Advertisement
০৩ মে ২০২৪
খরা কাটিয়ে ভারতসেরা

৮৭ মিনিটের গোলে ১৩ বছরের শাপমুক্তি

ফেন্সিংয়ে টাঙানো একশো ফুটের সবুজ-মেরুন পতাকাটা মুহূর্তে টেনে খুলে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিতে চাইলেন সনি নর্ডি। পারলেন না। উল্টে নিজের জার্সিটাই ছুড়ে দিয়ে গেলেন গ্যালারিতে। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেলো রাজ্জাক আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিলেন, ‘‘চোদ্দো বছর ভারতে খেলছি। এই ট্রফিটা কখনও পাইনি। তুমি আমাকে সেটা দিয়েছ ঈশ্বর।’’ আই লিগে খেলা দেশের প্রবীণতম বিদেশির ওপর এ বার ঝাপিয়ে পড়লেন কাতসুমি। দু’জনেই পড়ে গেলেন মাটিতে।

আই লিগ জয়ের পর বাগান-ব্রিগেড। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।

আই লিগ জয়ের পর বাগান-ব্রিগেড। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।

রতন চক্রবর্তী
বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৫ ০৪:৩২
Share: Save:

মোহনবাগান ১ (বেলো)

বে়ঙ্গালুরু ১ (জনসন)

ফেন্সিংয়ে টাঙানো একশো ফুটের সবুজ-মেরুন পতাকাটা মুহূর্তে টেনে খুলে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিতে চাইলেন সনি নর্ডি। পারলেন না। উল্টে নিজের জার্সিটাই ছুড়ে দিয়ে গেলেন গ্যালারিতে।
বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেলো রাজ্জাক আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিলেন, ‘‘চোদ্দো বছর ভারতে খেলছি। এই ট্রফিটা কখনও পাইনি। তুমি আমাকে সেটা দিয়েছ ঈশ্বর।’’ আই লিগে খেলা দেশের প্রবীণতম বিদেশির ওপর এ বার ঝাপিয়ে পড়লেন কাতসুমি। দু’জনেই পড়ে গেলেন মাটিতে।
পিয়ের বোয়া পাগলের মতো দৌড়োচ্ছিলেন। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। এক সময়ে হয়তো ক্লান্ত হয়েই শুয়ে পড়লেন মাঠে। জলের বোতল খুলে শ্যাম্পেনের মতো ছুড়ছিলেন প্রীতম-বলবন্তরা। মাটিতে উপুড় হয়ে থাকা টিমের ব্যান্ড মাস্টার বোয়ার মাথাতেও ঢেলে দিলেন জল।

তার মধ্যেই অধিনায়ক শিল্টন সবাইকে ডেকে নিলেন। কোচ সঞ্জয় সেনকে শূন্যে তুলে দোলাতে লাগল পুরো বাগান টিম। যেমন দেখা যায় বিদেশের মাঠে।

তেরো বছর পর ফের ভারতসেরা মোহনবাগান। অনেক, অনেক দিন পর শতবর্ষ পেরোনো ক্লাবে ফের পূর্ণিমার আলো। ট্রফির খরা চলছিল গত পাঁচ বছর। গুমরে, মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়ানো সবুজ-মেরুন সমর্থকদের ফের বুক বাজিয়ে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ করে দিল যে বাগান ব্রিগেড, তার কুশীলবদের দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল— এঁরা সত্যিই সাহসী মেরিনার্স। প্রবল উথালপাথাল সামলে যাঁরা ইতিহাসের ঘাটে ভিড়িয়ে দিলেন পালতোলা নৌকো। যার অব্যবহিত পরে টুইটারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন, ‘১১ বছর পরে ট্রফি ফিরে এল বাংলায়। অভিনন্দন মোহনবাগান!’ রবিবার গভীর রাতেও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পোস্ট হয়ে চলেছে পালতোলা নৌকোর ছবি কিংবা ছড়া— ‘নই গো আমি মারাদোনা / নই গো আমি পেলে / আমি হলাম খাস ঘটি / মোহনবাগানের ছেলে।’

জিতলে চ্যাম্পিয়ন। ড্র করলেও। এই অবস্থায় হঠাৎ বিরতির আগে গোল হজম করে ফেলেছিলেন শিল্টনরা। বিপক্ষ যেখানে গত বারের চ্যাম্পিয়ন! তাদের ঘরের মাঠে সেই পিছিয়ে থাকা অবস্থার তীব্র চাপ কাটিয়ে উঠতে পারা মানে প্রায় আমাজনের জঙ্গল থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসা। সনিরা কিন্তু পিছু না হটে, আরও আগুনে মেজাজ নিয়ে ম্যাচটা ড্র করে ফেললেন।

তেরো বছর আগের এক পয়লা বৈশাখে শেষ বার জাতীয় লিগের সূর্য উঠেছিল বাগানে। সে দিনের জাতীয় লিগই আজকের ‘আই লিগ ট্রফি’ হয়ে বাগানে ফিরে এল প্রবল বৃষ্টির এক রাতে। সনির কর্নার থেকে বাগান ডিফেন্ডার বেলোর হেডে গোলটা যখন হল, খেলার বয়স তখন ৮৭ মিনিট।

সে বার চার্চিলের বিরুদ্ধে সোনার গোলটা করেছিলেন আব্দুল স্যালিউ। তেরো বছর পর আজ বেলো রাজ্জাক। দুই নাইজিরীয়র গোল যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করল বাগানে। মজার ব্যাপার, কোনও তারকা স্ট্রাইকার নয়— দু’বারই গোল এল দুই ডিফেন্ডারের পা এবং হেড থেকে। বাগানে ‘এস’ আদ্যোক্ষরের অধিনায়ক মানেই সাফল্যের পরম্পরা, এই ‘মিথ’ও আরও সুদৃঢ় হল। বঙ্গসন্তান শিল্টন যখন কাপটা হাতে করে ‘থ্রি চিয়ার্স ফর বাগান’ বলছিলেন, তখন প্রীতম কোটাল, কিংশুক দেবনাথ, শৌভিক চক্রবর্তীরা গাইছেন, ‘‘আমাদের সূর্য মেরুন, নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে...।’’ তাতে সঙ্গত করতে দেখা গেল কলকাতা থেকে আসা দুই প্রাক্তন, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কম্পটন দত্তকে। দেখলাম ভিড়ের মধ্যে নিজের সবুজ-মেরুন জার্সি ওড়াতে ওড়াতে হাজির আর সি প্রকাশ। শেষ বারের জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন টিমের প্রতিনিধি তিনিই। বেঙ্গালুরু নিবাসী উলগানাথনকেও তো দেখলাম। মনে হচ্ছিল এ যেন ফুটবল-অষ্টমীর দৃশ্য। বাগানের মিলনমেলা। প্রাক্তন-বর্তমান সেখানে মিলেমিশে একাকার। সবার সব ক্ষোভ ধুয়ে মুছে সাফ। শুধুই আলো আর আলো।

এই দৃশ্যটা দেখতেই তো খরচের তোয়াক্কা না করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দক্ষিণের হাইটেক শহরে হাজির হয়েছিলেন ট্রফি-বুভুক্ষু বাগান সমর্থকেরা। যাঁরা বিশালায়তন পতাকা নিয়ে, সবুজ-মেরুন জার্সি আর হেড ব্যান্ডে সেজে বৃষ্টিভেজা কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে জ্বলজ্বল করেছেন। খুব কম করেও সংখ্যাটা হাজার দুয়েক তো বটেই। অনেকেই এসেছিলেন পুরো পরিবার নিয়ে। বেঙ্গালুরু সমর্থকদের প্রবল চিৎকারের সঙ্গে ডেসিবেলের মাপকাঠিতে আগাগোড়া পাল্লা দিয়ে গেলেন এঁরা। কী অদম্য ইচ্ছাশক্তি! গোল খাওয়া সত্ত্বেও দমে যাননি, গঙ্গাপারের ক্লাবের উৎসাহের জোগানেও তাই ভাটা পড়েনি। ট্রফি নেওয়ার পর বাগান টিম তাদের বাসে উঠে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আনন্দটা চেটেপুটে নিয়েছেন এঁরা। তার পর বাড়ি ফিরেছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে।

ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। পরে কিছুটা কমলেও একেবারে থামেনি। ঘাসের মাঠে জল জমেনি, কিন্তু কাদায় পেছল হয়ে গিয়েছিল। এ রকম মাঠ বল-প্লেয়ারদের বধ্যভূমি। শন রুনির মতো সনি নর্ডিও বিপদে পড়লেন। তা সত্ত্বেও সনির একটা শট পোস্টে লেগে ফিরল। বলবন্তের শট গোল লাইন থেকে ফেরালেন জন জনসন। একটা সময় সত্যিই মনে হচ্ছিল, সুনীল ছেত্রীরাই বোধ হয় বাজি মেরে দিলেন।

কিন্তু ভুল। দেশের সব বিদেশি কোচকে হারানো বাগান কোচ দমলেন না! বিরতির পর সনি-কাতসুমিরা ফিরলেন বাড়তি মোটিভেশন নিয়ে। বলতে গেলে, সেই ঝড়ে কোণঠাসা হয়েই গোলটা হজম করল বেঙ্গালুরু। সেরা কোচের পুরস্কারটা চেতলার বাঙালিই পেলেন। সঠিক নির্বাচন। কলকাতার অন্যতম প্রধানকে মাত্র চার মাসে সেরার শিরোপা দেওয়া— সঞ্জয় সেনও তো তারকা হয়ে গেলেন। সুভাষ-সুব্রত-মনোরঞ্জনের পর চার নম্বর বাঙালি কোচ, যিনি বাংলার ক্লাবের হয়ে জাতীয় লিগ বা আই লিগ পেলেন।

ম্যাচটা ড্র হয়েছে। কিন্তু জিততে পারত বাগানই। অন্তত তিন গোলে। ফুটবল ঈশ্বর বরাবরই সাহসীদের সঙ্গে থাকেন। এ দিনও থাকলেন। বেঙ্গালুরু থেকে আগে কখনও বড় ট্রফি জেতেনি বাগান। সেই অভিশাপও আজ কাটিয়ে দিল সঞ্জয় বিগ্রেড।

অতঃপর? কলকাতার অসহ্য গরমেও বাগান তাঁবুতে বসন্ত হাজির। পালতোলা নৌকো আবার স্বমহিমায়। বাংলার ফুটবলকে অক্সিজেন দিয়ে।

মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম, বেলো, ধনচন্দ্র, কাতসুমি (পঙ্কজ), শৌভিক (বিক্রমজিৎ), শেহনাজ, সনি, বোয়া, বলবন্ত (জেজে)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE