Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
ক্লাব-তাঁবুতে কর্তাদের দাপট: মিছিল-ঝামেলায় অগ্নিগর্ভ সভা

শাসকের শক্তিতে বাগানে শেষ পর্যন্ত পাশ হিসেব

নাটকের বাগানে নবতম ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে উঠলেন কর্মসমিতির সদস্য অতীন ঘোষ। মূলত তিনি এবং তাঁর সঙ্গী জনা কুড়ি সদস্যের জন্যই মোহনবাগানের শুক্রবারের সাধারণ সভা কিছুক্ষণের জন্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। চিত্‌কার, গালাগালি, তেড়ে যাওয়া, সারদা কেলেঙ্কারি, কর্পোরেশন, ওয়াক আউট কিছুই বাদ গেল না। যার জেরে নিরামিষ সভা মশলাদার হয়ে গেল মিনিট পনেরোর জন্য।

তর্কের তুফান। প্রেসিডেন্ট টুটু বসুকেই চ্যালেঞ্জ কর্মসমিতি সদস্য অতীন ঘোষের। শুক্রবার। ছবি:উত্‌পল সরকার।

তর্কের তুফান। প্রেসিডেন্ট টুটু বসুকেই চ্যালেঞ্জ কর্মসমিতি সদস্য অতীন ঘোষের। শুক্রবার। ছবি:উত্‌পল সরকার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

নাটকের বাগানে নবতম ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে উঠলেন কর্মসমিতির সদস্য অতীন ঘোষ। মূলত তিনি এবং তাঁর সঙ্গী জনা কুড়ি সদস্যের জন্যই মোহনবাগানের শুক্রবারের সাধারণ সভা কিছুক্ষণের জন্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। চিত্‌কার, গালাগালি, তেড়ে যাওয়া, সারদা কেলেঙ্কারি, কর্পোরেশন, ওয়াক আউট কিছুই বাদ গেল না। যার জেরে নিরামিষ সভা মশলাদার হয়ে গেল মিনিট পনেরোর জন্য।

শাসকের দাপট আর সংগঠিত শক্তির মুখেও কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ যে ভাবে পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট টুটু বসুর চেয়ারে বসার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন, গত কুড়ি বছরে কেউ সেই সাহস দেখাতে পারেননি। ক্লাবের আয়-ব্যয়ের হিসেব পেশের সময় ‘চোরের হিসেব’ বলতে বলতে ওয়াক আউট করলেন সঙ্গী-সহ অতীন। হাসি ফুটল শাসক শিবিরে। হইহই করে ‘পাশ’ হয়ে গেল সব কিছুই। এর পর সবার চোখ শিলংয়ে, সনি নর্ডিদের ম্যাচে। সেখানে গোলের পর গোলের খবরে তখন তাঁবু জুড়ে উল্লাস।

বাগানের শাসকরা অবশ্য এ দিন শুরু করে দিলেন নির্বাচনের কাজও। শেষ পর্যন্ত সভার কাজ উতরে যাওয়ায় স্বস্তি পাওয়া সচিব অঞ্জন মিত্র বলেও দিলেন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন করে ফেলব। পুলিশ, যারা নির্বাচন পরিচালনা করে সবার সঙ্গে কথা বলেই তারিখ ঠিক হবে।” জানা গিয়েছে, হঠাত্‌ কোনও আইনি বাধা না এলে এপ্রিলে হতে পারে নির্বাচন।

কী প্যানেল হবে তার ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা এ দিন করেছে শাসকগোষ্ঠী। সভার পর রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও অরূপ বিশ্বাসকে হাজির করিয়ে। তাত্‌পর্যপূর্ণ ভাবে অবশ্য হাজির হননি আর এক ভাইস প্রেসিডেন্ট হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী। মন্ত্রী অরূপ শাসকের হয়ে জোরালো সওয়াল করলেও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ সুব্রতবাবু অবশ্য টুটু-অঞ্জনের পাশে বসেই অন্য কথা বলেছেন। “সবাই মিলে একটা প্যানেল করলে ভাল হয়। তাতে ঝামেলা কমে। আমরা তো সবাই ক্লাবের ভাল চাই। এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে ক্লাবের ক্ষতি হয়।” ক্লাব সূত্রের খবর, অতীন-সুব্রত-প্রসূনদের কমিটিতে নিতে রাজি নন শাসকরা। যাঁর মগজাস্ত্রে এখন বাগান চলে সেই সচিব অঞ্জনবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হবেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু টুটুবাবুই। “এক থেকে পঞ্চাশ আমাদের প্রেসিডেন্ট টুটু। পরে অন্যরা।” যা শুনে সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছেন টুটুও। টুটু আগে ঘোষণা করেছিলেন, আর প্রেসিডেন্ট হবেন না। এ দিন বললেন, “ক্লাবের কালীদাসদের দেখে দুঃখে পদত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু আমাকে নিয়ে সদস্যদের আবেগ দেখে ভাল লাগল। তাই ফিরে এসেছি।”

বিরোধী বাগানের দুই ঘরের ছেলের একজন সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে বাজেট অধিবেশনে ব্যস্ত। অন্য জন সুব্রত ভট্টাচার্য ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এক সিনেমাহলে। ছেলের নতুন ছবির প্রিমিয়ার শো-তে। বাগানকে স্বচ্ছ করার দাবিতে মিছিলে হাঁটা প্রাক্তন ফুটবলাররাও নানা অঙ্কে এড়িয়ে গিয়েছিলেন সভা। গোষ্ঠ পালের মূর্তি থেকে অতীনের নেতৃত্বে শ’দুয়েক লোকের মিছিল শুরু হয় বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ। তাতে জনা কুড়ি বৈধ সদস্য ছিলেন। সকাল থেকেই বিরাট পুলিশ বাহিনী আগলে রেখেছিল ক্লাব গেট। তারাই ব্যারিকেড করে নিয়ে আসে মিছিল। কার্ড দেখিয়ে সভায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অতীনকে লক্ষ্য করে সভার চেয়ারম্যান টুটু কটাক্ষ করেন, “অতীনবাবু, দেরি করে এসেছেন। নিয়ম মেনে সভা ঠিক চারটেয় শুরু করেছি। মান্নাদা’র মৃত্যুদিন বলে এক মিনিট নীরবতাও হয়ে গিয়েছে।”

দুপুরের মধ্যেই ক্লাব লনে পাতা শ’চারেক চেয়ার প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল শাসকদের সমর্থকে। দখল হয়ে গিয়েছিল সংবাদমাধ্যমের জন্য নির্ধারিত চেয়ারও। এসেছিলেন জনা পঁচিশ মহিলা সদস্যও। লরি-বাস-ম্যাটাডোরে সংগঠিত করে আনা হয়েছিল তাঁদের। চেয়ার না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও কয়েকশো। অতীন ঢুকেই চলে যান সামনের দিকে। টুটুর কটাক্ষে তেতে গিয়ে তিনি বলতে থাকেন, “আপনি তো পদত্যাগ করেছেন। আপনি কী ভাবে সভা পরিচালনা করেন? পদত্যাগপত্র কি তুলেছেন?” শুরু হয়ে যায় ঝামেলা। টুটু চিত্‌কার করতে থাকেন, “এটা কর্পোরেশন নয়, মোহনবাগান ক্লাব। আমাদের ক্লাব। ঝামেলা করবেন না। যখন ফুটবলারদের মাইনে দেওয়া যাচ্ছিল না, তখন সত্তর লাখ টাকা দিয়েছি। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”

অতীন এবং তাঁর সতীর্থরা চিত্‌কার চালিয়ে যাচ্ছেন দেখে পাল্টা শাসক গোষ্ঠীর লোক তেড়ে আসেন। শুরু হয়ে যায় ধাক্কাধাক্কি। চিত্‌কার। মঞ্চে উঠে পড়েন বহু লোক। মেছোহাটে পরিণত হয় সভা। অতীনের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন পদত্যাগী সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু। হট্টগোলের মধ্যে ‘চোর কর্পোরেশেন’, ‘সারদার চোর’ শব্দগুলো ভেসে ওঠে। চিত্‌কার করতে থাকেন টুটু। অসুস্থ সচিব অঞ্জন মাইক নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন সবাইকে। “আমরা এ সব চাই না। আমি উত্তর দিচ্ছি ওর প্রশ্নের,” বলতে থাকেন তিনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ‘এই অতীন, বেরিয়ে যা’, ‘সব পাশ, সব পাশ’ বলতে শোনা যায় একদল রাগী চেহারার যুবককে। প্রশ্ন উঠে যায়, কর্মসমিতির সদস্য হিসাবে অতীন সাধারণ সভায় কোনও প্রশ্ন করতে পারেন কি না? ঝামেলার মধ্যেই আগের সভার মিনিটস গড়গড় করে পড়ে যান এক ক্লাবকর্মী। পেশ হয় বহুচর্চিত হিসেব। দলবল নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অতীন বক্তৃতা দেন প্রধান গেটের বাইরের রেলিংয়ে উঠে। জানিয়ে দেন, “সদস্যদের নিয়ে নতুন ফোরাম গড়ছি।”

নির্বাচনের মহড়ায় এবং সংগঠনে একশোয় একশো পেলেও বাগানের শাসকরা এখনও পুরোপুরি চিন্তামুক্ত নন। বিরোধীরা যে মামলার নতুন রসদ নিয়ে ফের আদালতের চৌহদ্দিতে ঘোরাফেরা করছেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mohun bagan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE