Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
একান্ত সাক্ষাৎকারে মেরি কম: এ বারের খেতাবই এক নম্বরে

‘বক্সিংই জীবন, সেরাটা দিয়ে যাওয়াই মন্ত্র’

বিশ্ব খেতাবের ডাবল হ্যাটট্রিক করে অনন্য নজির গড়তে সবাই দেখেছে। যেটা কেউ দেখেনি, তা হল কী ভাবে তিনি এই খেতাব জিতলেন। প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে শনিবার রিংয়ে নামেন। রেকর্ড ষষ্ঠ সোনা জেতার পরে অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়। যে কারণে কাউকে আলাদা করে সাক্ষাৎকার দেওয়া দূরে থাক, ভাল মতো বিজয়োৎসবও সারতে পারেননি। রবিবারও বেশির ভাগ সময়টাই কাটাতে হল বিশ্রাম নিয়ে। তার মধ্যেই রাতের দিকে কিছুটা সুস্থ বোধ করায় আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন মেরি কম। গোটা দেশের কাছেই যিনি এখন প্রেরণা।  আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন মেরি কম। গোটা দেশের কাছেই যিনি এখন প্রেরণা।

প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে শনিবার রিংয়ে নেমেও সোনা জয় করলেন মেরি কম।

প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে শনিবার রিংয়ে নেমেও সোনা জয় করলেন মেরি কম।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:১৮
Share: Save:

প্রশ্ন: ছ’টি বিশ্ব খেতাব। কোনটাকে সেরা বাছবেন?

মেরি কম: আগে যত বার জিতেছি, সবই তো পুরনো হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি হয়ে রয়েছে। এটা এইমাত্র ঘটল। তাই অনেক বেশি টাটকা ঘ্রাণ। এটাকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছি। তা ছাড়াও এই ষষ্ঠ খেতাবটাকেই সেরা বাছব কারণ এটা দেশের জনতার সামনে, আমার পরিবারের সামনে এল বলে (যদিও তিন সন্তানের দু’জন দেশে ছিল না, তারা স্পেনে স্কুলের ভ্রমণে গিয়েছে। স্বামী এবং এক ছেলে উপস্থিত ছিল)। আমি যে দেশের মাটিতে এই চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিততে পারলাম, সেটা ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছে। আরও একটা কথা ভেবে ভাল লাগছে যে, ছ’টি খেতাব জেতার নজির গড়তে পেরেছি আমি। যা আর কারও নেই।

প্র: পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিন সন্তানের জননী বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতছেন। কী ভাবে দিনের পর দিন অসম্ভবকে সম্ভব করেন মেরি কম?

মেরি: বক্সিং আমার জীবন। আমি জীবনে কখনও একটাও প্র্যাক্টিস সেশনে অনুপস্থিত থাকিনি। দিনে অন্তত একটা প্র্যাক্টিস সেশন আমি করবই। কখনও তার নড়চড় হয়নি। আমি মনে করি, যদি কোনও কিছুর প্রতি তোমার নিখাদ ভালবাসা আর দায়বদ্ধতা থাকে, তা হলে যার জন্য পরিশ্রম করছ সেই জিনিসটাও তোমার ডাকে সা়ড়া দেবে। যদি মনের ভিতর থেকে সর্বশক্তি দিয়ে বিশ্বাস করতে পারো যে, তুমি এটা পারবে তা হলে লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। আমি তিন সন্তানের মা— তাতে কী এসে-যায়? আমি যদি এখনও রোজ পরিশ্রম করে যাই, তা হলে পারব না কেন? এখনও প্রত্যেকটা দিন পরিশ্রম করার সময় আমি ট্রেনিং সেশনগুলো খুবই উপভোগ করি। আনন্দ সহকারে ট্রেনিং করি। কখনও মনে হয় না, শরীর দিচ্ছে না তবু নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে আমি বলি, যত দিন উপভোগ করবে মেরি, তত দিন তুমি রিংয়ে থাকতেই পারো।

প্র: মেরির মোটিভেশন কী?

মেরি: ২০১৬ অলিম্পিক্সে যেতে না পারাটা খুব ঝটকা দিয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে এখন আমার একটাই লক্ষ্য— ২০২০ টোকিয়ো অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করা এবং সেখান থেকে সোনা জিতে ফেরা। এটা একটা দিক। আর অন্য কথাটা হচ্ছে, বক্সিং চালিয়ে যেতে আমার কোনও আলাদা মোটিভেশনের দরকার পড়ে না। বললাম যে, বক্সিং আমার জীবন। রিংয়ে নামব, তার জন্য ট্রেনিং করতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, নিজের কাজে ফাঁকি দেব না— এগুলোই তো মোটিভেশন। আর কী লাগবে নিজেকে তাতানোর জন্য? এ বছরেই আমি কমনওয়েলথে সোনা জিতেছি। বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতলাম। কিন্তু ভাইয়া, মেরি এখানেই থামছে না (আবার প্রাণ খোলা সেই মেরি-সুলভ হাসি)!

প্র: আপনার প্রস্তুতির ধরন সম্পর্কে জানতে কৌতূহল হচ্ছে।

মেরি: আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম এবং শৃঙ্খলা ছাড়া কোনও লক্ষ্যেই পৌঁছনো যায় না। সেই কারণে ট্রেনিংয়ে কখনও ফাঁকি দিই না। দিনে এক বার, অনেক দিন দু’বেলা প্র্যাক্টিস সেশন করি। এই বক্সিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য আলাদা ভাবে খেটেছি আমি। খুব চাপও ছিল এ বারের প্রতিযোগিতা নিয়ে আমার উপর। নিজের দেশে নামছি বলে বুঝতেই পারছিলাম, সকলের নজর থাকবে আমার উপরে। আমি যে পেরেছি, সেটা ভেবেই ভাল লাগছে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন প্রত্যেকটা দিন খুব চাপ গিয়েছে। এখন অনেক হাল্কা লাগছে।

উচ্ছ্বাস: সোনার পদক নিয়ে স্বামী ও ছেলের সঙ্গে মেরি কম। —নিজস্ব চিত্র।

প্র: এত চাপ থাকার জন্যই কি শনিবার খেতাব জেতার পরে এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন? এ ভাবে কখনও এতটা অঝোরে কাঁদতে দেখিনি আপনাকে।

মেরি: একদমই তাই। দেশের মাটিতে এই খেতাবটা আমি মন থেকে ভীষণ ভাবে চেয়েছিলাম। এত মানুষ আমাকে সমর্থন করেন। আমার জীবনে অনেক ঝড়ই তো গিয়েছে। সমালোচকেরা কথা শোনাতেও ছাড়েনি। রিং থেকে চলে গিয়েও ফিরে এসেছি। কিন্তু দেশের মানুষ, ক্রীড়াপ্রেমীরা, আমার ভক্তরা সব সময় পাশে থেকেছেন। তাঁদের সামনে এই খেতাবটা জিততে চেয়েছিলাম। মনের মধ্যে পুষে রাখা সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পরে আর আবেগকে ধরে রাখতে পারিনি।

প্র: এ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য কী ধরনের ট্রেনিং করেছেন?

মেরি: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আগে আমার কোচেরা দম আর শক্তি বাড়ানোর বিশেষ ট্রেনিং করিয়েছিলেন। আমাকে প্রচুর স্প্রিন্ট করতে হত। সপ্তাহে এক বার জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে গিয়ে অন্তত আট পাক দৌড়তে হত। সেটা মোটামুটি ৩০০০ মিটার ধরতে পারেন। আমি চেষ্টা করেছি সেরা সময়ে সেটাকে সম্পূর্ণ করার। জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে আট পাক শেষ করার চেষ্টা করতাম ১১ মিনিটে। সব সময় হয়তো পারতাম না। কখনওসখনও ১১ মিনিটের একটু বেশি লেগে যেত। কিন্তু লক্ষ্যটা ওটাই রাখতাম। সেখানে আমরা সবাই দৌড়তাম। বক্সিংয়ে আমাদের পুরো মেয়েদের টিম। কী জানেন তো, আমার কাছে সব চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, ট্রেনিং করার সময় নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দাও। আমার কাছে প্রত্যেকটা দিন নতুন দিন। আগের দিন কী করেছি ভুলে গিয়ে নতুন দিনটায় তরতাজা হয়ে শুরু করতে হবে। আবার একশো শতাংশ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

প্র: খুব জানতে ইচ্ছে করছে, যিনি এত মানুষের অনুপ্রেরণা, তাঁর অনুপ্রেরণা কে?

মেরি: মহম্মদ আলি— আমার জীবনে সব চেয়ে বেশি প্রভাব ওঁরই। শুধুমাত্র বক্সিং রিংয়ের কিংবদন্তি আলি নন, রিংয়ের বাইরের মানুষটা, তাঁর লড়াই, তাঁর জীবন আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। নিজেকে আমি বার বার বলে গিয়েছি— মেরি, তোমাকে মহম্মদ আলি হতে হবে।

প্র: বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম সোনা ২০০২ সালে। ১৬ বছর পরেও মেরি কমই সেরা। কী ভাবে এই সাফল্যকে ব্যাখ্যা করবেন?

মেরি: (ফের সেই প্রাণখোলা হাসি) আমি আর কী বলতে পারি এটা নিয়ে! শুধু এটুকুই বলব যে, সব সময় নিজের সেরাটা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন মেরি কম কে বা কী, তা হলে একটাই উত্তর দেব— মেরি কম এমন একটি মেয়ে যে সব সময় শুধুই সেরা এবং সেরাটাই দিতে চেয়েছে। এটাই তো মেরি কম (ফের সেই হাসি)।

প্র: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে শেষ বার সোনা জেতেন আট বছর আগে। লম্বা সময়। কী ভাবে নিজেকে বুঝিয়েছিলেন যে, এখনও সম্ভব?

মেরি: ভক্তদের ভালবাসার কথা ভেবেছি। ওঁরা তো বিশ্বাস করেন যে, মেরি এখনও পারবে। আমার কোচেদের চোখের দিকে তাকাতাম। ওঁরা কী মনে করেন? আমি ফুরিয়ে গিয়েছি? কই না তো! ওঁরা তো বরং সারাক্ষণ বলে যাচ্ছেন, মেরি এটা করো, সেটা করো। তার মানে আমাকে নিয়ে ওঁরা এখনও ভাল কিছুই ভাবেন। বক্সিং ফেডারেশন, সাই (স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া), সরকার— সকলে সমর্থন করে গিয়েছে। আমার মনে হত, এত মানুষ যখন আমাকে সমর্থন করছেন, তখন আমিও পারব। আমাকেও প্রত্যেকের সমর্থনের মর্যাদা দিতে হবে। এই সাফল্যে প্রত্যেকটা মানুষের অবদান রয়েছে। বক্সিংয়ের প্রতি আমার আবেগ আমার মধ্যে পাকাপাকি ভাবে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, আমি যে কোনও শৃঙ্গ জয় করতে পারি। কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আমি জিতব কি না, সেটা জানি না। সব সময় হয়তো জিতব না। কোনও খেলাতেই সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন একটা দিনও যাবে না, যে দিন মেরি কম তার সেরাটা দেবে না।

প্র: স্বপ্ন দেখব কী ভাবে? আর কী ভাবে সেই স্বপ্নকে বাস্তব করা সম্ভব? মেরি কমের প্রেসক্রিপশন কী?

মেরি: কখনও হাল ছেড়ো না। পরিশ্রম করে যাও আর মনে রেখো সাফল্যের কোনও শর্টকার্ট হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Boxing MC Mary Kom Exclusive Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE