Advertisement
১০ মে ২০২৪
পাঁচশোর জয়ের দিনে নতুন যুদ্ধের মুখে বোর্ড

‘অমূল্য সম্পদ’ আর শ্রেষ্ঠত্বের পাঠ নিয়ে ইডেনে ঢুকবে ভারত

পরপর সাদা চেয়ারগুলো গ্রিন পার্কে পাতা শুরু হল ঠিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মুখে। বিরাট কোহালির নেতৃত্বাধীন গোটা ভারতীয় টিম ততক্ষণে ড্রেসিংরুমে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তা হলে এত আয়োজন কীসের? নাহ্, ওই তো আবার গোটা টিম নিয়ে বেরোচ্ছেন বিরাট এবং চেয়ারের বন্দোবস্ত তাঁদেরই জন্য।

জয় যখন মুঠোয়। কানপুরে টিম কোহালি। ছবি: প্রেম সিংহ

জয় যখন মুঠোয়। কানপুরে টিম কোহালি। ছবি: প্রেম সিংহ

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কানপুর শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:৩৮
Share: Save:

পরপর সাদা চেয়ারগুলো গ্রিন পার্কে পাতা শুরু হল ঠিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মুখে। বিরাট কোহালির নেতৃত্বাধীন গোটা ভারতীয় টিম ততক্ষণে ড্রেসিংরুমে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তা হলে এত আয়োজন কীসের? নাহ্, ওই তো আবার গোটা টিম নিয়ে বেরোচ্ছেন বিরাট এবং চেয়ারের বন্দোবস্ত তাঁদেরই জন্য।

ওখানে এখন টিম ইন্ডিয়ার ফটো সেশন হবে। ভারতবর্ষের পাঁচশোতম টেস্টে কোহালিদের মধুর জয়ের ফটো সেশন। আজই তো শেষ। আর ফিরবে না কখনও। চিরস্মরণীয় করে রাখতে হবে না তাকে?

এক-এক সময় ওই গ্রিন পার্ক দৃশ্য দেখলে মনে হতে পারে যে, এত চেয়ার না রাখলেও চলত। একটা রাখলেও বা ক্ষতি কী ছিল? শুধু তিনিই না হয় এসে বসতেন। মুরলী বিজয়ের দু’ইনিংসে হাফসেঞ্চুরি, রবীন্দ্র জাডেজার ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিয়ে যাওয়া, রিভার্স সুইংয়ে মহম্মদ শামির পঞ্চম দিনে আগুন ঝরানো, সব মাথায় রেখেও তো ম্যাচে প্রভাব বিচারে প্রকৃত ম্যান অব দ্য ম্যাচ তাঁর বাইরে কাউকে ভাবা যাচ্ছে না। আবারও ম্যাচে দশ উইকেট হল যাঁর, আবারও যাঁর দুরন্ত ঘূর্ণির উত্তর থাকল না বিদেশি টিমের কাছে। যাঁর নাম শোনামাত্র এখন মেজাজ ঠিক হয়ে যায় অধিনায়কের। গাম্ভীর্যের ভূষণ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে কিশোরের হাসি।

এত কিছুর পর রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে ম্যাচের প্রকৃত সেরা না ধরলে, চরম অন্যায়ই হবে।

কেন কে জানে, সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসা ভারত অধিনায়কের মেজাজ একটু বিগড়েই ছিল। অন্তত দেখে তাই মনে হয়েছে। মাথা নিচু, চোখ হাতের মোবাইলের দিকে। কোনও দিকে তাকাচ্ছেন না, সামনে দেখছেন না। সাধারণত জিতলে-টিতলে যে মেজাজ ভারত অধিনায়কের বিপরীতধর্মী। কথা বলতেও শুরু করেছিলেন অত্যন্ত সিরিয়াস মুখচোখ করে, কিন্তু রবিচন্দ্রন অশ্বিনের প্রশ্নটা কানে আসামাত্র পুরনো কোহালি ফিরে এলেন। স্মিত হাসি নিয়ে বলে দিলেন, অশ্বিন তাঁর টিমের এক দুর্মূল্য ঐশ্বর্য। যে নিজের ক্রিকেটীয় উন্নতিতে খাটতে পারে শুধু নয়, ক্রিকেট নিয়ে সমান ভাবতেও পারে। যে পারে গভীর ভাবে খেলাটাকে বুঝতে।

“টেস্ট টিমে অশ্বিনের মতো প্লেয়ার থাকাটা প্রাইসলেস। অমূল্য সম্পদ। আমি শুধু ওকে বলব, তুমি তোমার স্কিল নিয়ে কাজ করে যাও। যাতে আমরা আরও টেস্ট জিততে পারি, টেস্টে বাকিদের উপর দাপিয়ে বেড়াতে পারি,” বলছিলেন কোহালি।

ঠিকই বলছিলেন কোহালি। রবিচন্দ্রন অশ্বিন সত্যিই এখন এক দূর্মূল্য ভারতীয় সম্পদের নাম। যার বিচার অশেষ কাঞ্চনমূল্যের মাপকাঠিতেও করা যায় না। দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজের পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। ফিরে এসে নিউজিল্যান্ড-বধ, ছ’ফুটের স্পিনার যেন ব্যর্থতা কাকে বলে ভুলেই গিয়েছেন। এটাও অনস্বীকার্য যে, ভারতকে টেস্ট সিংহাসনে পাকাপাকি বসানোর নেপথ্য কারিগর হিসেবে অধিনায়কের সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কাউকে দিতে হলে, তাঁকেই দিতে হবে।

কিন্তু এ হেন স্পিন-কোহিনুর ছাড়াও কানপুর টেস্ট থেকে আরও এক সম্পদের খোঁজ পেল ভারত। আতঙ্কের গিরিখাদ থেকে সাফল্যের শিখরে উঠে আসার ক্রিকেট-পাঠ। দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত একটা টেস্টের কোথাও না থেকে সেই টেস্ট অবলীলায় জিতে ফেরা। টেস্টে শ্রেষ্ঠত্বের তাজ নিজেদের কাছে রেখে দিতে যে ক্ষমতা থাকা অতীব প্রয়োজন।

কোহালি একটা সময় বলছিলেন যে, সোমবার মাঠে নামার আগে তাঁরা একটা শপথ করেছিলেন। জয় নিয়ে টিমের কোনও সন্দেহ ছিল না। কোহালির মনে হয়েছিল, যে রানটা টার্গেট হিসেবে কেন উইলিয়ামসনদের দেওয়া হয়েছিল, তা তুলতে গেলে প্রতিপক্ষের এক থেকে এগারোকে ভাল নয়, অসম্ভব ভাল ব্যাটিং করতে হত। চতুর্থ ইনিংসে কে কবে চারশো তুলেছে আজ পর্যন্ত? কোহালিরা শুধু দেখতে চেয়েছিলেন, পড়ে থাকা ছ’টা উইকেটে কোন ভঙ্গিমায় তোলে টিম। চোখের সামনে পার্টনারশিপ হতে দেখলে, প্রতিপক্ষের কাঠিন্যের মুখে পড়লে, টিম কি অস্থির হয়ে পড়ছে? নাকি শান্ত মেজাজ অক্ষুণ্ণ রেখে ওঁত পেতে থাকছে বিপক্ষের একটা ভুলের?

ভারত অধিনায়ক এখানেও জিতলেন। মিচেল স্যান্টনার-লুক রঙ্কি সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ করলেন, হাফসেঞ্চুরি করলেন দু’জনে, স্যান্টনার আবার উইলিয়ামসনের চেয়েও বেশি বল খেলে ফেললেন, কিন্তু কখনওই ভারতীয় টিমের শরীরী ভাষা দেখে মনে হল না যে, ন্যূনতম অনিশ্চয়তায় তারা ভুগছে। সকালের প্রথম ঘণ্টায় বেধড়ক মারছিলেন রঙ্কি। অশ্বিনকে তো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু লাঞ্চের মধ্যে আরও তিনটে তুলে নিল ভারত। পর্যাপ্ত অপেক্ষা করে, একটা ভাল বলের খোঁজ রেখে। স্যান্টনার তার পরেও লড়ে যাচ্ছিলেন। উল্টো দিকে একের পর এক সতীর্থের পতন ঘটতে দেখেও দাঁতে দাঁত চাপা একক লড়াই। কিন্তু অশ্বিনের একটা আনপ্লেয়েবল ডেলিভারি সেটাও শেষ করে দিল। লাঞ্চের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চূর্ণ হল যাবতীয় ব্ল্যাক ক্যাপস প্রতিরোধ, ভারতকে বিশাল ১৯৭ রানে জিতিয়ে দিয়ে। বেসরকারি ভাবে কোহালিদের টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে যুগ্ম এক নম্বর করে দিয়ে।

নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন পরে বলে গেলেন যে, ম্যাচ থেকে তাঁর প্রচুর প্রাপ্তি রয়েছে। কিন্তু আদতে প্রাপ্তি একজন— স্যান্টনার। রোগাপাতলা চব্বিশ বছরের বাঁ হাতি নিউজিল্যান্ড অলরাউন্ডার গোটা সিরিজেই হয়তো কানপুরের লড়াই-ই দেবেন। কিন্তু ওতেই শেষ, তার বাইরে কিছু নয়।

উল্টো দিকে কোহালি— তাঁর কিন্তু ম্যাচ থেকে প্রাপ্তি অনেক কিছু থাকল। তাঁর টিম প্রথম পাঁচ সেশনের মধ্যে চারটেয় হেরেও পরের সব ক’টা জিতে ম্যাচ নিয়ে নিল। টেস্টের শুরুতে ওঠা ‘কেন মিশ্র নয়’ জাতীয় প্রশ্নের অন্তর্জলীযাত্রা ঘটিয়ে ভারত অধিনায়ক বোঝালেন, তিনি চার বোলার নিয়েও পারেন ম্যাচ বার করতে। “বিশেষ করে আমার হাতে যখন একটা অশ্বিন আছে। জাডেজার মতো নিখুঁত একজন স্পিনার আছে। আমি ভাবব না কেন? তবে কলকাতায় আরও ভাল ব্যাটিং উইকেট হবে, ওখানে বাড়তি বোলারে যেতেও পারি। কিন্তু কানপুরে এটাই আমার ঠিক মনে হয়েছিল,” বলে দিলেন কোহালি।

অধিনায়ক হিসেবে এক টিমে অশ্বিন-জাডেজাকে পেয়ে যিনি গর্বিত। তাঁর কাজ শুধু ড্রেসিংরুম আবহাওয়াকে ঠিক রাখা। ওখানে সৎ থাকা। তবেই তো তাঁর অস্ত্ররা কথা শুনবে। মাঠে কথা বলবে। বিশ্বাস করবে। টিমকে সাফল্য দেবে।

ওহ্, বলা হল না। ভারত অধিনায়ক আরও একটা কথা বললেন— ঘরে হোক বা বাইরে, ০-১ কোনও সিরিজে পিছিয়ে পড়লে খুব মুশকিল। মনের উপর চাপ পড়ে। প্রস্তুতি ঠিকমতো নেওয়া যায় না। সেখানে তাঁর টিমের আবার একটা ‘রোগ’ হল যে, তারা জেতার বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। তা সে যে টেস্টেই নামুক না কেন। প্রতিপক্ষকে অসম্মান করা নেই, শুধু একটা হিমশীতল বার্তা যেন ছেড়ে দেওয়া আছে।

ওহে নিউজিল্যান্ড, পুজোর কলকাতায় দেখা হচ্ছে। সিরিজের ‘বিসর্জন’ ওখানেই ঘটিয়ে দেব!

নিউজিল্যান্ড
দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৯৩-৪)

রঙ্কি ক অশ্বিন বো জাডেজা ৮০
স্যান্টনার ক রোহিত বো অশ্বিন ৭১
ওয়াটলিং এলবিডব্লিউ শামি ১৮
ক্রেগ বো শামি ১
সোধি বো অশ্বিন ১৭
বোল্ট ন.আ. ২
ওয়াগনার এলবিডব্লিউ অশ্বিন ০

অতিরিক্ত ৩, মোট ২৩৬।
পতন: ২, ৩, ৪৩, ৫৬, ১৫৮, ১৯৪, ১৯৬, ২২৩, ২৩৬, ২৩৬।
বোলিং: শামি ৮-২-১৮-২, অশ্বিন ৩৫.৩-৫-১৩২-৬, জাডেজা ৩৪-১৭-৫৮-১, উমেশ ৮-১-২৩-০, বিজয় ২-০-৩-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kanpur Test Team India New Zealand Historic win
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE