Advertisement
০৬ মে ২০২৪

উপেক্ষার যন্ত্রণা নিয়ে বাংলা ছেড়ে কেরলে পলি

সিঙ্গুরের বুড়াশান্তির মাঠে বাড়ি পলির। মাস দু’য়েক আগে প্রয়াত বাবার রোজগার বলতে ছিল একশো দিনের কাজ। মা অন্যের বাড়ি কাজ করতেন। কিন্তু দু’বেলা খাওয়া জুটত না। কখনও শুধু ভাতের ফ্যান ও পুকুর থেকে তুলে আনা গেড়ি-গুগলি খেয়ে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে।

লক্ষ্য: গোকুলমকে চ্যাম্পিয়ন করে জবাব দিতে চান পলি। ফাইল চিত্র

লক্ষ্য: গোকুলমকে চ্যাম্পিয়ন করে জবাব দিতে চান পলি। ফাইল চিত্র

শুভজিৎ মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ০৪:৪৯
Share: Save:

বাংলা মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। অথচ নিজের রাজ্যেই উপেক্ষিত পলি কোলে। হতাশায় বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছেন কেরলে। তাঁকে ঘিরেই এখন মহিলাদের আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে গোকুলম এফসি।

সিঙ্গুরের বুড়াশান্তির মাঠে বাড়ি পলির। মাস দু’য়েক আগে প্রয়াত বাবার রোজগার বলতে ছিল একশো দিনের কাজ। মা অন্যের বাড়ি কাজ করতেন। কিন্তু দু’বেলা খাওয়া জুটত না। কখনও শুধু ভাতের ফ্যান ও পুকুর থেকে তুলে আনা গেড়ি-গুগলি খেয়ে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে। কখনও খাবার বলতে শুধুই ছাতু। প্রবল দারিদ্রের মধ্যেও একমাত্র মেয়ের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে কখনও বাধা দেননি পলির বাবা-মা। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে ফুটবল খেলতেন বছর চোদ্দোর পলি। হঠাৎই চোখে পড়ে যান আসিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম সদস্য ষষ্ঠী দুলের। তিনি এক দিন পলিকে নিয়ে যান হরিপালের শিবু মান্নার কাছে। গ্রামের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। পলি হলেন তাঁর একমাত্র মেয়ে শিক্ষার্থী। শুরু হল নতুন লড়াই।

সোমবার লুধিয়ানা থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে পলি শোনালেন তাঁর সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি, ‘‘রোজ ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। সিঙ্গুর থেকে সকাল পাঁচটা কুড়ির ট্রেনে হরিপাল যেতাম। প্র্যাক্টিস করে বাড়িতে ফিরেই যেতে হত স্কুলে। ক্লান্তির চেয়েও কঠিন ছিল খিদের যন্ত্রণা সহ্য করা।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘শিবু স্যর বলতেন, ভাল ফুটবলার হওয়ার জন্য শক্তিশালী শরীর অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমাদের পরিবারের যা অবস্থা ছিল, তাতে মাছ-মাংস-ডিম-দুধ খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। এমনও দিন গিয়েছে, ভ্যাতের ফ্যান পাওয়া যায়নি। গেড়ি-গুগলিও পুকুর থেকে তুলতে পারিনি। ছাতু শেষ হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় অন্যের খেত থেকে তুলে আনা ছোলা আমরা চার জনে ভাগ করে খেতাম। কখনও কখনও সেটাও জুটত না। তখন শুধু জল খেতাম।’’

প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এক দিনের জন্য ফুটবল বন্ধ করেননি পলি। তার পুরস্কার কয়েক বছরের মধ্যেই পেলেন তিনি। সিঙ্গুরের গোলাপমোহিনী মল্লিক গার্লস হাইস্কুলের হয়ে খেলার সময়ই অনূর্ধ্ব-১৯ বাংলা দলে নির্বাচিত হন পলি। বছরখানেকের মধ্যেই জায়গা করে নেন সিনিয়র দলে। পলির বাড়িতে সে দিন রীতিমতো উৎসবের আবহ। আর অভুক্ত থাকতে হবে না। বাংলা দলে সুযোগ পেয়েছে মানে চাকরি নিশ্চিত। পলিও সিদ্ধান্ত নেন, চাকরি পেলে মাকে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেবেন না।

কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি দিন লাগেনি। হতাশ পলি বলছিলেন, ‘‘অন্যান্য রাজ্যের ফুটবলারেরা অধিকাংশই সরকারি চাকরি করে। রাজ্য দলের হয়ে খেললে চাকরি নিশ্চিত। ব্যতিক্রম বাংলাতেই। জাতীয় দলে হয়ে খেলা সত্ত্বেও আমি চাকরি পাইনি।’’

ক্ষোভেই কি বাংলা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? ‘‘একদমই তাই। আমি একা নই, আমার মতো অনেকেই এই কারণে বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছে।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘বছর দু’য়েক আগের কথা। চাকরি নেই। কোনও ক্লাব আমাকে ডাকেনি। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। এই সময় জাতীয় নির্বাচক শুক্লা দত্ত আমাকে পুণে এফসির ট্রায়ালে নামার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি নির্বাচিত হলাম।’’ তবুও বাংলা ছাড়ার কথা ভাবেননি পলি। গত বছর কটকে জাতীয় ফুটবলে বাংলার অধিনায়ক নির্বাচিত হন তিনি। সেমিফাইনালে তামিলনাড়ুর কাছে হারলেও জাতীয় নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান দাভিদ সিলভার ভক্ত। কিন্তু ফের বিপর্যয় নেমে আসে পলির জীবনে।

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ভারতীয় দল নেপাল রওনা হওয়ার ঠিক আগে প্রয়াত হন পলির বাবা। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আর খেলা হল না বঙ্গ ডিফেন্ডারের। অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচের জন্য ফের পলি ডাক পেলেন ভারতীয় দলে। শিবিরে থাকার সময়ই গোকুলম এফসি প্রস্তাব দেয় তাঁকে। প্রথমে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি তিনি। পলির কথায়, ‘‘বাংলা ছাড়ার কথা ভাবতেই পারিনি আমি। তাই ওদের প্রস্তাবে রাজি হইনি। গোকুলমের কর্তারা হাল ছাড়েননি। বারবার সই করার জন্য অনুরোধ করলেন। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম গোকুলমে খেলার।’’ ক্ষুব্ধ পলি যোগ করলেন, ‘‘ভাবতে পারেন, মেয়েদের আই লিগে বাংলার কোনও ক্লাব নেই। অথচ বাংলায় প্রতিভা কম নেই। কেউ কেউ সীমা সুরক্ষা বলকে বাংলার দল বলার চেষ্টা করছে। আমি কিন্তু তা মনে করি না। পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে কোনও মেয়ে বাংলার হয়ে খেলতে চাইবে না। গোকুলমে আমি খুব ভাল আছি। মা এখন আর অন্যের বাড়িতে কাজ করেন না। সংসারের অভাব অনেকটাই দূর হয়েছে আমাদের।’’

আই লিগ শেষ হলেই অসম রাইফেল্‌সে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল পলির। বললেন, ‘‘আশা করছি, মণিপুর পুলিশকে হারিয়ে ২২ মে আই লিগের ফাইনালে আমরা খেলব। তার পরে অসম রাইফেল‌্‌সে যোগ দেওয়ার কথা। ইতিমধ্যেই আমার ইন্টারভিউ ও মেডিক্যাল হয়ে গিয়েছে।’’

জাতীয় দলের প্রাক্তন তারকা ও পলির ‘মেন্টর’ শুক্লা দত্ত বললেন, ‘‘একটা সময় ভারতীয় দলে আট-দশ জন বাংলার ফুটবলার থাকত। এখন একমাত্র সঙ্গীতা বাশফোর নিয়মিত খেলছে। এই রাজ্যে মহিলা ফুটবলারদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, চাকরি নেই। আই লিগে কলকাতার কোনও দল নেই। ওরা থাকবে কেন?’’

বঙ্গ কর্তাদের ঘুম কবে ভাঙবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Football Gokulam FC Poly Kole
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE