Advertisement
E-Paper

বিরাট-ফর্মের সঙ্গে পাঁচ প্রাপ্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট ধরছে ভারত

ব্রাউনওয়াশ তো হল। হোয়াইটওয়াশের কী হবে? হাতে পড়ে আর আঠারো দিন। সামনে এ বার ব্রিসবেনের সবুজ পিচ, দেশের মাঠের ব্যাটিং-ভূস্বর্গ নয়। বল উঠবে এ বার হাঁটু ছাড়িয়ে, লাফিয়ে আসবে মুখের কাছে, দিতে চাইবে ‘চিন মিউজিক’-এর চুমু। এরাঙ্গা বা কুলশেখরার ১২৫ প্লাস পেস বোলিং আজ থেকে অতীত, এ বার হিংস্র চোখমুখে দৌড় শুরু করবেন কোনও এক মিচেল জনসন। ক্লাস টেস্টের ভাল ছাত্রের এ বার এমএসসি-র মহাপরীক্ষা।

প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩০

ব্রাউনওয়াশ তো হল। হোয়াইটওয়াশের কী হবে?

হাতে পড়ে আর আঠারো দিন। সামনে এ বার ব্রিসবেনের সবুজ পিচ, দেশের মাঠের ব্যাটিং-ভূস্বর্গ নয়। বল উঠবে এ বার হাঁটু ছাড়িয়ে, লাফিয়ে আসবে মুখের কাছে, দিতে চাইবে ‘চিন মিউজিক’-এর চুমু। এরাঙ্গা বা কুলশেখরার ১২৫ প্লাস পেস বোলিং আজ থেকে অতীত, এ বার হিংস্র চোখমুখে দৌড় শুরু করবেন কোনও এক মিচেল জনসন। ক্লাস টেস্টের ভাল ছাত্রের এ বার এমএসসি-র মহাপরীক্ষা।

ভারত পারবে?

দেশের মাঠে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে কি বিদেশে বরাবরের বিপর্যয়ের চিরাচরিত চিত্রনাট্য? নাকি ৪ ডিসেম্বর থেকে অস্ট্রেলীয় সাম্রাজ্যে এ বার অন্য কিছু?

গোটা সিরিজ ধরে বিরাট কোহলির ভারতীয় টিমের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে আশাবাদ না জন্মানোর কোনও কারণ নেই। ধোনির পাড়ায় আজ গর্বের ব্রাউনওয়াশের পুনরাবৃত্তি হল। বিরাশির পর আবার। কিন্তু বর্তমান সিরিজ জয়ের মাহাত্ম্য বিরাশির চেয়ে অনেক বেশি। যারা এই সিরিজে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল, তারা ওয়ান ডে বিশ্বকাপ রানার্স, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। যতই টিমে একটা মালিঙ্গা বা হেরাথ না থাকুন, মাঝপথে ফিরে যান সঙ্গকারা, যতই তাদের প্র্যাকটিস ছাড়াই এসে পড়তে হোক। ভারতের হয়েও তো কোনও মহেন্দ্র সিংহ ধোনি খেলেননি গোটা সিরিজে! শুধু কি তাই? ম্যাচের পর ম্যাচ ধরে নানাবিধ বদল, ইচ্ছেমতো পেসার বসিয়ে দেওয়া, নিয়মিত ওপেনারকে বিশ্রামে পাঠানো, রায়ডুর মতো কাউকে দিয়ে বল করানো, আনকোরা স্পিনার খেলিয়ে দেওয়া, সবই তো একে একে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে দেখিয়েছে টিম ইন্ডিয়া। একটা ব্যাপার প্রথম থেকেই শুধু অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে জয়।

তাই রবিবাসরীয় জয়ে শুধু ৫-০ হল না। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ৫-০-র চেয়ে অনেক বেশি কিছু হল। পাঁচটা জিনিস পাওয়া গেল যা এই সিরিজ থেকে প্রাপ্তি তো বটেই, অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে যা টিম ইন্ডিয়ার স্বস্তির কারণও বটে।

প্রাপ্তি এক: নিঃসন্দেহে ক্যাপ্টেন কোহলি। এশিয়া কাপ-উত্তর বিরাট কোহলিকে নিয়ে ক্রিকেটমহলে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটা আকর্ষণীয়, অধিনায়ক হিসেবে ততটা নন। অধুনা শ্রীলঙ্কা সিরিজের পর যা বদলাতে বাধ্য। কারণ এই সিরিজে ব্যাটসম্যান কোহলির চেয়ে বেশি ঝকঝকে দেখিয়েছে ক্যাপ্টেন কোহলিকে। পাওয়ারপ্লে-র সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন। অক্ষর পটেল নামক স্পিনার খেলাতে গিয়ে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো স্পিনারকে বসাতে দু’বার ভাবেননি। অম্বাতি রায়ডুযাঁকে বেশির ভাগ লোকে মিডল অর্ডার ব্যাট হিসেবেই চেনে, তাঁকে তিনে তুলে এনেছেন এবং ম্যাচ বের করেছেন। রবিবারের কোহলি বোধহয় নিজের ক্যাপ্টেন্সির বৃত্তটা সম্পূর্ণ করলেন। ২৮৬ তাড়া করতে নেমে দুই ওপেনারই প্রথম পাঁচ ওভারে ড্রেসিংরুমে। টিম কম্বিনেশন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে সুরেশ রায়নার মতো ওয়ান ডে মহীরূহকেও এ দিন রাখা হয়নি। শ্রীলঙ্কা চেপেও ধরেছিল। সেখানে কী অবিশ্বাস্য একটা ইনিংস খেলে গেলেন কোহলি। অফ এবং অন, দু’দিকেই সেই পুরনো স্ট্রোক প্লে-র ঝলক। হেলিকপ্টার শট থেকে অফের উপর দিয়ে ছয় কিছু বাদ গেল না। ১৩৯ বিরাটের মতো এ দিন প্রতিপক্ষ ক্যাপ্টেন ম্যাথেউজও করেছেন। কিন্তু ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স দিনের শেষে সেটা আর হয়নি।

রাঁচির সেঞ্চুরি তাই শুধু বিরাটকে ফর্মেই ফেরাল না, তাঁর ক্যাপ্টেন্সিকেও উচ্চমার্গে তুলে দিল। ‘ক্যাপ্টেন্স নক’ বস্তুটা ঠিক কী, আজ দেখিয়ে দিলেন কোহলি। ওয়ান ডে ক্রিকেটে ২১তম সেঞ্চুরিটা করলেন মাত্র ১৩৮ আন্তর্জাতিক ম্যাচে। সচিন তেন্ডুলকরের যা করতে দু’শো ওয়ান ডে লেগেছিল। অথচ সতীর্থদের সাহায্য থেকে শুরু করে পিচ, কোনও কিছু আজ কোহলির পক্ষে ছিল না। রায়ডু ছাড়া কেউ নির্ভরতা দেননি ভারত অধিনায়ককে। আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভাষায় ‘জেকিল অ্যান্ড হাইড’ পিচ নিয়মিত ভাবে অনিয়মিত। বল এতটাই নিচু হয়েছে মাঝেমধ্যে যে, ছোটখাটো চেহারার রাহানেও প্রায় বসে পড়ে বোল্ড হওয়া আটকাতে পারেননি। কোহলির আজকের ইনিংস তাই বিরাটোচিত নয়, বীরগাথা।

প্রাপ্তি দুই: এক নয়, দুই নয়, তিন-তিন জন ওপেনার, অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে যাঁরা দুর্দান্ত ফর্মে। রাহানে, শিখর, রোহিতের মধ্যে শেষের দুই সব ম্যাচ খেলেননি। কিন্তু তার পরেও প্রত্যেকের একটা করে সেঞ্চুরি আছে। ভারত গোটা সিরিজে ১৫৭৫ রান তুলেছে, যার মধ্যে ওপেনাররাই করে গিয়েছেন ৭৩৬। ক্যাপ্টেনের স্বস্তি আর জাতীয় নির্বাচকদের অস্বস্তির জন্য এই পরিসংখ্যানটাই যথেষ্ট!

প্রাপ্তি তিন: স্পিন-ব্যাঙ্ক। আর যার ভল্টে সেরা অলঙ্কার অবশ্যই বাঁ-হাতি অক্ষর পটেল। যাঁকে দেখে মনে হচ্ছেই না যে, এটা আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শুরু। বোলিংয়ের সময় খুব বেশি বৈচিত্রের দিকে যান না। উইকেট-টু-উইকেট রেখে কাজের কাজটা করে দেন। গুজরাতজাত-র বোলিংয়ের সেরা নিদর্শন এ দিন চন্ডিমলের উইকেট। দুটো বলে চন্ডিমল বিট, তিন নম্বরটা মিসটাইম্‌ড আর সোজা রোহিতের হাতে। এ দিন ৪৫ দিয়ে দু’উইকেট নিলেন অক্ষর। পাকিস্তানের জুলফিকর বাবরের সামনে যে অস্ট্রেলিয়া নাকানিচোবানি খায়, সেই টিমের বিরুদ্ধে অক্ষরকে রাখা উচিত। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। চিন্তা শুধু কর্ণ শর্মাকে নিয়ে। দুটো ম্যাচ পেলেন লেগস্পিনার, কিন্তু কোনও প্রভাব ফেলতে পারলেন না।

প্রাপ্তি চার: পেস ব্যাটারি। দিন কয়েক পর অস্ট্রেলিয়ার বিমানে যে টিম ইন্ডিয়া উঠবে, তাতে এমন দু’জন থাকবেন যাঁরা দেড়শোর কাছাকাছি বল করতে পারেন। বরুণ অ্যারন আর উমেশ যাদব। উমেশের এই সিরিজে দশ উইকেট। প্রতিটা ম্যাচে উন্নতি করেছেন, বোলিং এখন অনেক নিয়ন্ত্রিত। প্রথম ম্যাচের কয়েকটা ওভার বাদে বরুণ খেলেননি, কিন্তু তাঁর একটা ডেলিভারি আবার ১৫২ ছুঁয়েছিল। চলতি সিরিজ ৩-০ হয়ে যাওয়ার পর বিরাট তো ইডেনে এসে বলেও ছিলেন, একসঙ্গে দুই পেসারের দেড়শোর আশেপাশে থাকাটা ভারতীয় টিমে যেন নতুন সূর্যোদয়।

প্রাপ্তি পাঁচ: রিজার্ভ বেঞ্চ। রাঁচি ম্যাচের আগে টিমের সহকারি কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার বলছিলেন রোটেশন নীতির কথা। বলেছিলেন, এই সিরিজে সেটা কতটা সফল। ২০১৫ বিশ্বকাপে যে সম্ভাব্য তিরিশের স্কোয়াড হতে পারে, তার প্রায় সব নামই এর মধ্যে পরীক্ষিত। যেমন ধবল কুলকার্নি। যেমন অম্বাতি রায়ডু (শুধু রানিং বিটউইন দ্য উইকেটস ভোগাচ্ছে)। যেমন রবিন উথাপ্পা। যেমন শেষ ম্যাচে রায়নার জায়গায় নামা কেদার যাদব। টিম কম্বিনেশন নিয়েও চলেছে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট। রাঁচিতে যেমন ভারতীয় বোলিংয়ে তিন স্পিনার এবং দুই সিমার, যার মধ্যে এক জনের নাম স্টুয়ার্ট বিনি। যা দেখে কারও কারও মনে পড়ে যেতে পারে, নব্বইয়ের দশকের ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট। যখন শ্রীনাথ ছাড়া টিমের আর এক পেসার ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আজ মাঠে এলে খুশি হতেন। ভারত তো আজ মাঠে ছিল না, ছিল ভারত ‘এ’। টিমের মিডল অর্ডারে কোনও অভিজ্ঞ নাম নেই, কোনও ফাস্ট বোলার নেই, তবু দিব্যি ব্রাউনওয়াশ হয়ে গেল। ম্যাচে নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, প্রাথমিক ধাক্কা সামলে সিরিজে এই প্রথম শ্রীলঙ্কা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখিয়েছে, ভারত সেটা তাড়া করতে গিয়ে চাপে পড়েছে। হারতেও পারে, এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরাট-বিক্রমে শেষ ম্যাচেও শ্রীলঙ্কাকে ‘লাভ গেম’ দিয়ে ভারত মহাসাগরে ফেলা গিয়েছে। হেলিকপ্টার-টাও তো মেন্ডিসের বলে শেষে বেরোল। বিরাট যেটা মেরে লঙ্কার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ফেললেন। যা থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোয়েব আখতার বলে গেলেন, “ক্যয়া চিজ হ্যায় ইয়ার ইয়ে ইন্ডিয়া টিম! কোনও দিন ধবন মারছে। কোনও দিন রোহিত। আর এই বিরাট? ওফ্, ম্যাচ উইনিং ক্যাপ্টেন!”

এমএসডি-র চুলে পাক ধরা এখনও বন্ধ না হলে আর কবে হবে?

সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা ৫০ ওভারে ২৮৬-৮ (ম্যাথেউজ ১৩৯, থিরিমানে ৫২, কুলকার্নি ৩-৫৭, অক্ষর ২-৪৫)।
ভারত ৪৮.৪ ওভারে ২৮৮-৭ (কোহলি ১৩৯ ন.আ., রায়ডু ৫৯, মেন্ডিস ৪-৭৩)

ইতিহাসে ক্লিন সুইপ

• ২০১৪: বনাম শ্রীলঙ্কা, ৫-০।

• ২০১০-’১১: বনাম নিউজিল্যান্ড, ৫-০।

• ২০০৮-’০৯: বনাম ইংল্যান্ড, ৫-০ (দু’টো ম্যাচ বাতিল)

• ১৯৮৮-’৮৯: বনাম নিউজিল্যান্ড, ৪-০ (একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত)

• ১৯৮২-’৮৩: বনাম শ্রীলঙ্কা, ৩-০।

• ১৯৮৩-’৮৪: বনাম পাকিস্তান, ২-০।

sri lanka series priodarshini rakshit MS Dhoni Virat Kohli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy