Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ধোনির সঙ্গে কাপ-বাণিজ্যকেও জীবনে ফিরিয়ে দিল অ্যাডিলেডের ইতিহাস

মেলবোর্নে সোমবার সকালে বেশ ঠান্ডা। একটা হালকা জ্যাকেট হলে খারাপ হয় না। কারণ তাপমাত্রা ১৫-তে নামা। পঞ্চাশ মিনিট বিমান দূরত্বের অ্যাডিলেড রোববার যেমন ছিল তেমনই। ফুটন্ত এবং না জিজ্ঞেস করেই বোঝা যায় চল্লিশের কাছাকাছি। বিশ্বকাপ তাপমাত্রাতেও তেমনই তফাত। এমসিজির কাছটা বেশ ঝিমিয়ে আছে। যেন ক্রিকেট সিজনই নয়। ওখানে পৌঁছতে গেলে জলিমন্ট স্ট্রিট হয়ে যেতে হয়। নামটা চেনা চেনা লাগল? এখানেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অফিস।

মেলবোর্নের ফ্লাইটে পাক-বধের তিন নায়ক। ছবি: টুইটার

মেলবোর্নের ফ্লাইটে পাক-বধের তিন নায়ক। ছবি: টুইটার

গৌতম ভট্টাচার্য
মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৮
Share: Save:

মেলবোর্নে সোমবার সকালে বেশ ঠান্ডা। একটা হালকা জ্যাকেট হলে খারাপ হয় না। কারণ তাপমাত্রা ১৫-তে নামা।

পঞ্চাশ মিনিট বিমান দূরত্বের অ্যাডিলেড রোববার যেমন ছিল তেমনই। ফুটন্ত এবং না জিজ্ঞেস করেই বোঝা যায় চল্লিশের কাছাকাছি।

বিশ্বকাপ তাপমাত্রাতেও তেমনই তফাত। এমসিজির কাছটা বেশ ঝিমিয়ে আছে। যেন ক্রিকেট সিজনই নয়। ওখানে পৌঁছতে গেলে জলিমন্ট স্ট্রিট হয়ে যেতে হয়। নামটা চেনা চেনা লাগল? এখানেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অফিস। দেশ-বিদেশ থেকে মিচেল জনসনরা যা সব ট্রফি জিতে আনেন এখানকার ক্যাবিনেটেই সেগুলো গচ্ছিত থাকে। তা সেই এলাকাটাতেও বিশেষ তৎপরতা নেই। কেবল অফিসে টিভি চলছে বলে আয়ারল্যান্ড যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনটা ঘটালো, সেটা নিয়ে হাল্কা আলোচনা চলছে।

ওই অঞ্চলে দাঁড়িয়ে দুপুর-দুপুর ভাবার চেষ্টা করছিলাম ব্র্যাডম্যানের শহর কি ভারতীয় ঔপনিবেশিকতা থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে? কারণ শহর ছাড়া পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটের ‘গভর্নর জেনারেল’-এর কর্তৃত্বেই ছিল। বিরাট কোহলি এবং গোটা দল।

অ্যাডিলেড বিমানবন্দরে অবশেষে দেখা গেল বিশ্বকাপের অঙ্গসজ্জা হয়েছে। বিশাল তিনটে স্টাম্প আর দুটো বেল এনে সাজানো হয়েছে। কিন্তু আসল ইন্টেরিয়র ডেকরেশন নীল জার্সির ভারতীয় সমর্থকেরা। গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে যেন তাঁরা বিমানবন্দরে ঢুকছেন। একটা বড় অংশ তখনও অ্যাডিলেড ছাড়েনি। এরা বেশির ভাগই ছাত্রস্থানীয়। টিমকে দুপুরের প্লেনের জন্য রওনা করিয়ে দিয়ে তবে নিজেরা শহর ছাড়বে।

অ্যাডিলেড বিমানবন্দরে ডোমেস্টিক আর ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচারের প্রবেশ গেট একই। নীল জার্সিতে ভরা গ্রুপের সঙ্গে তাই একঝলক দেখা গেল বিষণ্ণ একঝাঁক সবুজ জার্সি। না, এরা পাকিস্তান সমর্থক নন, পাকিস্তানি ক্রিকেটার। সকাল সকাল উড়ে গেলেন রিচার্ড হ্যাডলির শহরে। ক্রাইস্টচার্চে তাদের পরের ম্যাচ আয়ারল্যান্ড বিজিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। দেশ থেকে তাঁরা খবর পেয়েছেন প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ। পাকিস্তানি আওয়াম এই বারবার করে ভারতের কাছে বিপর্যয় মেনে নিতে পারছে না।

সোমবারও ভারতীয় সমর্থকদের জয়ের উৎফুল্ল হ্যাংওভার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ছবিটা তো অনায়াসেই উল্টোও হতে পারত? তখন কী হত? পাকিস্তান ম্যাচ হারলে কী হত? এই হাসিমুখগুলো কি তখন অ্যাডিলেড ওভালে মূর্তিমান জনরোষে রূপ নিত না?

অ্যাডিলেড মাঠে রোববার ফের কোহলিরাজ বহাল ছিল। কিন্তু এই মাঠের স্কোরারদের কাছে যা শোনা গেল তা সত্যি হলে তাঁর রাজত্ব মোটেও নিষ্কণ্টক নয়। বরঞ্চ শত্রু কিলবিল করছে। প্রথম এ মাঠে কোহলি সেঞ্চুরি করেন ২০১১-র টেস্টে। এর পর অ্যাডিলেড ওভালে ম্যাচ ছিল মাইকেল ক্লার্ক-সহ নিউ সাউথ ওয়েলসের। স্কোরবোর্ডে কোহলি নামটা দেখে সেই নিউ সাউথ ওয়েলস টিমের কেউ কেউ বোর্ড থেকে লেখাটা খুলে আনেন। তার ওপর পা দিয়ে এক একজন সেটা উত্তেজিত ভাবে মাড়ান। মাইকেল ক্লার্ক সে দিনও এবিপি-কে সাক্ষাৎকার দিলেন অ্যাডিলেড টেস্টে কোহলির চতুর্থ ইনিংস সেঞ্চুরির মতো ভাল ইনিংস কখনও দেখেননি। কিন্তু সেটা তো পেশাদারি শ্রদ্ধা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্লার্ক, ওয়ার্নার, ওয়াটসনদের সঙ্গে কোহলির প্রথম সফর থেকেই লেগেছিল। সেটা এমন ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে পারে যে স্কোরবোর্ড সংখ্যা মাড়িয়ে দেওয়া হবে ভাবাই যায় না।

ভারত জিতে যাওয়ায় ধোনির চেয়েও বেশি স্বস্তিতে বোধহয় টিভি ব্রডকাস্টাররা। অস্ট্রেলিয়ায় আর সেই চ্যানেল নাইনের রমরমা দিন নেই। বিশ্বকাপ দেখাচ্ছে ফক্স স্পোর্টস। কিন্তু আসল প্রযোজনার দায়িত্বে স্টার স্পোর্টস। তারা পাকিস্তান ম্যাচের আগে কার্যত খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। এ বার টিম অস্ট্রেলিয়ায় এত হারছিল যে টিআরপি কী উঠবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল সব মহলেই। পাকিস্তান ম্যাচ হেরে গেলেই ঝপ করে টিআরপি আরও পড়ে যেত। এই মুহূর্তে বিশ্বক্রিকেট বাণিজ্যের যা অবস্থা ভারতই ব্রহ্মা, ভারতই বিষ্ণু, ভারতই মহেশ্বর!

বেসরকারি হিসেব শুনলাম যে ভিউওয়ারশিপের মোট ৭৮ শতাংশ উপমহাদেশীয়। যার মধ্যে ৭০ শতাংশ শুধু ভারতীয় দর্শক। বাকি বিশ্বের যে ২২ শতাংশ পড়ে থাকল তার মধ্যেও প্রচুর সংখ্যক অনাবাসী ভারতীয়। অর্থাৎ পুরো কাঠামোটাই এমন বিপজ্জনক ভাবে ভারতের ওপর দাঁড়িয়ে যে ধোনির টিম কোয়ার্টার ফাইনাল উঠতে না পারলে বিশ্বকাপ বাণিজ্যে মড়ক লেগে যাবে। অনেকের ধারণা সে জন্যই দুটো গ্রুপ থেকে চারটে করে টিম তোলার ব্যবস্থা হয়েছে যাতে ভারত কোনও মতেই ক্রিকেট অনিশ্চয়তার ফাঁক দিয়ে গলে না যায়!

মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সাংবাদিক সম্মেলনে কাল গিয়ে মনে হল অস্ট্রেলিয়ায় হারতে হারতে তিনিও একটা গারদের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। রোববার যেন সেই কয়েদখানা থেকে বেরোলেন। বললেন, “আমরা যে গত দু’মাসে অনেক হেরেছি এটা মাথায় রাখতে চাই না। তা হলে অতীতের ব্যর্থতা এমন চেপে ধরবে যে সামনের দিকে আর অসমসাহসী হয়ে এগনো যাবে না।”

প্রেস মিট করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধোনিকে তাঁর পরিচিত কেউ বললেন, আপনার মেয়ে বড় হয়ে দশ বছর পর আজকের ম্যাচটা ইউটিউবে দেখবে আর সে দিন বাবার জন্য গর্বিত হবে। ধোনি এক গাল হাসলেন। এটা অবশ্যই প্রচণ্ডতম চাপ থেকে বেরিয়ে আসার সুখের হাসি।

ঠিক তখন মনে হল স্টার স্পোর্টস কর্তারা, না ভারত অধিনায়ক? পাক ম্যাচ প্রাক্কালে কারা বেশি চাপে ছিলেন সেটা এখন ক্যানবেরাস্থিত অস্ট্রেলিয়ান ইন্সটিটিউট অব স্পোর্ট গবেষণা করে দেখতে পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE