Advertisement
০২ মে ২০২৪

শেষ ওভারে ম্যাচ জিতে ভারতের বিরাট বিজয় নাগপুরে

মঙ্গলবার নাগপুরে শাপমুক্তি ঘটল বিজয় শঙ্করের। একটা প্রায় অবিশ্বাস্য শেষ ওভার করে ম্যাচ জিতিয়ে দিলেন ভারতকে।

রাজসিক: ৪০তম ওয়ান ডে সেঞ্চুরির পরে হেলমেটে চুম্বন অধিনায়ক বিরাট কোহালির। মঙ্গলবার নাগপুরে। ছবি: এপি।

রাজসিক: ৪০তম ওয়ান ডে সেঞ্চুরির পরে হেলমেটে চুম্বন অধিনায়ক বিরাট কোহালির। মঙ্গলবার নাগপুরে। ছবি: এপি।

কৌশিক দাশ
নাগপুর শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৫:২৮
Share: Save:

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালের পরে দেশে ফিরে বেশ কয়েক দিন ঘুমোতে পারেননি তিনি। ভারত চ্যাম্পিয়ন হলেও সেই মন্থর ইনিংসের (১৯ বলে ১৭) জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় মারাত্মক ভাবে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।

মঙ্গলবার নাগপুরে শাপমুক্তি ঘটল বিজয় শঙ্করের। একটা প্রায় অবিশ্বাস্য শেষ ওভার করে ম্যাচ জিতিয়ে দিলেন ভারতকে। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের টিকিটটাও সম্ভবত হাতে পেয়ে গেলেন তামিলনাড়ুর এই ক্রিকেটার।

জয়র জন্য শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ১১, ব্যাট করছেন জমে যাওয়া মার্কাস স্টোয়নিস। কোহালি বল তুলে দিলেন বিজয়ের হাতে। যিনি অস্ট্রেলীয় ইনিংসের দশ নম্বর ওভার করতে এসে ১৩ রান দেওয়ার পরে আর বল পাননি। যাঁকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ ক্রিকেটারেরা বারবার বলছেন, বোলিংটা একে দিয়ে হবে না।

তৃপ্ত: দলকে জয় উপহার দিয়ে উচ্ছ্বাস বিজয়ের। মঙ্গলবার নাগপুরে। ছবি: এপি।

জ়াম্পার স্টাম্পটা ছিটকে যাওয়া মাত্রই দু’হাত শূন্যে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিজয়। হয়তো বা বলতে চাইলেন, দেখো, আমিও পারি। প্রথম বলে স্টোয়নিস আর তৃতীয় বলে জ়াম্পা। ভারতের জয় আট রানে। কে ভেবেছিল, ক্রিকেট রূপকথা এ ভাবে লেখা হবে?

আরও পড়ুন: বিরাট না বিজয় নায়ক কে? দেখে নিন ভারতের জয়ের প্রধান কারণ

নিদাহাস ট্রফির পরে একটা শিক্ষা পেয়েছিলেন বিজয়। ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, এর পরে আর কোনও দিন দেখব না, কে কী বলছে। শুধু নিজের কাজটা করে যাব। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিজয় যথেষ্ট বিত্তশালী পরিবারের ছেলে। ছেলের জন্য ছাদেই কৃত্রিম পিচ বানিয়ে নেট টাঙিয়ে দিয়েছেন তাঁর বাবা। রয়েছে বোলিং মেশিন-সহ বাকি সব সরঞ্জাম। নিজেকে সেখানে এক মনে তৈরি করেছেন বিজয়। বহির্জগত থেকে দূরে।

যে বহির্জগত এক দিন তাঁকে বিদ্রুপ করেছিল, সে জগতই আজ দু’হাত বাড়িয়ে আপন করে নিল ছেলেটাকে।

বিরাট কোহালিও নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবেন বিজয়ের এই প্রত্যাবর্তনে। অধিনায়ক যে নিজেই ময়দানে নেমে পড়েছেন এই তরুণ অলরাউন্ডারকে গড়েপিটে নিতে। জামতার দর্শকরা এ দিন আরও দেখলেন অধিনায়ক কোহালি, ব্যাটসম্যান কোহালি আর গুরু কোহালির ত্রিবেণী সঙ্গম। তিন সত্তার কে কাকে টেক্কা দিয়ে গেল, বলা একটু কঠিন।

স্কোরবোর্ড অবশ্য বলবে, ব্যাটসম্যান কোহালির মাথাতেই মুকুটটা সব চেয়ে বেশি মানাবে। এ দিন ওয়ান ডে ক্রিকেটে ৪০তম সেঞ্চুরি করে সচিন তেন্ডুলকরের আরও কাছে চলে এলেন কোহালি। মাস্টার ব্লাস্টারকে ছুঁতে বাকি রইল আর ন’টি সেঞ্চুরি। এমন একটা ইনিংস খেললেন, যেখানে ‘আমি বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান’— এই শৌর্যবোধকে দূরে সরিয়ে নিজেকে নিয়ে এলেন মাটির কাছাকাছি। পিচের অবস্থা দেখে ব্যাটিংয়ে ধ্বংসের প্রতীক হয়ে নয়, মন দিলেন সৃষ্টির কাজে।

যে ইনিংসের শুরুতে অবশ্য অ্যাডাম জ়াম্পার ‘স্লাইডার’কে ঠান্ডা করে দিলেন গোটা কয়েক কভার আর অন ড্রাইভে। কিন্তু কখনও শাসন করতে যাননি। তুলে মারতেও না। কোহালি ১২০ বলে ১১৬ করলেন, মারলেন দশটি চার। তাঁর ইনিংসের পঞ্চাশের বেশি রান এসেছে সিঙ্গলসে। ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দেবে, নাগপুরের বিদর্ভ ক্রিকেট সংস্থার মাঠে কতটা বিশাল হয়ে উঠেছিল কোহালির ছায়া। ভারতের ওপেনিং জুটিতে উঠল শূন্য রান। এর পরে কোহালি যত ক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, তাঁকে ঘিরে এল ২৪৮। তিনি ফিরে যাওয়ার পরে ভারত আর দু’রান যোগ করে শেষ!

কিন্তু এত সব সত্ত্বেও মনে হচ্ছে, টিভি ক্যামেরার আড়ালে ‘গুরু কোহালি’র যে সত্তাটা এ দিন ফুটে উঠল, তা যেন তাঁর বাইশ গজের বীরগাথাকেও কোথাও পিছনে ফেলে দিচ্ছে। আগের দিনই বিজয় শঙ্করকে নিয়ে পড়েছিলেন নেট প্র্যাক্টিসের সময়। পাখিপড়ার মতো করে বুঝিয়েছিলেন, তাঁর থেকে কী ধরনের খেলা চাইছেন। এ দিন অম্বাতি রায়ডু আউট হওয়ার পরেই যখন গ্যালারি জুড়ে ‘ধোনি, ধোনি’ চিৎকার শুরু হয়েছে, সবাইকে অবাক করে নামতে দেখা গেল বিজয়কে। আর কোহালি এগিয়ে এসে পিঠটা চাপড়ে দিলেন শিষ্যের।

সেই শুরু। এর পরে দু’জনের জুটি (৭১ বলে ৮১) যত এগিয়েছে, কোহালি তত পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন তামিলনাড়ুর তরুণ ক্রিকেটারের কাছে। বিজয়ের মারা একটা বিশাল শট যখন বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে পড়ছে, হাত মুঠো করে ঝাঁকাতে দেখা গেল অধিনায়ককে। এ তো একেবারেই নিখাদ সেই গুরুর প্রতিক্রিয়া, যিনি তাঁর ছাত্রের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হন সব চেয়ে বেশি। আর ছাত্রের পতনে কষ্টও পান সে রকমই। বিশেষ করে সেই পতনের পিছনে যদি থাকে স্বয়ং গুরুর হাত! জ়াম্পাকে মারা কোহালির স্ট্রেট ড্রাইভটা যখন বোলারের হাত ছুঁয়ে উইকেটে লাগছে, বিজয় এক চুলের জন্য নন স্ট্রাইকার এন্ডের ক্রিজের বাইরে। হতাশায় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, ক্যামেরা ক্লোজ আপে ধরল কোহালির মুখটা। সে মুখে যন্ত্রণা আর হতাশার এক অদ্ভুত মিশেল।

অধিনায়ক কোহালি অবশ্য আগ্রাসী মেজাজেই দেখা দিয়েছেন। উসমান খোয়াজার ক্যাচ নিয়ে হুঙ্কার দিয়েছেন, হাত মুঠো করে ঝাঁকিয়েছেন। একই ভাবে গর্জন করেছেন জাডেজার একটা দুর্দান্ত থ্রোয়ে পিটার হ্যান্ডসকম্ব রান আউট হতে।

ওয়ান ডে সিরিজে ভারত এগিয়ে গেল ২-০। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার (৫৫৮) পরে ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয় দল হিসেবে ওয়ান ডে ম্যাচে ৫০০ জয়ও হয়ে গেল ভারতের। কিন্তু আরও বড় একটা প্রাপ্তিযোগ হল দলের। ব্যাটসম্যান বিজয় দেখালেন, চার নম্বর জায়গায় রায়ডুর বদলে তাঁর কথা ভাবা যেতে পারে। আর বোলার বিজয় বোঝালেন, সময় পেলে তিনি আরও পরিণত হয়ে উঠবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE