গড়া হয় ভাঙার জন্যই। তবে হেক্সার সময় আমার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছিল। হেপ্টার যুগে সে রকম কিছু হয়নি সেটাই রক্ষে।’’ একটু থেমে হেক্সার কোচ পিকে চলে গেলেন তাঁর বিখ্যাত ভোকাল টনিকে। ‘‘আজ ড্রেসিংরুমে থাকলে মেহতাবদের এখন বলতাম, তোমরা কিন্তু সাত বার কলকাতা লিগ জিতে ক্লাবের মাথা কিনে নাওনি। দশ বছরেরও বেশি সময় ক্লাবে আই লিগ আসে না। আত্মসম্মানের রং ওই লাল-হলুদ জার্সিটা। আর তোমাদের কিনা টিপ্পনি শুনতে হবে—তোমরা ভারত নও কলকাতা শ্রেষ্ঠ! শুক্রবার থেকেই আই লিগ আনার প্রস্তুতি শুরু করে দাও।’’

ইস্টবেঙ্গলের ‘সাতে সাত মেহতাব’ও সেটা মেনে নিচ্ছেন। বাড়ি যাওয়ার আগে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সত্যিই এ বার আই লিগ নিয়ে ভাবতে বসব। এ বছর ওটা জিততেই হবে।’’

হেপ্টা লিগ জয়ের পর আধ ঘণ্টার মধ্যে তাই সেলিব্রেশন উধাও। বদলে কল্যাণী থেকেই ‘মিশন আই লিগ’-এর সলতে পাকানো শুরু মেহতাবদের।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পড়শি ক্লাবও দু’বছর আগে যে ট্রফি জিতেছে। লাল-হলুদে তা নেই এক যুগেরও বেশি সময়!

ইস্টবেঙ্গল: দিব্যেন্দু, সামাদ (কৌশিক), অর্ণব, ক্যালাম, নারায়ণ, রফিক(বিকাশ), মেহতাব, রাহুল, লালরিন্দিকা, ডং(অবিনাশ), জিতেন।

মহমেডান: জেমস, নীতেশ, তুরে, রানা, প্রণীত, অতীন্দর (সাজির), মমতাজ, দীপঙ্কর, দীপেন্দু দোয়ারি, মনবীর, ডোডোজ।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eastbengal CFL'16 Champion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE