Advertisement
E-Paper

স্পিনমন্ত্র আর দুরন্ত ফিল্ডিং বিশ্বকাপে বড় অস্ত্র আমাদের

কোহালির নেতৃত্বেই তৃতীয় বার কাপ অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে ভারত। পারবেন কি তাঁরা? কী মনে করছেন ভারতরত্ন? আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সচিন তেন্ডুলকর।

সুমিত ঘোষ 

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৯ ০৪:২৯
যুগলবন্দি: কুল-চা জুটিতে আস্থা রাখছেন তেন্ডুলকরও। ফাইল চিত্র

যুগলবন্দি: কুল-চা জুটিতে আস্থা রাখছেন তেন্ডুলকরও। ফাইল চিত্র

কেউ বলেন, ক্রিকেট ঈশ্বর। কেউ বলেন, মাস্টার ব্লাস্টার। যিনি শুরু করেছিলেন বিস্ময় বালক হিসেবে। শেষ করেন কার্যত ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ডের মালিক হয়ে। আর চব্বিশ বছর ধরে তিনি খেলার সময় সারা ভারত গাইত ‘স্যা-চি-ন, স্যা-চি-ন’। বিশ্বকাপে এখনও তাঁর সব চেয়ে বেশি রানের রেকর্ড (২২৭৮) অক্ষত। কে ভুলতে পারবে ব্রিস্টলে বাবার মৃত্যুর পরেও সেই আবেগপূর্ণ সেঞ্চুরি! অথবা ২০০৩-এর সেঞ্চুরিয়নে আক্রম, শোয়েব, ওয়াকারদের পাকিস্তানকে চূর্ণ করা সেই মহাকাব্যিক ৯৮! বা ২০১১-তে অধরা বিশ্বকাপ জিতে বিরাট কোহালিদের কাঁধে চড়ে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ। এ বার সেই কোহালির নেতৃত্বেই তৃতীয় বার কাপ অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে ভারত। পারবেন কি তাঁরা? কী মনে করছেন ভারতরত্ন? আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সচিন তেন্ডুলকর। আসন্ন বিশ্বকাপ নিয়ে জানিয়ে দিলেন খোলামেলা মত।

প্রশ্ন: আপনার মতে এ বারের বিশ্বকাপে ফেভারিট কারা?

সচিন তেন্ডুলকর: আমি তো প্রথমেই বলব, আমরা এক নম্বর ফেভারিট। সব সময় চাইব, আমাদের ছেলেরাই কাপ নিয়ে ফিরুক। তবে নিরপেক্ষ ভাবে দেখতে গেলে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াও খুব ভাল দল। ইংল্যান্ড ধারাবাহিক ভাবে দারুণ ক্রিকেট খেলছে। ওদের দলে দুর্দান্ত ভারসাম্য রয়েছে। ব্যাটিংয়ে গভীরতা দেখার মতো। পাশাপাশি, অস্ট্রেলিয়াকে হাল্কা ভাবে নেওয়ার বোকামি নিশ্চয়ই কেউ করতে চাইবে না।

প্র: অস্ট্রেলিয়া নানান বিতর্কের পথ পেরিয়ে বিশ্বকাপে আসছে। কয়েক মাস আগেও খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল না। তারাই অন্যতম ফেভারিট?

সচিন: তার কারণ, অস্ট্রেলিয়া সব সময় বড় টুর্নামেন্টে ভাল খেলে। আর আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, সেই পুরনো অস্ট্রেলিয়ার ছবিটা ফিরে এসেছে। সেই ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করার সংকল্প দেখাচ্ছে ওরা। ইতিমধ্যেই সেই লক্ষণ দেখা গিয়েছে। বিশ্বকাপে সেটা আরও বাড়লে অবাক হওয়ার নেই। স্মিথ আর ওয়ার্নারের ফিরে আসা অস্ট্রেলিয়াকে পাল্টে দেবে। বিশ্বাস ফিরে আসবে, অনেক চনমনে হয়ে যাবে। ভুললে চলবে না, স্মিথ আর ওয়ার্নার দু’জনেই বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা দুই পারফর্মার। বিশেষ করে ওয়ার্নারের কথা বলব। দারুণ সফল একটা আইপিএল খেলে ও বিশ্বকাপে নামছে। আইপিএলে ওর খেলা দেখেই মনে হয়েছে, নিজেকে ফের প্রমাণ করার জন্য ছটফট করছে। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ক্রিকেট দুনিয়ায় নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুখিয়ে থাকবে ওয়ার্নার। আর তার ফায়দা তুলবে ওর দল। স্মিথও দেখিয়ে দিয়েছে, যত বড় মঞ্চ, তত চওড়া হয় ওর ব্যাট।

প্র: বিশ্বকাপ শুরু হতে আর আট দিন। যদি পূর্বাভাস করতে বলা হয় সেমিফাইনালের চার দল কারা হতে পারে, কাদের বাছবেন?

সচিন: প্রথমে যে তিনটি দলের কথা বললাম— ভারত, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া থাকবে। আমার হিসাবে চার নম্বর দল হতে পারে নিউজ়িল্যান্ড বা পাকিস্তানের মধ্যে কেউ।

প্র: ১৯৮৩-তে কপিল দেব, মোহিন্দর অমরনাথ, শ্রীকান্তরা। ২০১১-তে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে সচিন তেন্ডুলকর, যুবরাজ সিংহরা। সারা দেশের প্রশ্ন, তৃতীয় বার বিশ্বকাপ কি আনতে পারবেন বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মারা? আপনার কী মনে হচ্ছে?

সচিন: আমাদের দলটায় ভারসাম্য দারুণ। আলাদা আলাদা করে দেখুন। ব্যাটিংয়ের কথা যদি ধরা হয়, আমাদের দল সেরা ব্যাটিং শক্তিগুলোর একটা। বোলিংয়ে এ বার অসাধারণ বৈচিত্র রয়েছে। আমাদের তিন জন ফাস্ট বোলার রয়েছে। প্রত্যেকে আলাদা রকমের। বুমরাকে বোঝা কঠিন ওর অন্য রকম বোলিং অ্যাকশনের জন্য। ওর হাতে অনেক রকম বৈচিত্রও রয়েছে। মহম্মদ শামির বলটা বেশি স্কিড করে। শামি গত কয়েক মাস ধরে খুব ভাল ফর্মেও রয়েছে। আবার ভুবনেশ্বর দারুণ সুইং বোলার। আমার মনে হয় এই যে নানান ধরনের ফাস্ট বোলার আমাদের হাতে রয়েছে, সেটা ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় খুব সাহায্য করবে।

প্র: আর স্পিন বোলিং?

সচিন: সেটাতেই আসছিলাম। আমাদের স্পিন বোলিং বিভাগও প্রতিপক্ষ শিবিরে আতঙ্ক তৈরি করার মতো। দু’জন রিস্ট স্পিনার রয়েছে, যারা এই বিশ্বকাপে খুব বড় ভূমিকা নিতে চলেছে। বিশেষ করে মাঝের ওভারগুলোতে। তার পর ভুলে গেলে চলবে না যে, রবীন্দ্র জাডেজাও রয়েছে। ওর বাঁ হাতি অর্থোডক্স স্পিনটাও মোটেও হেলাফেলা করার মতো নয়। খুব আঁটোসাঁটো বোলিংও করতে পারে জাড্ডু। আমার মনে হয় বোলিংয়ে এই বৈচিত্র এবং তার সঙ্গে দুর্দান্ত ফিল্ডিং দক্ষতাই এ বার আমাদের দলে সম্পূর্ণতা এনে দিচ্ছে। এ বারের বিশ্বকাপে ফিল্ডিংও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। খেলার স্রোতের বিরুদ্ধে হঠাৎ একটা রান আউট বা ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা ক্যাচ বা দারুণ একটা ‘স্টপ’ নাটকীয় মোড় এনে দিতে পারে। আমাদের এই দলে অনেক ভাল ফিল্ডার আছে, যারা সেই সব মোড় ঘোরানো মুহূর্তগুলো এনে দিতে পারে। বিশ্বের সেরা ফিল্ডিং দল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আমাদের আছে।

প্র: এই বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের নায়ক হয়ে উঠতে পারেন কে?

সচিন: আমি আলাদা করে কাউকে বেছে নিতে চাই না। বিশ্বকাপে যে-ই দলের হয়ে ভাল খেলবে, সে-ই আমার কাছে হিরো। আমি একটা কথা বলতে চাই। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে চমকে দেওয়ার মতো প্রতিভা সব সময়ই থাকবে। তারা অবশ্যই স্পেশ্যাল ক্রিকেটার। কিন্তু তারা দু’একটা ম্যাচই নিজেদের দক্ষতার গুণে বের করে দিতে পারে। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট জিততে গেলে দলগত সাফল্য দরকার হবে। একা কেউ বিশ্বকাপ জেতাতে পারবে না, একটা টিম হিসেবে এগিয়ে যেতে হবে। আমি সব চেয়ে খুশি হব যদি দেখি শুরুতেই দল হিসেবে এই গতিটা আমাদের দল পেয়ে গিয়েছে। তা হলে বিশ্বকাপ অভিযান যত এগোবে, স্বপ্ন পূরণের ছবিটা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকবে।

প্র: তবু যদি জিজ্ঞেস করি, কোন জিনিসটা বিশ্বকাপে ভাগ্য গড়ে দিতে পারে, কোনটাকে বেছে নেবেন?

সচিন: আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডে অলরাউন্ড খেলা হবে। সেই কারণেই আমাদের দলের বৈচিত্র এবং সম্পূর্ণতা আমাকে বিশেষ ভাবে আশাবাদী করে তুলছে। যা মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপে ব্যাটিং উইকেটই হবে। আমার পরামর্শ, মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যাট করো, লম্বা সময় ধরে ব্যাট করো। যাতে স্কোরবোর্ডে বড় রান তোলা যায়। বোলারদের উপর খুবই ভরসা রাখছি আমি। শুরুতে আমাদের পেস বোলারদের উইকেট তোলার ক্ষমতা রয়েছে। ইংল্যান্ডে সিম বোলিং সহায়ক আবহাওয়া যখন-তখন এসে পড়তে পারে। সেটাকে কাজে লাগানোর মতো পেস বিভাগ এই মুহূর্তে আমাদের হাতে রয়েছে। তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে স্পিনাররা। মাঝের ওভারে উইকেট তুলে ওরা যদি প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারে তা হলে ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। মনে রাখা দরকার, দু’টো বল ব্যবহারের নিয়ম এসে যাওয়ার পরে ওয়ান ডে ক্রিকেটে রিভার্স সুইং হারিয়ে গিয়েছে। আমাদের সময়ে যেটা ছিল। এখন মাঝের ওভারে উইকেট তোলার ব্যাপারে স্পিনই ভরসা। আমাদের রিস্ট স্পিনাররা সেটা করে দেখাতে পারছে। মাঝের ওভারগুলোতে ইতিবাচক, বুদ্ধিদীপ্ত স্পিন বোলিং এবং তার সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য তীক্ষ্ণ ফিল্ডিং বিশ্বকাপে আমাদের তুরুপের তাস হতে যাচ্ছে।

প্র: ১৬ জুন, ম্যাঞ্চেস্টার। বিশ্বকাপের ব্লকবাস্টার ম্যাচ। ভারত বনাম পাকিস্তান। আর এই দ্বৈরথের কথা উঠলেই সকলের মনে পড়ে যায় ২০০৩ বিশ্বকাপে সেঞ্চুরিয়নে সচিন তেন্ডুলকরের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস। আপনার কতটা মনে আছে সেই ইনিংসের কথা?

সচিন: ওহ্! ভারত-পাকিস্তান অনেক ম্যাচই খেলেছি। সব সময়ই এটা বড় ম্যাচ ছিল এবং থাকবে। কিন্তু বিশেষ করে দু’টো ম্যাচের কথা আমি বলব। একটা ২০০৩-এর সেই সেঞ্চুরিয়ন ম্যাচ। অন্যটা ২০১১ সালের মোহালি। এ রকম আবহ আমি আর কখনও দেখিনি। ম্যাচের আগে যে রকম আবেগ আর প্রার্থনার ঢেউ উঠেছিল, অভাবনীয়! আমার এখনও মনে আছে, ২০০৩-এ জোহানেসবার্গের হোটেল থেকে যখন ম্যাচটা খেলতে বেরোচ্ছি, তখন থেকে উন্মাদনা দেখে শিহরিত হচ্ছিলাম। বাসে করে জো’বার্গ থেকে সেঞ্চুরিয়ন যাওয়ার পথে রাস্তার দু’ধারে ভক্তরা জাতীয় পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য! রাস্তার এক দিকে ভারতীয় ভক্তরা দাঁড়িয়ে তেরঙ্গা হাতে নিয়ে। অন্য দিকে পাকিস্তানের ক্রিকেট ভক্তরা তাঁদের জাতীয় পতাকা নিয়ে। সেই কারণে সেঞ্চুরিয়নে উপভোগ্য ক্রিকেট উপহার দিতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল। শুধু আমার ইনিংসটার জন্য নয়, দলগত ভাবে খুব ভাল ক্রিকেট খেলতে পেরে তৃপ্ত ছিলাম। আজও সেই তৃপ্তি থেকে গিয়েছে। ওই ম্যাচটা জিতে শক্তিশালী একটা বার্তা বোধ হয় দিতে পেরেছিল টিম ইন্ডিয়া যে, আমরা যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে, যে কোনও প্রতিপক্ষকে হারাতে পারি। আর জেতার পরে ভক্তদের প্রতিক্রিয়ায় যে বাঁধনহারা আবেগ দেখেছিলাম, সেটাও সারা জীবন মনে থাকবে। আমার মনে হয়, গোটা বিশ্বে যত ভারতীয় ক্রিকেট ভক্ত আছেন, সকলে সে দিন সেঞ্চুরিয়নে জেতার উৎসব করেছিলেন।

প্র: প্রচুর তর্ক-বিতর্ক চলছে ভারতের চার নম্বর ব্যাটসম্যান কে হবেন, তা নিয়ে। আপনার পছন্দ কে?

সচিন: আমার মনে হয়, বৃথাই এত কথা হচ্ছে এটা নিয়ে। আমাদের যা ব্যাটিং শক্তি, অনেকেই এই দায়িত্বটা পালন করে দিতে পারবে। যারা বিশ্বকাপের দলে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের সেই প্রতিভা রয়েছে, দক্ষতা রয়েছে। আমি অন্তত চার নম্বর নিয়ে নিদ্রাহীন রাত কাটানোদের মধ্যে নেই!

Cricket ICC World Cup 2019 India Sachin Tendulkar Kuldeep Yadav Yuzvendra Chahal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy