বিজয়িনী: সোনা জিতে জ্যোতি। ছবি: পীতম্বর নেয়ার
ভাগ্যিস হরিয়ানার রুরকি গ্রামের সরপঞ্চ সুধীর হুডা বছর বারোর মেয়েটির বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন সে দিন! না হলে বিশ্ব যুব মহিলা বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতা স্বপ্ন হয়েই থেকে যেত ভারতের ফ্লাইওয়েট (৫১ কেজি) বক্সার জ্যোতি গুলিয়ার জীবনে।
জ্যোতির বাবা মামান সিংহ আট বছর বয়সেই মেয়েকে দিয়েছিলেন কড়া ফতোয়া, ‘‘লেখাপড়া আর বাড়ির কাজকর্ম ছাড়া সতেরো বছর পর্যন্ত আর কিছু করা চলবে না। তার পরে আঠারো বছর বয়স হলে পাত্রস্থ করে দেওয়া হবে।’’ কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। রোহতকের মেয়ে জ্যোতির ফাইনাল বাউটে রবিবার প্রতিপক্ষ ছিল রাশিয়ার বক্সার একতারিনা মলশানোভা। ফাইনালে একতারিনাকে একতরফা ৫-০ হারিয়ে যখন জ্যোতি সোনা জিতে ফিরছে তখন সেই হাসি মিলিয়ে গিয়েছে। নবীন চন্দ্র বরদলৈ ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তখন ঘোষণা হচ্ছে, আগামী বছর বুয়েনস আইরেস-এ যুব অলিম্পিক্সে ভারত থেকে বক্সিংয়ে একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী জ্যোতি গুলিয়া। জাঠ পরিবারের মেয়ের দু’চোখ বেয়ে তখন বইছে আনন্দাশ্রু। আবেগ ভরা গলায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের জ্যোতি এ বার বলতে শুরু করে, ‘‘বাবার কথা সে দিন চুপ করে শুনেছিলাম। কিন্তু ২০০৮ সালের মাঝামাঝি গ্রামের একটি ছেলে বক্সিংয়ে আন্তঃগ্রাম টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমাদের বাড়িতে এসে আমার মুখের সামনে বার বার পদকটা দোলাচ্ছিল। আর বলছিল, এ সব তোদের ব্যাপার নয়। ভাল করে রান্নাবান্না শেখ।’’ এতেই জেদ চেপে যায় জ্যোতির। জাঠ মেয়ে ফের বলে, ‘‘তখনই ঠিক করে ফেলি, বক্সার আমাকে হতেই হবে। আর ওই ছেলেটির চেয়েও ভাল ফল করব।’’
কিন্তু বাড়িতে কড়া নির্দেশ, পড়া আর বাড়ির কাজ ছাড়া অন্য কিছু নয়। জ্যোতি তাই বন্ধুর বাড়িতে পড়তে যাওয়ার নাম করে লুকিয়েচুরিয়ে গ্রামের সরপঞ্চ সুধীরের কাছে বক্সিং শিখত। তিনিই প্রথম জ্যোতিকে বক্সিং গ্লাভস কিনে দিয়েছিলেন। এ ভাবে চলতে চলতে পাঁচ বছর আগে বাবা-মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায় হরিয়ানার আন্তঃস্কুল বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে।
আরও পড়ুন: আজ শেষ আটে উঠলেও দুশ্চিন্তা থাকবে বাংলার
সে দিনের কথা মনে করতে গিয়ে মলিন হাসি জ্যোতির মুখে। এ বার বলে, ‘‘অন্য বিভাগে যারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তাদের অভিভাবকরা মেয়েদের নিয়ে আনন্দ করছিলেন। আর আমার বাবা স্কুল থেকেই মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে আসেন। তার পরে বাড়িতে বাবা-মা দু’জনে মিলে পেটাচ্ছিলেন।’’ এই সময়েই খবর পেয়ে জ্যোতির বাড়িতে ছুটে আসেন গ্রামের সরপঞ্চ সুধীর। তাঁকে দেখে মেয়েকে পেটানো বন্ধ করেন এই কৃষক দম্পতি। সুধীর মধ্যস্থতা করে বলেন, ‘‘ও যদি সোনা জিততে না পারে, তা হলে বক্সিং বন্ধ করে দিও। এখন ওকে না মেরে ভাল খেলার উৎসাহ দাও। না হলে পুলিশের কাছে গিয়ে তোমাদের নামে অভিযোগ করব।’’
এর পরেই পাইকা ন্যাশনাল গেমস-এ জোড়া সোনা জিতে বাবা-মা দু’জনকেই চুপ করিয়ে দেয় জ্যোতি। জাতীয় স্কুল গেমসে সোনা জয়ের পর খবরের কাগজে নাম আর ছবি বেরোতেই বাড়ি থেকে আর বাধা আসেনি বক্সার জ্যোতির জীবনে। আর চলতি বছরে জ্যোতির জীবনে যেন সাফল্যের বর্ষণ ঝরে পড়ছে। বছরের শুরুতে জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়ন হওয়া। তার পরে সার্বিয়াতে গিয়ে দেশের হয়ে সোনা জয়। সেপ্টেম্বরে তুরস্কে আহমেট কোমার্ট বক্সিং টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ। আর গুয়াহাটিতে এ বার যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
গুয়াহাটিতে বিশ্ব যুব মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে জেতা সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে জ্যোতি বলছে, ‘‘এই সোনার পারফরম্যান্স উৎসর্গ করছি গ্রামের সরপঞ্চ সুধীর (হুডা) স্যারকে। উনি না থাকলে এই জায়গায় আসতে পারতাম না। রিংয়ে নামলেই মনে পড়ে, সোনা জিততে না পারলে বক্সিং ছাড়িয়ে দেবে বাবা। সেই পরিস্থিতি যদিও এখন নেই। কিন্তু ওই কথাটাই আমাকে ভাল পারফর্ম করতে তাড়িয়ে বেড়ায়।’’
গুয়াহাটিতে জ্যোতির পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ ভারতীয় যুব মহিলা দলের কোচ ভাস্করকুমার ভট্ট এবং জাতীয় দলের পর্যবেক্ষক অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন অলিম্পিয়ান বক্সার অখিল কুমার। দু’জনেই বলছেন, ‘‘জ্যোতির সবচেয়ে বড় সম্পদ ফুটওয়ার্ক। মেয়েটা যেন রিংয়ে উড়ে বেড়ায়। তা ছাড়া ওর পাঞ্চটাও বেশ জোরালো। নিজেকে ঠিক মতো ধরে রাখতে পারলে সিনিয়র দলেরও ভবিষ্যৎ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy