Advertisement
০৬ মে ২০২৪
সেরা হয়ে ওঠার এক যাত্রা শুরু

বিদেশে ৩-০ সিরিজ জিতে এ বার নতুন যুদ্ধের শপথ বিরাটের

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চেও বিশেষ উচ্ছ্বাস চোখে পড়ল না। হাসি-ঠাট্টা চলছে, ব্যাস ওইটুকুই। হার্দিক পাণ্ড্য ম্যাচের সেরা হয়েও খুব স্বাভাবিক। তাঁর মতো তরুণ ক্রিকেটারের গলাতেও উচ্ছ্বাসের থেকে প্রতিজ্ঞার সুর বেশি।

জয়ী: শ্রীলঙ্কাকে হোয়াইটওয়াশ করে সিরিজ জয়ের ট্রফি নিয়ে কোহালি। সোমবার পাল্লেকেলে-তে। ছবি: এএফপি।

জয়ী: শ্রীলঙ্কাকে হোয়াইটওয়াশ করে সিরিজ জয়ের ট্রফি নিয়ে কোহালি। সোমবার পাল্লেকেলে-তে। ছবি: এএফপি।

সুমিত ঘোষ
পাল্লেকেলে শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৭ ০৫:৫৩
Share: Save:

বিরাট কোহালির ভারতের বিজয়রথ ছুটে চলেছে। পাল্লেকেলের পাহাড়ে ঘেরা দর্শনীয় মাঠে তৃতীয় দিনের চা-পানের বিরতির মধ্যেই শ্রীলঙ্কাকে হোয়াইটওয়াশ করার মিশন সম্পূর্ণ করে ফেললেন তাঁরা। ইনিংস ও ১৭১ রানে জিতে বিরল কীর্তিই স্থাপন করে ফেলল কোহালির টিম।

এর আগে কোনও তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে বিদেশি কোনও দল হোয়াটওয়াশের কৃতিত্ব অর্জন করেছে এগারো বছর আগে। ২০০৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের দেশে ৩-০ হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। তার পর এই প্রথম কোহালির ভারত বিদেশি দল হিসেবে হোম টিমকে তিন বা বেশি ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করল। এশিয়ার কোনও দলও বিদেশের মাঠে গিয়ে এই কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি।

পাল্লেকেলের মাঠে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য চোখে পড়ল, যা দেখে মনে হতে শুরু করেছে এই ভারতীয় দল বা তাদের অধিনায়ক অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার বান্দা নয়। যেমন, অশ্বিনের ক্যারম বলে শ্রীলঙ্কার শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে লাহিরু কুমার বোল্ড হওয়া মাত্র তেমন কোনও উৎসবই করতে দেখা গেল না কাউকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্তত তিন-চার জনকে দেখা যায় দৌড়ে এসে স্টাম্প তুলে নিচ্ছেন স্মারক হিসেবে। এখানে কাউকে দৌড়েও আসতে দেখা গেল না।

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চেও বিশেষ উচ্ছ্বাস চোখে পড়ল না। হাসি-ঠাট্টা চলছে, ব্যাস ওইটুকুই। হার্দিক পাণ্ড্য ম্যাচের সেরা হয়েও খুব স্বাভাবিক। তাঁর মতো তরুণ ক্রিকেটারের গলাতেও উচ্ছ্বাসের থেকে প্রতিজ্ঞার সুর বেশি। ‘‘টিমের প্রয়োজনে যে কোনও জায়গায় ব্যাট করতে রাজি আমি। টেস্ট ক্রিকেটে ভাল করাটা আমার স্বপ্ন। সাদায় ভাল করতে চাই,’’ শপথবাক্যের মতো শোনাল প্রেজেন্টেশনে তাঁর ইন্টারভিউটা।

আট নম্বরে নেমে হার্দিকের ঝোড়ো সেঞ্চুরি টেস্টের সেরা বিনোদন হয়ে থাকল। তেমনই ভোলা যাবে না স্পিন-সহায়ক পিচেও মহম্মদ শামির ভয়ঙ্কর-সুন্দর বোলিং। একদিকে গতি আর বাউন্সে ব্যাটসম্যানকে ভয় পাওয়ালেন। অন্য দিকে, সিমের ব্যবহারে রিচার্ড হ্যাডলি, কপিল দেব-কে মনে করালেন।

ভারতের ৪৮৭ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা দুই ইনিংসে তুলল ১৩৫ ও ১৮১। শামি প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন দুই উইকেট। দ্বিতীয় দফায় নিলেন তিনটি। অশ্বিন প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন দু’টি। দ্বিতীয়তে নিলেন চারটি। চায়নাম্যান কুলদীপ যাদব নিলেন ম্যাচ থেকে পাঁচ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে উমেশ যাদবও পেলেন দুই উইকেট। কোনও এক জন স্টার পারফর্মার নেই। মিলিয়ে-মিশিয়ে সকলে তারকা।

রবি শাস্ত্রীর আজ উচ্ছ্বসিত হওয়ার দিন। ডিরেক্টরের পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে অনিল কুম্বলেকে আনা হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে ড্রেসিংরুমের আস্থা হারিয়ে কুম্বলের বিদায় এবং কোচ হিসেবে শাস্ত্রীর প্রত্যাবর্তন। ফিরেই ৩-০ হোয়াইটওয়াশ। কত কথা আজ বলতে পারতেন। কিন্তু বললেন না।

শিখর ধবন সিরিজের সেরা হলেন। মাঠের বাইরে গজল-ভক্ত, শান্তিপ্রিয় তিনি। মাঠের মধ্যে বিধ্বংসী ওপেনার। মুরলী বিজয়ের চোট না সারায় তাঁকে শেষ মুহূর্তে ডাকা হয়েছিল। যখন নির্বাচকদের ফোন পান, হংকংয়ে ছুটি কাটাচ্ছেন। ছুটি বাতিল করে দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে দু’টো সেঞ্চুরি-সহ তিন টেস্টের চার ইনিংসে মোট ৩৫৮ রান করে গেলেন। গড় ৮৯.৫। ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার নিতে এসে তবু বলে গেলেন, ‘‘কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। এখানে আমি রান পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হবে এই ফর্ম ধরে রাখতে হলে। টিমের মধ্যে সব ক’টি জায়গার জন্য খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে।’’

আত্মতুষ্টি নয়, ভবিষ্যতের আরও অনেক বড় লড়াইয়ের শপথ। কোহালির দলে এটাই বেশি করে চোখে পড়ল এমন একটা বিরল কৃতিত্বের দিনে। স্বয়ং অধিনায়ক সেই মন্ত্রে নেতৃত্ব দিলেন। ‘‘আমরা একটা তরুণ টিম। অনেকে একই এজ-গ্রুপের বলে একসঙ্গে চার-পাঁচ বছর খেলে যেতে পারি। আমরা নির্মম ক্রিকেট খেলতে চাই। বয়স আমাদের পক্ষে আছে।’’ যখন বলছিলেন কোহালি, অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের মতো শোনাচ্ছিল কথাগুলো।

স্টিভ ওয় বা রিকি পন্টিংরা এ ভাবে কথা বলতেন। মাঠের মধ্যে এ রকমই নির্মম পেশাদারের রূপ ধারণ করতেন তাঁরা। রেকর্ডের দিক থেকে স্টিভ বা পন্টিংয়ের সঙ্গে অধিনায়ক কোহালির তুলনাটাও খুব অমূলক নয়। অধিনায়ক হিসেবে জীবনের প্রথম ২৯টি টেস্টে স্টিভ এবং পন্টিংয়ের ছিল ২১টি জয়। কোহালি রয়েছেন তার পরেই, ১৯টি জয়।

স্টিভ বা পন্টিংও তাঁদের ক্যাপ্টেন্সি জীবনে সহজ প্রতিপক্ষ পেয়েছেন। কিন্তু সেটা পেয়ে নরম মন দেখাননি। নির্মম ভাবে প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করার চেষ্টা করেছেন। কোহালিকে দেখে মনে হচ্ছে একই পথ ধরে তাঁর রথও ছুটতে শুরু করে দিল। এর পর দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো কঠিন স্টেশনে রথ পাড়ি দেবে। সেগুলো অনেক বেশি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। কিন্তু কোহালির নেতৃত্বে তাঁর এই দলের মধ্যে জেতার উদগ্র নেশা এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, কঠিন সেই সব বিদেশ সফরেও যদি অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটে অবাক হওয়ার থাকবে না।

কোহালির প্রেস কনফারেন্স মিটে যাওয়ার পরে ভারতীয় ড্রেসিংরুমের দিকটায় গিয়ে আরও আকর্ষণীয় দৃশ্য দেখা গেল। ঠুকঠাক শব্দ আসে কোথা থেকে রে বাবা! ম্যাচ তো শেয হয়ে গিয়েছে। সিরিজ জয়ও সম্পূর্ণ। তা হলে? পিছন দিকে নেট প্র্যাকটিসের জায়গায় গিয়ে দেখা গেল, কে যেন ব্যাট করছেন। নিশ্চয়ই কোনও শ্রীলঙ্কান হবে। হারের মঞ্চ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হবে হয়তো।

কিন্তু কোথায় শ্রীলঙ্কান! এ তো কে এল রাহুল। এই টেস্টেই ধবনের সঙ্গী ওপেনার। ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারকে নিয়ে ব্যাট করে চলেছেন। মানে টেস্ট সিরিজ সম্পূর্ণ হতে না হতেই ওয়ান ডে-র ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গিয়েছে। হোয়াইটওয়াশের আবেগ নিয়ে পড়ে থাকার কোনও ব্যাপারই নেই। একটা জয় সম্পন্ন। সেটাকে পিছনে সরিয়ে দাও। এগিয়ে চলো নতুন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে।

এটাই বিরাট রাজার ভারত! নতুন ভারত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE