Advertisement
১১ মে ২০২৪

ওয়ার্নকে হারিয়ে প্লে-অফের স্বপ্ন অটুট রাখলেন শিষ্য কুলদীপই

কয়েক দিন আগেই আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুলদীপ বলেছিলেন, সেই সময়ে বলটা করলেও তিনি জানতেন না সেটাকেই চায়নাম্যান বলে।

গুরু-শিষ্য: ম্যাচের পরে ওয়ার্নের পরামর্শ কুলদীপকে। নিজস্ব চিত্র

গুরু-শিষ্য: ম্যাচের পরে ওয়ার্নের পরামর্শ কুলদীপকে। নিজস্ব চিত্র

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০৩:৩৯
Share: Save:

শেন ওয়ার্নকে গুরুদক্ষিণা দিলেন কুলদীপ যাদব। চিরকাল গুরু হিসেবে মেনে আসা ওয়ার্নের রাজস্থান রয়্যালসকে স্পিনের জালে বন্দি করে!

মঙ্গলবারের ইডেনে ওয়ার্নের দল শুরুতে কালবৈশাখী নিয়ে এসেছিল। দুরন্ত ফর্মে থাকা জস বাটলারের দাপটে প্রথম তিন ওভারেই তারা তুলে ফেলে ৪৯-০। কেকেআরের অনূর্ধ্ব-১৯ ফাস্ট বোলার শিবম মাভির এক ওভারে বাটলার নিলেন ২৮ রান। ছয় বলের হিসেব এ রকম— ৪, ৬, ৪, ৪, ৬, ৪। এ বারের আইপিএলে এক ওভারে কারও দেওয়া সর্বোচ্চ রান।

তখন কে জানত, রাজস্থান যতটা গজরাচ্ছে ততটা বর্ষাবে না! কে জানত, চলতি আইপিএলে নিষ্প্রভ থাকা কুলদীপ যাদব তাঁর আদর্শ স্পিনারের দলের বিরুদ্ধে ম্যাচটাকেই বেছে নেবেন ছন্দে ফেরার জন্য। কুলদীপ জীবন শুরু করেছিলেন পেসার হিসেবে। স্বপ্ন ছিল ওয়াসিম আক্রমের মতো বাঁ হাতি পেসার হবেন। ছোটবেলার ক্রিকেট কোচ জোর করে স্পিনে নিয়ে এসেছিলেন। নেটে প্রথম বলটাই তিনি করেন চায়নাম্যান। বাঁ হাতি স্পিনারের যেটা লেগস্পিন।

কয়েক দিন আগেই আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুলদীপ বলেছিলেন, সেই সময়ে বলটা করলেও তিনি জানতেন না সেটাকেই চায়নাম্যান বলে। তবে অনেক চাপের মুখেও কখনও চায়নাম্যান বোলিং ছাড়েননি। এমনকী, দল থেকেও বাদ পড়তে হয়েছিল চায়নাম্যান করার জন্য। নির্বাচকেরা নাকি বলতেন, যে বলটা কেউ করেই না তাতে কী ভাবে উইকেট নেবে? ওকে দরকার নেই।

কলকাতা নাইট রাইডার্স নিশ্চয়ই কুলদীপের মনের জোরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যে, প্রবল চাপের মুখেও তিনি চায়নাম্যান বোলিং চালিয়ে গিয়েছিলেন। না হলে মঙ্গলবার নাইটদের চাপ হাল্কা করার কেউ থাকত কি না সন্দেহ। একে তো টেবলে এমন সাপ-লুডো খেলা চলছে যে, কখন কে মই বেয়ে উপরে উঠবে আর কে সাপের মুখে পড়বে বোঝার উপায় নেই। প্রত্যেক রাতেই সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। প্লে-অফ নিয়ে এমন ধস্তাধস্তি আইপিএলের এগারো বছরে দেখা যায়নি। তার উপর মরণ-বাঁচন ম্যাচে সামনে রাজস্থান রয়্যালস। যারা মুম্বইকে হারিয়ে প্লে-অফের দৌড়ে প্রবল ভাবে ফিরে এসেছিল।

আন্দ্রে রাসেল এ বারের আইপিএলে নাইটদের হয়ে সোনার হাত। শুধু ব্যাটে নয়, বলেও। ঠিক যখন উইকেট দরকার, অধিনায়কের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন। মঙ্গলবার রাতেও রাহুল ত্রিপাঠীর উইকেট নিয়ে রাজস্থান রয়্যালসের রানের গতিতে প্রথম ব্রেক কষেন তিনি। ত্রিপাঠী অবশ্য ম্যাচের প্রথম বলেই শিবম মাভির বলে ক্যাচ তুলেছিলেন স্লিপে। ধরেও তা ফেলে দেন নীতীশ রানা।

এর পরেই শুরু কুলদীপের ইন্দ্রজাল। রাহানেকে বোল্ড করলেন। তার পরের ওভারেই রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে আউট ডানহাতি বাটলার। যিনি উইকেটের পিছনে রান তুলতে ভালবাসেন। স্কুপ, সুইপ বা রিভার্স সুইপ মারার মাস্টার। মাভিকে ২৮ রান নেওয়ার ওভারেও দু’টো ছক্কা মেরেছেন চামচের মতো উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে তুলে মারা স্কুপ শটে। কুলদীপের জোরের উপর স্পিন ধরতে পারেননি বাটলার। শর্ট থার্ডম্যানে সহজ ক্যাচ।

বিশ্ব জুড়ে এখন সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও লেগস্পিনারের দারুণ চাহিদা। কারণ, তাঁরা দু’দিকে বল ঘোরাতে পারেন। লেগস্পিনের সঙ্গে গুগলি হাতে থাকায় তাঁদের খেলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টিতেও। কুলদীপ যেমন স্বপ্নের গুগলিতে ফেরালেন স্টুয়ার্ট বিনিকে। ফ্লাইটের ফাঁদে বিনিকে টেনে ক্রিজের বাইরে নিয়ে এলেন, বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যান এর পর শট খেলতে গিয়ে দেখল, বল উল্টো দিকে ঘুরছে অর্থাৎ গুগলি। চায়নাম্যান বোলার কুলদীপের গুগলি মানে ডান হাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে সেই বলটা বাইরের দিকে যায়। সম্পূর্ণ পরাস্ত বিনির সহজ স্টাম্পিং করতে ভুল করেননি দীনেশ কার্তিক।

কুলদীপ শেষ করলেন চার ওভারে ২০ রান দিয়ে চার উইকেট নিয়ে। দু’দিকে বল ঘোরানোর পাশাপাশি গতিতেও দারুণ তারতম্য ঘটালেন। বাটলারকে ফেরালেন জোরের উপর করা ডেলিভারিতে। আবার বিনিকে বোকা বানালেন মন্থর গুগলিতে। একটা সময়ে ২৯ বলে ২৪ রানের বিনিময়ে রাজস্থান হারায় চার উইকেট। সেটাই ম্যাচটাকে নাইটদের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ইডেনে তখনই মেক্সিকান ওয়েভ ওঠা শুরু। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দেওয়া হল। আর ‘কে...কে...আর, কে...কে...আর’ ধ্বনি ডেসিবেলের মাত্রা ছাড়াতে শুরু করল।

রাজস্থান ১৯ ওভারেই অল আউট হয়ে গেল ১৪২ রানে। জবাব দিতে নেমে সুনীল নারাইনের ব্যাটিং দেখে বোঝা গেল, শুধু জেতা নয়। নেট রানরেট বাড়ানোর দিকেও নজর রয়েছে নাইটদের। কয়েকটি উইকেট পড়ে যাওয়ায় নেট রানরেটের চিন্তা ছেড়ে আবার জেতার উপরেই মনোনিবেশ করতে হল কার্তিকদের।

রাতের ইডেনে বসে দু’ওভার বাকি থাকতে কার্তিকের ছক্কা মেরে জেতানো দেখেও মনে হচ্ছে, প্রথমার্ধেই ম্যাচের ফয়সালা করে দিয়ে গেলেন কুলদীপ। যাঁর পিঠে হাত রেখে রাজস্থান রয়্যালসের পরামর্শদাতা ওয়ার্ন এক বার বলেছিলেন, ‘‘ভাল স্পিনার হতে গেলে সব চেয়ে বেশি দরকার বড় কলিজা। আক্রমণ করে যেতে হবে। সাফল্য না এলেও নিজের উপর বিশ্বাস হারালে চলবে না।’’ কে জানত, ইডেনে গুরু-মারা বিদ্যে হয়ে দেখা দেবে ওয়ার্নের সেই উপদেশ!

বিরতিতেই দিনের সেরা ছবিটা দেখে নেওয়া গেল। রাজস্থানের ইনিংস শেষ হওয়ার পরে টিভি ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছেন কুলদীপ। আর ওয়ার্ন তখন মাঠে যাচ্ছেন বোলারদের অনুশীলন করাতে। দিনের নায়ককে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন কিংবদন্তি। দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে খুব আবেগপ্রবণ ভাবে কিংবদন্তিকে জড়িয়ে ধরলেন ভক্ত।

ক্রিকেট-সীমানার কাঁটাতার টপকে কখন যে প্রতিপক্ষরাও মিলে যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE