Advertisement
E-Paper

আবেগের ইঞ্জিন আর শেষ সীমানা দেওয়াল

অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন মাঠের পাশের রাস্তা। সাক্ষাৎকারে ইয়ান চ্যাপেল স্বভাবসুলভ ঠোঁটকাটা ভঙ্গিতে বলছেন, বাংলাদেশের এটা তাঁর ভাল লাগেনি, ওটা খারাপ।

মোস্তফা মামুন l

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৯

অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন মাঠের পাশের রাস্তা। সাক্ষাৎকারে ইয়ান চ্যাপেল স্বভাবসুলভ ঠোঁটকাটা ভঙ্গিতে বলছেন, বাংলাদেশের এটা তাঁর ভাল লাগেনি, ওটা খারাপ।

২০০৪ সালের সেই অস্ট্রেলিয়া সফরে আড়াই দিনে টেস্ট হেরে গিয়েছে বাংলাদেশ, চ্যাপেল ভ্রাতৃত্রয়ের বড় জনের তাই খুব সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। ‘‘তা হলে কি বাংলাদেশকে নিয়ে খুব আশার কিছু সত্যিই দেখেন না?’’

প্রশ্নটা করার সময় মুখে বোধহয় একটা গভীর আশাভঙ্গের ছাপ ফুটে উঠেছিল। ইয়ান চ্যাপেল এ বার দাঁড়ালেন। একটু ভেবে বললেন, ‘‘ক্রিকেট নিয়ে ওখানে আগ্রহটা অনেক। তোমাদের ভবিষ্যৎ ভাল।’’

ইয়ান চ্যাপেল একা নন। তখন বিদেশি বিখ্যাত ক্রিকেটার বা বিশেষজ্ঞ যে-ই আসতেন, আমরা তাঁদের পিছু নিতাম। আর তাঁরা প্রত্যেকেই সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়ার মতো করে বলতেন, ‘‘তোমাদের ভবিষ্যৎ ভাল।’’

দাওয়াত খেতে এসে রান্না ভাল বলাটা নিয়ম। মনে হত অতিথিরা সেই নিয়মটাই মানছেন। নইলে ‘ভবিষ্যৎ ভাল’ এমন লক্ষণ তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মাঠে লজ্জাজনক হার হচ্ছে একের পর এক। প্রতিটা সিরিজ শেষে আমাদের সাংবাদিকদের একটা কমন লেখা ছিল ‘কী পেল বাংলাদেশ?’ সেই পাওয়ার গল্প হত মহাসাগরে নুড়ি কুড়োনোর মতো। কারও তিন উইকেট, একটা পঞ্চাশ— তাই নিয়ে বিরাট বিরাট সব কাহিনি।

আজ যখন বাংলাদেশ একটা মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে শিরোপার দরজায় দাঁড়ানো, তখন তাই মাঝে মধ্যে মনে হয়, যা দেখছি ঠিক দেখছি তো? না কি এটা বিভ্রম? সত্যি বললে পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশের কেউ ভাবতেই পারত না বাংলাদেশ তিনটে এশিয়া কাপের মধ্যে দুটোয় ফাইনাল খেলতে পারবে। আর কয়েক দিন আগেও কেউ বিশ্বাস করত না, টি-টোয়েন্টির মতো খেলায় শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ এসে দাঁড়াবে ভারত নামের সীমানা দেওয়ালের সামনে, যে দেওয়াল টপকালেই এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব।

সেই সংগ্রামের দিনগুলোর কথা শুরুতে লিখলাম এই জন্য যে, তখন বন্ধুর মমতা নিয়ে পথের সাথী ছিল যারা, তাদের মধ্যে ভারতের নামই থাকবে সবার আগে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায় জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টটাও খেলেছে তারা। তা হলে এখন কী করে ভারত বাংলাদেশের প্রধান ক্রিকেট শত্রু হয়ে দাঁড়ায়! ভারতের সঙ্গে ম্যাচ হলে পটভূমিতে আবেগ আর আগুন এমন একাকার হয়ে যায় কেন!

একটা গল্প বলি। এক বন্ধুকে জানি যিনি এমন ভারতের সমর্থক ছিলেন যে, উগ্র জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রাও তাঁকে দেখে লজ্জা পেতেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল চলছে, প্রেসবক্সের ঠিক সামনের স্ট্যান্ডে তাঁর আসন। গিয়ে দেখি ঘামছেন। বললেন, ‘‘এই ম্যাচটা জিতলে যে কী মজা হবে! তিন রাত ঘুমোব না!’’

তাঁর এই উত্তেজনা দেখে প্রেসবক্সে ফিরে নজর দিই ভারতীয় সাংবাদিকদের দিকে। তাঁরাও টেনশনে, তবে অতটা নন, যতটা আমার ভারত-সমর্থক বন্ধু। সেই বন্ধু আজও ভারতের খেলা দেখেন। তবে এখন লক্ষ্য থাকে অন্য। যে কোনও মূল্যে ভারতকে হারানো। প্রথম যে দিন তাঁর মতবদলটা দেখেছিলাম, সে দিন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ঘটনা কী? তুমি ভারতের বিপক্ষে?’’

‘‘আরে ভারত তো খেলে না। ওদের খেলানো হয়। যাদের হয়ে অন্যরা খেলে, তাদেরকে সমর্থন করব কেন?’’

‘‘অন্যরা খেলে মানে...’’

‘‘আইসিসি-স্টার স্পোর্টস সব।’’

আর কথা বাড়ানোর যুক্তি দেখিনি কারণ অত দিনে জানি বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতায় এগুলো খুব জনপ্রিয় অঙ্ক। বাজারের নিয়ম মেনে আইসিসি বা ক্রিকেট নেতৃত্ব ভারতকে জি হুজুর করে, ভারতও শক্তি দেখায় নানা ভাবে আর এতে বাংলাদেশের কাছে ভারত হয়ে গিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকতার অন্য নাম। আর প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রবল ভারত-বিরোধী হাওয়া।

এটা যদি এক নম্বর কারণ হয় তবে দ্বিতীয় কারণ হল ভারত বড় বাজার বলে এবং ভারতের মিডিয়া অনেক বড় বলে ভারতকে হারালে প্রচার-স্বীকৃতি সব পাওয়া যায় অনেক বেশি। এ ভাবেই ভারতের সঙ্গে ভাল করার আর একটা তাগিদ যোগ হয়ে যায়। ভারত হয়ে দাঁড়ায় ক্রিকেটীয় কীর্তি প্রতিষ্ঠার শেষ সীমানা দেওয়াল।

এর সঙ্গে অন্য রাজনীতি, বড় প্রতিবেশী-ছোট প্রতিবেশীর অঙ্ক আছে, যা লিখেছি এই পত্রিকাতেই আগের লেখায়। আর এ সব মিলিয়ে সর্বাত্মক বিরোধিতার হাওয়া এমন বইতে থাকে যে, বাংলাদেশের দিক থেকে যেন এটা খেলা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। বৈরিতার চূড়ান্ত চেহারা। আর সেটা যদি হয় ফাইনাল তা হলে যে কী ছবি হতে পারে, সেটা গত তিন দিনে আঁচ করতে গিয়ে শিহরিত হচ্ছি এবং শিউরেও উঠছি।

ভারত ফেভারিট, প্রশ্ন নেই। বিরাট কোহলির ব্যাট এই টুর্নামেন্টে এমন এক প্রাচীর যাকে ভেদ করতে হলে জাদুবিদ্যে জানতে হয়। তাদের সাম্প্রতিক টি-টোয়েন্টি ফর্মও দুর্দান্ত। কিন্তু এই মীরপুরে ভারত এমন একটা সমস্যায় পড়ে যেটা পৃথিবীর কোথাও হয় না। দুনিয়ার সব জায়গায় ভারতীয়রা সংখ্যায় প্রচুর, সিডনি-লর্ডস যে মাঠেই খেলা হোক সংখ্যায় স্থানীয়দের চেয়ে ওরাই বেশি থাকে। প্রায় সব ভেন্যুতেই ভারতের হোম অ্যাডভান্টেজ। বাংলাদেশ আর ঢাকাই একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে ভারত দেখে তাদের বিরুদ্ধেই বেশি লোক। আর সেই জনস্রোত সারাক্ষণ ফুটতে থাকে আগুনে স্লোগানের কোরাস তুলে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টিতে দুর্বলতা দলের ব্যাটিং। কিন্তু এই টুর্নামেন্টটা হচ্ছে বোলিংয়ের। ১৭০-১৮০-র ম্যাচ হলে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের জন্য একটু মুশকিল। কিন্তু ১৩০-১৪০-এর ম্যাচে সেই সমস্যা নেই। ভারতের পাল্লা কাগজে তাই যতই ভারী দেখাক, অঙ্ক ওল্টানো খুবই সম্ভব।

আর এ সব ক্রিকেটীয় অঙ্ক বাদ দিয়েও যে একটা ক্রিকেট ব্যাকরণ আছে বাংলাদেশের! যে ব্যাকরণে হৃদয়-বৃত্তান্ত আগে, ব্যাট-বলের ঠোকাঠুকি পরে। বাংলাদেশের ক্রিকেট গাড়ির জ্বালানিটা হয়তো তার খেলোয়াড়ি শক্তি। কিন্তু ইঞ্জিনটা তৈরি হয় মানুষের ভালবাসায়। আবেগে।

যন্ত্রের ইঞ্জিন নিয়ম মেনে চলে। আবেগের ইঞ্জিন সেই নিয়মটা ভাঙে। পথ থাকা লাগে না, সে-ই পথ তৈরি করে।

আবেগের এই ইঞ্জিনের সামনে ভারত নামের দুর্ধর্ষ দেওয়ালকে যে কখনও কখনও কাগজের দেওয়াল মনে হচ্ছে, সেটা কি শুধুই দেখার ভুল!

(লেখক উপ সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ)

dhaka t20 MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy