Advertisement
০২ মে ২০২৪

সঙ্গার বিদায়ী বিষণ্ণতার চাঁদোয়ার নীচে আরও মেঘলা ভারত

ডন ব্র্যাডম্যান এশিয়ার একমাত্র যে মাঠে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানেই ক্রিকেটকে শেষ বিদায় জানাবেন কুমার সঙ্গকারা। অসাধারণ একটা যুগলবন্দি তৈরি হয়ে যায় যদি এই টেস্টে একটা ডাবল সেঞ্চুরি করে ব্র্যাডম্যানের ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডে যুগ্ম ভাগীদার হয়ে যান সঙ্গা। রাত্তিরে কলম্বোর ডাউনটাউনে নিজের সুসজ্জিত বাড়িতে বসে রয় ডায়াস বলছিলেন, ‘‘ব্যাপারটা হলে দারুণ হয়। তখন বলা যাবে ওদের ডন, আমাদের সঙ্গা।’’

টিম ডিরেক্টরের জোব্বা ছেড়ে রবি শাস্ত্রী কোচিংয়ের মেজাজে। ছবি: দেবাশিস সেন

টিম ডিরেক্টরের জোব্বা ছেড়ে রবি শাস্ত্রী কোচিংয়ের মেজাজে। ছবি: দেবাশিস সেন

গৌতম ভট্টাচার্য
কলম্বো শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

ডন ব্র্যাডম্যান এশিয়ার একমাত্র যে মাঠে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানেই ক্রিকেটকে শেষ বিদায় জানাবেন কুমার সঙ্গকারা। অসাধারণ একটা যুগলবন্দি তৈরি হয়ে যায় যদি এই টেস্টে একটা ডাবল সেঞ্চুরি করে ব্র্যাডম্যানের ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডে যুগ্ম ভাগীদার হয়ে যান সঙ্গা। রাত্তিরে কলম্বোর ডাউনটাউনে নিজের সুসজ্জিত বাড়িতে বসে রয় ডায়াস বলছিলেন, ‘‘ব্যাপারটা হলে দারুণ হয়। তখন বলা যাবে ওদের ডন, আমাদের সঙ্গা।’’ শুধু ডায়াস নন, অনেকেরই মনে হচ্ছে এমন ঐশ্বরিক কীর্তি ঘটার জন্য কলম্বোর পি সারা ওভালই প্রকৃষ্ট।
স্থানীয় ক্রিকেটমহলে ওই পি সারা-টারা কেউ বলে না। ওভাল নামেই পরিচিত। মাঠের সৌন্দর্য বিচারে লন্ডনের ওভালের মতো। বর্ণহীন, শ্রমিকশ্রেণি। লন্ডনে যেমন অনেক অভিজাত, আরও ঝলমলে হল লর্ডস। কলম্বোয় তেমনই এসএসসি। মাহেলা জয়বর্ধনের ফেয়ারওয়েল টেস্ট গত বছর প্রথমে ওভালে পড়েছিল। তিনি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ওটা সরিয়ে নিয়ে যান এসএসসিতে। যা কলম্বোর লর্ডস। অনেক সবুজ। অনেক ঝকঝকে। অনেক আধুনিক।
আর কলম্বোর ওভালে কেমন একটা পুরনো-পুরনো গন্ধ। যারা এই মাঠটা দেখে সেই তামিল ইউনিয়ন ক্লাবের প্রতিষ্ঠা মোহনবাগান জন্মানোর বছরে— ১৮৮৯। শ্রীলঙ্কার প্রাচীনতম ক্রিকেট মাঠ বলেই না কেমন একটা উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িসুলভ ব্যাপার রয়েছে মাঠটায়। বনেদি অথচ জরাজীর্ণ। যেন ইতিহাসের শুকনো পাতা এখানেই ওড়ে। এসএসসিতে নয়।
সে জন্যই কি সঙ্গকারা এ মাঠে শেষ ম্যাচ পড়ায় আপত্তি করেননি? তাঁকে দেখতে যতই আধুনিক আর ডাকাবুকো মনে হোক, ক্রিকেটীয় স্পিরিটে তিনি যত না দক্ষিণ, তার চেয়ে বেশি উত্তর কলকাতা! সঙ্গার ক্রিকেট-ক্ষত্রিয় অলঙ্কারের প্রধান বেশ যে ঐতিহ্য, তার প্রমাণ বহু বার দিয়েছেন। এমনিতে তাঁর বিদায়ী ম্যাচ ঘিরে কলম্বোয় দু’দিন আগে পর্যন্ত যা আবহ, কলকাতায় পাশের পাড়ায় শিবরাত্রি হলে তার চেয়ে বেশি কাড়া-নাকাড়া বাজে।
শুনছি কাল-পরশু কিছু বিলবোর্ড বসবে। সঙ্গার সম্মান-স্মারক, যার ছবি সোমবারের আনন্দবাজারে বার হয়েছে সেটা ফের ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ম্যাচের দিন হোমরা-চোমরা কেউ সেটার উদ্বোধন করবেন। কিন্তু সেটা আর এমন কী? তার বাইরে উৎসব কোথায়? উৎসবের বেদনাই তো কেবল পড়ে রয়েছে।

যাক, বহিরঙ্গ না থাক পি সারা ওভাল তো আছে। যেখানে মুরলীধরন তাঁর প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন। যেখানে শ্রীলঙ্কা তাদের প্রথম সরকারি টেস্ট খেলে। যেখানে ম্যাটিং উইকেটে ব্যাট করে এসে ব্র্যাডম্যান ম্যাটের দৈর্ঘ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

এটাও ময়দানে সামাদ সম্পর্কে শোনা গল্পগাথার মতো মিথ হতে পারে। শোনা যেত সামাদ সাহেবের শট পোস্টে লেগে ফিরে আসার পর উনি বলেছিলেন, হতে পারে না। পোস্ট ছোট আছে। পরে মেপে দেখা যায় সত্যিই ছোট। ব্র্যাডম্যানও নাকি ব্যাট করে যাওয়ার পর বলেছিলেন, ম্যাটটা বাইশ গজ ঠিকমতো পাতা নেই। পরে মেপে দেখা যায় উইকেট একুশ গজ রয়েছে। মাপামাপির শেষে তাঁর সেই আটচল্লিশের টিমের কেউ কেউ বলেছিলেন, জানাই কথা তো যে ডনের হিসেব ভুল হয় না।

বছর কুড়ি আগে তখন বেঁচে থাকা এক ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের কাছে ব্র্যাডম্যানের ঘটনাটা শোনা। কোথাও কোনও সত্যতা লিপিবদ্ধ যে হেতু নেই। মিথ হতেই পারে। কে বলতে পারে সঙ্গার শেষ শ্রীলঙ্কান ক্যাপ মাথায় অবতরণ নিয়েও ভবিষ্যৎ এমনই কোনও মিথ তৈরি করে দেবে না পরের সব প্রজন্মের জন্য? আবার কিছু কিছু মূর্তিমান সত্যি পরে মনে হতে পারে ধুর এ সব গল্প, মোটেও ঘটেনি!

যেমন অবসরের ম্যাচ ঘিরে সঙ্গকারার আপাত অনাগ্রহ। সচিন ঠিক যতটা সাগ্রহে তাঁকে ঘিরে বিদায়বেলার সমাদরটা আঁকড়েছেন। কেউ বাড়াবাড়ি করলেও ভেবেছেন থাক, এটাই তো শেষ। সঙ্গা যেন ততটাই নিরাসক্তির সঙ্গে গোটা ব্যাপারটা দেখছেন। এখানে অনেকের মুখে শুনছি আগামী ক’দিনে হাওয়া তৈরি হয়ে যাবে। জানি না। তবে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত বস্তুটা মিউট করাও নেই। কারণ মিউট মানে তো আওয়াজহীন ছবি। এখানে ছবি কোথায়? রং কোথায়?

শ্রীলঙ্কার প্রাচীনতম মাঠে টুকটাক ছবি আজ বরং যা-ও বা দেখাল, কোহলির ভারত! ফেল করা ছাত্রকে যেমন তীব্র তিরস্কারে বাবা নতুন টিচারের কাছে পড়তে পাঠান আর সেই ধমকধামক বা লজ্জা যা-ই হোক, মনযোগ দিয়ে বসে পড়ে— তা-ই ছিল মঙ্গলবারের ভারত। প্র্যাকটিস দু’ঘণ্টাকে ছাপিয়ে হল তিন ঘণ্টা। রবি শাস্ত্রী এত দিন ছিলেন দূরত্ব বজায় রাখা ডিরেক্টর। সর্বনাশ সমুৎপন্নে দেখেই বোধহয় এ দিন শর্টস পরে নেমে পড়লেন। আর ডিরেক্টর-টিরেক্টরের নিরাপদ দূরত্ব নয়, মোটিভেটরও নয়। শাস্ত্রীকে দেখে মনে হল, বাকি সিরিজটা নিরবচ্ছিন্ন কোচিং করবেন।


জীবনের শেষ পারফরম্যান্স-মঞ্চ মেপে নিচ্ছেন সঙ্গকারা। ছবি: এএফপি

শাস্ত্রী গতকাল বলছিলেন, ‘‘ব্যাটিংয়ের আসল রোগ হল, পজিটিভ মনোভাব নেই। ওটা ভেঙে মাথায় ঢোকাতে হবে।’’ সঞ্জয় মঞ্জরেকর এ দিন টুইট করেছেন, ‘ওহে রবি, ভুল ওষুধ নিয়ে রোগ সারাতে বসেছ। আসল সমস্যা মনোভাব নয়, স্কিলে।’ মনে হল না শাস্ত্রী তাঁর কথা জানেন বলে। আর সকাল সকাল নিজস্ব মডেলেই রোগ সারাতে নেমে পড়লেন। প্র্যাকটিসে আসামাত্র পুরো ব্যাটিং গ্রুপটাকে ডেকে নিলেন শাস্ত্রী আর ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার। দীর্ঘ আলোচনা চলল কী ভাবে চাপের মুখে স্পিনারদের বিরুদ্ধে রান বানানো হবে। আলোচনায় থাকলেন এবং নেটে অনেকক্ষণ ব্যাট করলেন মুরলী বিজয়। এ দিন যা মনে হল শতাব্দী প্রাচীন মাঠে হয়তো লোকেশ রাহুল আর চেতেশ্বর পূজারার মতো লজ্জাকর ওপেনিং কম্বিনেশনকে হেঁটে যেতে দেখা যাবে না।

ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা পরপর একটা নেট থেকে আর একটা নেটে গেলেন। পুরো ট্রেনিংটাই হল চাপের মধ্যে স্পিনার খেলা। যাতে গল ফেরত না আসে। সুইপ মারানো হল। স্থানীয় ন্যাটা স্পিনার ধরে আনা হয়েছিল। একে নেটে সবাই রঙ্গনা হেরাথের ডামি হিসেবে ব্যবহার করে অনুশীলন করলেন।

এতকাল বিদেশিরা নেটে ভারতীয় স্পিনারের ডামি খুঁজে তাদের নিয়ে অনুশীলন করত। এ বার ভারত নাকি তাদের নকল করছে। এটাও তো ভয়ঙ্কর সত্যি কিন্তু পরে গিয়ে হয়তো লোকে বিশ্বাস করবে না।

বাড়াবাড়ি নেই, জৌলুস নেই, ঠিক কথা। কিন্তু সঙ্গার বিদায়ী অনুষ্ঠানকেন্দ্র এর চেয়ে বেশি ঘটনাবহুলও আর কোথাও হত না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE