সাত মাসে কত কিছু পাল্টে যায়।
সাত মাস আগে পর্তুগিজ ছিলেন সুখের সপ্তম স্বর্গে। প্রিমিয়ার লিগ দিয়েছেন চেলসিকে, ‘স্পেশ্যাল ওয়ান’-এর হীরক ঝলকানিতে তখন চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্বের। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর হয়। সাত মাস আগে যিনি ছিলেন রাজা, সাত মাস পর তিনি ফকির। সাত মাস আগে তিনি ছিলেন ক্লাব ফুটবলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ কোচ, সাত মাস পর তাঁর চাকরিই নেই।
জোসে মোরিনহো বৃহস্পতিবারের পর আর চেলসিতে নেই। ক্লাবকে প্রিমিয়ার লিগ দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই চাকরি গেল চেলসি কোচের।
লিগে চেলসির বর্তমান অবস্থা যা, ভয়াবহ। ষোলো ম্যাচের মধ্যে ন’টা হেরে অবনমন সীমান্ত থেকে মাত্র এক পয়েন্ট উপরে আছে টিম। কোচের চাকরি যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ঘটনা হল, চেলসি মালিক রোমান আব্রামোভিচ কোচ-ছাঁটাইয়ে সিদ্ধহস্ত হলেও তিনি নাকি চাননি মোরিনহোকে বিদায় দিতে। বরং চেয়েছিলেন, মোরিনহো গত বারের চ্যাম্পিয়নের মঞ্চের উপর এ বারের পারফরম্যান্সের জমি তৈরি করুন। টিম খারাপ করছিল, তবু তিনি নাকি ধৈর্য ধরেছিলেন। আসলে পর্তুগিজ কোচের সঙ্গে বছরে প্রায় তেরো মিলিয়ন পাউন্ডের বিশাল চুক্তি করে ফেলেছিলেন চার বছরের জন্য। কিন্তু দিনের পর দিন অবস্থার এত অবনতি হচ্ছিল যে, চেলসি মালিক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। মোরিনহোর কফিনে শেষ পেরেক পড়ে গত সোমবার রাতে। টিম যখন লেস্টার সিটির কাছে ১-২ হারে এবং তার পর চেলসি কোচ বিস্ফোরণ ঘটান, প্লেয়াররা তাঁর সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করছে বলে দিয়ে। বলে দেন, তাঁর কথা কেউ শুনছে না। যা করতে বলছেন, কেউ করছে না।
যার পর মোটামুটি ঠিক হয়ে যায় চেলসি কোচের ভবিতব্য কী হতে চলেছে। চেলসি এ দিন নিজেদের বিবৃতিতে বলে দেয়, ‘আজকের পর চেলসির সঙ্গে জোসে মোরিনহোর আর কোনও সম্পর্ক থাকল না। দু’পক্ষের সম্মতিতেই এটা হয়েছে। ২০১৩-য় চেলসিতে ফেরার পর জোসে যা যা করেছেন ক্লাবের জন্য, তার জন্য ওঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ আরও বলা হয়, ‘আমাদের ক্লাবের একশো দশ বছরের ইতিহাসে উনিই সবচেয়ে বেশি সাফল্য দিয়েছেন। তিনটে প্রিমিয়ার লিগ খেতাব, এফএ কাপ, কমিউনিটি শিল্ড, চেলসিকে উনি কম কিছু দেননি। কিন্তু চেলসি বোর্ড মনে করে, এ বছরের পারফরম্যান্স ভাল হয়নি তেমন। জোসে নিজেও সেটা মনে করেন। তাই দু’পক্ষেরই মনে হয়েছে এখন আলাদা হয়ে গেলে তাতে দু’পক্ষেরই ভাল। তবে ক্লাব একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চায় যে, জোসের সঙ্গে কোনও রকম ঝামেলা হয়নি। খুব ভাল ভাবে ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। উনি চেলসির কাছে বরাবর একজন সম্মাননীয়, ভালবাসার ব্যক্তিত্ব হিসেবেই থেকে যাবেন। আর ওঁর এখানে আবার ফিরে আসতেও কোনও অসুবিধে হবে না।’
শোনা যাচ্ছে, মোরিনহোর উত্তরসুরি হিসেবে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে দেখা যেতে পারে খুস হিডিঙ্ককে। ছ’বছর আগে চেলসিতে কেয়ারটেকার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন হিডিঙ্ক। মরসুমের বাকিটা হয়তো চেলসি তাঁকে দিয়েই শেষ করবে।
অ্যালান শিয়ারারের মতো প্রখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার মোরিনহো-বিদায় খুব ভাল ভাবে মেনে নিতে পারছেন না। ‘‘মানছি, চেলসির মতো আত্মসমর্পণ করতে আমি কোনও ফুটবল ক্লাবকে দেখিনি। কিন্তু তার পরেও বলব, মোরিনহোকে ছাঁটাই করার খবরে আমি শক্ড।’’ সান্ডারল্যান্ড কোচ স্যাম অলারডাইসও বলেছেন, ‘‘জোসেকে এ ভাবে বিদায় নিতে দেখে খুব খারাপ লাগছে। ও দুর্দান্ত ম্যানেজার। ও না থাকলে প্রিমিয়ার লিগেরই ক্ষতি।’’ তবে ইংরেজ মিডিয়াকুল অবশ্য মনে করে, শুধু খারাপ পারফরম্যান্স নয়। একের পর এক বিতর্ক বাঁধিয়ে নিজের জায়গা অনেক দিন থেকেই নড়বড়ে করে তুলছিলেন মোরিনহো। ক্লাবের ডাক্তারের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধিয়ে বসেন। সেই ডাক্তার পরে ক্লাব ছেড়ে চলে তো যানই, মোরিনহোর বিরুদ্ধে মামলাও এখন করতে চলেছেন। এখানেই শেষ নয়। রেফারিদের প্রতি খোলাখুলি বিষোদ্গার করে স্টেডিয়াম ব্যান খেয়েছেন। সঙ্গে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডও দিতে হয়েছে জরিমানা হিসেবে। একবারে ব্যাপারটা শেষ হয়নি। ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে রেফারির প্রতি আবার তাঁর ‘সুমিষ্ট’ শব্দখরচ এবং আবার স্টেডিয়াম ব্যান ও মোটা আর্থিক জরিমানা। বাকি ছিলেন প্লেয়াররা। শেষটায় তাঁদের সঙ্গেও লেগে গেল। এবং একই সঙ্গে শেষ হয়ে গেল চেলসিতে কোচ মোরিনহোর দ্বিতীয় ইনিংস।
মোরিনহো এ বার কোথায় যাবেন?
চেলসির দায়িত্ব কার হাতে, তা নিয়ে এ দিনের ঘোষণার পর নানাবিধ জল্পনা চললেও মোরিনহো এ বার কী করবেন, কেউ জানে না। আশ্চর্যের হল, ছাঁটাইয়ের পর বিতর্কিত পর্তুগিজ কোচ কিছু বলেনওনি। ফুটবলমহলের কেউ কেউ মনে করেন, মোরিনহো যেখানেই যান, তাঁর বহুচর্চিত ভাগ্যও সঙ্গে যাবে। যে ভাগ্যচক্রের অলিখিত নিয়ম হল, কোনও ক্লাবে গেলে প্রথম বছর তীব্র সাফল্য। কিন্তু তার পরেরটা থেকে ধীরে ধীরে গ্রাফ নামতে নামতে তৃতীয় বছরে বিদায়। কিন্তু সেটা তো তৃতীয় পৌঁছে, চেলসি-পর্বের যেখানেই যাবেন সেটা তো তাঁর হবে প্রথম মরসুম।
সেখানে তো বরাবরই তিনি ‘স্পেশ্যাল ওয়ান’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy