Advertisement
০৮ মে ২০২৪
সকালে জীবনের ময়দানে, সন্ধেয় পিচের

গুজরাত যুদ্ধের আগে নাইটদের সারা দিন

রাজারহাট, শনিবার দুপুর বারোটা... ওদের অনেকের মাথায় আজ চুল নেই, গলা থেকে কারও ঝুলছে টিউব। জীবনের নিষ্ঠুর দিকটা ওরা কেউ আজ বোঝে, কেউ এখনও বোঝে না। ওরা কেউ বারো-তেরো, কেউ বা আরও কম। ওরা সবাই ভয়াল কর্কট রোগ আক্রান্ত। ওরা আজ খুব খুশি। দুঃখের মাঝে ওদের আজ অচেনা আনন্দের দিন।

মানবিকতার মুখ, পেশাদারের মুখ। সকালে রাজারহাটে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে। সন্ধেয় ইডেনের প্র্যাকটিসে। ছবি: উৎপল সরকার এবং নিজস্ব চিত্র

মানবিকতার মুখ, পেশাদারের মুখ। সকালে রাজারহাটে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে। সন্ধেয় ইডেনের প্র্যাকটিসে। ছবি: উৎপল সরকার এবং নিজস্ব চিত্র

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

রাজারহাট, শনিবার দুপুর বারোটা...

ওদের অনেকের মাথায় আজ চুল নেই, গলা থেকে কারও ঝুলছে টিউব। জীবনের নিষ্ঠুর দিকটা ওরা কেউ আজ বোঝে, কেউ এখনও বোঝে না। ওরা কেউ বারো-তেরো, কেউ বা আরও কম। ওরা সবাই ভয়াল কর্কট রোগ আক্রান্ত।

ওরা আজ খুব খুশি। দুঃখের মাঝে ওদের আজ অচেনা আনন্দের দিন। ওরা আজ গাইছে, নাচছে। কোলে উঠে প্রিয় তারকার সঙ্গে কথা বলছে। ভুলে যাচ্ছে কর্কটের কামড়। ভুলবে না-ও বা কেন? ওই যে, খুদেদের হাত ধরে ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার’ নাচছেন যিনি, তিনি রবিন উথাপ্পা না? বছর সাতেকের সঙ্গে কেক তৈরিতে ডুবে যে দীর্ঘদেহী, তাঁকে তো ইউসুফ পাঠান বলে চেনে শহর।

নাইট সংসারের রবিনকে দেখুন। কথা শুনুন। এক ঘণ্টার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে যাঁর গলা কাঁপে, স্বরলিপিতে ব্যারিকেড তোলে আবেগ। ‘‘আমরা কী করলাম... করল তো ওরা। এই এক ঘণ্টায় এই শিশুরা আমাদের কত অনুপ্রেরণা দিল বলুন তো?’’ বলতে বলতে চুপ করে যান রবিন। কে জানে, হয়তো চোখের সামনে জীবনযন্ত্রণার খুদে প্রতিমূর্তিদের দেখে। পাঠান, ইতিমধ্যে পাঠান-পাওয়ার শব্দের জন্ম দিয়ে ফেলা ইউসুফ পাঠান, তিনিও কেমন বিহ্বল। ‘‘বডোদরায় এ রকম দেখেছি। আমরা তবু বুঝতে পারি। ওরা তো বুঝতেও পারে না কী হয়েছে...।’’

এ কোন কেকেআর? এরা কি সেই একই টিম, বাইশ গজে প্রতিপক্ষকে দয়ামায়াহীন পিষে ফেলাটাই যাদের প্রবল পছন্দের?

ইডেন গার্ডেন্স, শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা...

জটলার ভিড়টা বাড়ছে। জাক কালিসকে একটু আগে ওখানে দেখা গিয়েছে। একটু পরে সাইমন কাটিচ, ব্র্যাড হগ। সাংবাদিক সম্মেলন পর্ব মিটিয়ে যিনি এখন ও দিকে হাঁটছেন, তিনি কেকেআর অধিনায়ক। গৌতম গম্ভীর। জটলাটা যেখানে, তা আদতে সবুজ এক আয়তক্ষেত্র। ইডেন পিচ। যার উপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছেন কালিস। টিপেটুপে দেখছেন। বাকিদের কেউ কেউ তর্জনী তুলে বাঁ দিকে ইঙ্গিত করছেন। বাঁ দিকেরটা মানে কিংগস ম্যাচের পিচ। কিন্তু ব্যাপার কী? উইকেট নিয়ে আবার লাগবে নাকি?

সন্ধেয় নাইট শিবিরের একজনকে ইডেন পিচ নিয়ে বেশ গজগজ করতে শোনা গেল। ওই কর্তার বোধগম্য হচ্ছে না, ব্রেন্ডন ম্যাকালামের সামনে ব্যাটিং পিচ দেওয়ার মানে কী? ইনি মানছেন, বর্তমানের কেকেআর আর অতীতের মতো নেই। যেখানে সুনীল নারিন না চললে টিম জিতবে না। যেখানে ইডেনে ঘূর্ণি থাকাটা মাস্ট। ইনি বলছেন, এই কেকেআর ব্যাটিং ট্র্যাকেও জিততে জানে। কিন্তু তাই বলে কিংগস ম্যাচের পিচ থাকা সত্ত্বেও ব্যাটিং পিচ দেওয়া কেন? ম্যাকালাম-স্মিথ-ফিঞ্চদের হাত খোলার অযাচিত সুযোগ করে দেওয়া কেন?

এটাও বা কোন কেকেআর? সকালের ছবির সঙ্গে এদের মেলানো যায়?

যায় না। যাবে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, দু’টোই আসল কেকেআর। শনিবাসরীয় কলকাতার দু’প্রান্তে যারা দু’ভাবে আবির্ভূত হল।

সকালে তারকার জার্সি খুলে মানবিকতার পৃথিবীতে পা। সন্ধেয় পেশাদারিত্বের বর্ম পরে বিপক্ষকে এক সেন্টিমিটার জায়গা না দেওয়ার অদম্য রোখ।

এ দিন সকালে উথাপ্পা-পাঠান সহ কেকেআরের কয়েক জন রাজারহাটের এক সংস্থায় ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে ঘণ্টাদেড়েক কাটিয়ে এলেন। শহরে থাকলে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া নাইট সূচিতে নতুন নয়। কিন্তু শনিবারেরটা কোথাও গিয়ে স্বতন্ত্র কারণ, জাঁকজমকের জৌলুস না থাকলেও এখানে মানবিকতার ঐশ্বর্য ছিল। যেখানে অসুস্থ শিশুদের সঙ্গে উথাপ্পা-ইউসুফদের প্রাণখোলা মিশে যাওয়ার পরের পর দৃশ্য, বিভিন্ন উপহারে তাদের যন্ত্রণার দিনলিপিতে কিছুটা সুখের সন্ধান দিয়ে যাওয়া— এক কথায় মুগ্ধ করবে।

কিন্তু সেই মুগ্ধতার আমেজ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার সময়ও পাওয়া যাবে না। কী করে সম্ভব? নাইটরা যখন সকালে বেরোলেন, তার গায়ে-গায়ে তো গুজরাত লায়ন্স ঢুকে পড়ল শহরে। সর্বোপরি ইডেন পিচ, যা এক প্রভাবশালীর কথায়, ‘‘ম্যাকালামের মনের মতো!’’

রবিবারের পিচে ঘাস থাকছে, জানা ছিল। কিন্তু তা বলে যে এতটা সবুজ ছাড়া থাকবে, বোঝা যায়নি। শোনা গেল, কেকেআর অধিনায়ক নাকি পিচ দেখার পর সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞেস করেন, কেন গত দিনেরটা পাওয়া যাবে না? কেন ঘাসে ঢাকাটায় খেলতে হবে? পরে নাইট মহাকর্তা বেঙ্কি মাইসোরকেও দেখা যায়, ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে। কিউরেটর পরে বললেন, ‘‘অন্য কথা হচ্ছিল। তবে উনি একবার জানতে চেয়েছেন যে, ঘাস কাটা হবে কি না।’’

শোনা গেল, সেটা হবে। রবিবার সকালে হবে। কিন্তু তাতেও যা দাঁড়াবে, কেকেআরের খুব মনের মতো হবে কি না বলা মুশকিল। নাইটদের ব্যাটিং দুর্দান্ত। কিন্তু গুজরাতের ব্যাটিং তো বিস্ফোরক। টপ অর্ডারের যে কোনও দু’জনের লাগলেই সব শেষ। এক কেকেআর কর্তা বলছিলেন যে, কয়েক ঘণ্টার তফাতে দু’টো বিশ্বকাপ ফাইনাল ইডেনে হয়েছে। এক মাসে আগেই হয়েছে, একই পিচে হয়েছে। তা হলে কিংগস ম্যাচের পিচে এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটা দিতে কী অসুবিধে ছিল? কেকেআর ব্যালান্সড টিম, ঠিক। কিন্তু কিছুটা হলেও তো হোম অ্যাডভান্টেজ পাওয়া উচিত। ইডেন কিউরেটর আবার বললেন যে, পিচ তো ফ্র্যাঞ্চাইজি ঠিক করার কথা নয়। সেটা ঠিক করবে অ্যাসোসিয়েশন। ক্রিকেট সংস্থা। আরও বলা হচ্ছে যে বাইশ গজ থেকে রান হোক, চাইছে সিএবি। তাই নাকি এটা।

এ সবের মধ্যে খবর আরও একটা আছে। যে, কেকেআর প্র্যাকটিসে এক নাইট এ দিন এসেও অধিকাংশ সময় বসে ছিলেন। কয়েক ওভারের বেশি বলও করেননি। শোনা গেল, খেলার সম্ভাবনা নাকি কম। ভাবলে অবাক লাগবে, দু’বছর আগে হলে এটাই প্রিভিউয়ের সেরা খবর হত। শিরোনাম নিয়ে যেত।

সময় বড় নির্দয়। কয়েক মাস, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সে পাল্টে ফেলে শিরোনাম, বদলে ফেলে তার বিষয়বস্তু। পিচ-নাটক আর হানাহানির বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে সুনীল নারিনকে ভুলে যেতেও দু’বার ভাবে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ipl 2016 KKR
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE