Advertisement
১০ মে ২০২৪

সুনামি-অনাথদের আলোয় ফেরানোর লড়াইয়ে সুজাতা

পুদুচেরির গ্রাম কুদালোরোয় ২০০৪-এর সেই সুনামি কেড়ে নিয়েছিল ওদের মা-বাবা-পরিবার। রাধিকাদের মতো চব্বিশ জন মেয়ে হারিয়েছিলেন সর্বস্ব।

স্বপ্ন: পুদুচেরির অনাথ ফুটবলারদের সঙ্গে সুজাতা (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)।

স্বপ্ন: পুদুচেরির অনাথ ফুটবলারদের সঙ্গে সুজাতা (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)।

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০৪:১৭
Share: Save:

রাধিকা, সুমিত্রা, শিবশঙ্করী, সন্ধ্যা—চোদ্দো বছর আগে এক বিধ্বংসী সাইক্লোন অনাথ করে দিয়েছিল এই মালয়ালি মেয়েদের।

পুদুচেরির গ্রাম কুদালোরোয় ২০০৪-এর সেই সুনামি কেড়ে নিয়েছিল ওদের মা-বাবা-পরিবার। রাধিকাদের মতো চব্বিশ জন মেয়ে হারিয়েছিলেন সর্বস্ব। ওদের নিয়েই এখানকার এক প্রাক্তন ফুটবলার মারিয়াপ্পান সুব্রহ্মমানণিয়ন গড়ে তুলেছিলেন একটি সংস্থা—ইন্দিরা গাঁধী স্পোর্টস অ্যাকাডেমি অ্যান্ড এডুকেশন। কয়েকজন বন্ধুর আর্থিক সাহায্যে যেখানে থাকা, খাওয়া, পড়াশোনার পাশাপাশি শেখানো হতো ফুটবলও।

মেয়েদের আই লিগে সেই অনাথ, সহায়সম্বলহীনরা এখন ফুটবল পায়ে আলো ছড়াচ্ছেন এক বঙ্গতনয়ার সৌজন্যে। সতেরো মাসের মেয়ে আরোহীকে কলকাতার বাড়িতে রেখে ইন্দিরা গাঁধী অ্যাকাডেমিকে চ্যাম্পিয়ন করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছেন যাদবপুরের মেয়ে সুজাতা কর। গত এক মাস ধরে তিনি রয়েছেন সমুদ্র পাড়ের সুনামিবিধ্বস্ত রাজ্যে।

বাংলা শুধু নয়, দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা গোল স্কোরার সুজাতা। টিমকে সাফল্যের শিখরে তোলার জন্য ওই অ্যাকাডেমির কর্তারা তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন পুদুচেরিতে। মেন্টর, পরামর্শদাতা এবং ফুটবলার—সব দায়িত্বই পালন করছেন তিনি। অমৃতা নামে খাতায়-কলমে একজন কোচ থাকলেও সুজাতা-ই সামলাচ্ছেন সব। যে দায়িত্ব পেয়ে সুজাতার মন্তব্য, ‘‘এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। নতুন চ্যালেঞ্জ। এর আগেও কোচিং করিয়েছি বিভিন্ন ক্লাবকে। কিন্তু এই অনাথ মেয়েদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি অভিভূত। ফুটবল যে জীবনের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে সেটা এখানে না এলে বুঝতাম না।’’ সুজাতা এখন টিম নিয়ে আছেন শিলং-এ। সেখানে মেয়েদের আই লিগ চলছে। এ দিন সুজাতার দল ২-১ গোলে হারাল মহারাষ্ট্রের ক্লাব রাস-কে।

টানা এগারো বছর দেশের জার্সিতে খেলেছেন সুজাতা। অধিনায়কত্ব করেছেন। তিনিই দেশের প্রথম মেয়ে ফুটবলার যিনি জার্মানির ক্লাবে খেলেছেন। পাঁচ বছর আগে খেলা ছাড়ার পর কোচিং শুরু করেন। গত বছর কলকাতা লিগে তালতলা দীপ্তি সংঘকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। তার পর আই লিগে বাংলার একমাত্র ক্লাব চাঁদনি স্পোর্টিংকেও কোচিং করিয়ে ছিলেন সুজাতা। বাংলার কোচিং-ও করেছেন।

পুদুচেরির এ রকম একটা দলকে কোচিং করানোর প্রস্তাবটা কী ভাবে পেলেন? শিলাবৃষ্টির মধ্যেই বুধবার শিলং থেকে ফোনে সুজাতা বললেন, ‘‘কোচেদের জন্য ওড়িশায় ফিফার রিফ্রেশিং কোর্সে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রস্তাবটা দেন ওঁরা। আমার মনে হয়েছিল ওদের পাশে থেকে যদি সাফল্য এনে দিতে পারি, তা হলে সেটা আমার জীবনের একটা বড় কাজ হবে।’’

চৌত্রিশ বছর বয়সে ফের মাঠে নামছেন বল পায়ে! বাড়িতে একরত্তি মেয়েকে রেখে মাসের পর মাস পড়ে রয়েছেন বাইরে, এর পিছনে মোটিভেশনটা কী? ফোনের অন্য প্রান্তে সুজাতাকে কিছুটা আনমনা মনে হয়। বলে দেন, ‘‘যাদবপুরে মা-র কাছে রেখে এসেছি মেয়েকে। আগে সব জায়গায় নিয়ে যেতাম সঙ্গে করে। কিন্তু গতবার কোলাপুরে চাঁদনি টিমের কোচ থাকার সময় সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। অসুস্থ হয়ে পড়েছিল আরোহী। এ বার তাই আনিনি। কষ্ট যে হয় না, তা নয়। ভোরে মোবাইলে মেয়ের ‘মাম্মা’ শুনে অনুশীলনে বেরোই। সেই ডাকের অক্সিজেন নিয়ে সব হারানো মেয়েদের সঙ্গে মিশে যাই। ওরাই তো আমার মোটিভেশন। এই সুযোগ ক’জন পায়।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘ভাষা সমস্যা আছে। তা সত্ত্বেও ওদের জীবনের গল্প যখন শুনি, তখন মনের ভিতরটা কেঁদে ওঠে। ওদের তো মারিয়াপ্পান স্যার ছাড়া কেউ নেই। কত অসহায়।’’

ডাকাবুকো সুজাতা বরাবরই একটু ব্যতিক্রমী চরিত্রের। বজবজের মাঠে রেজিনা খাতুন নামের একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ভাল ফুটবল খেলছে দেখে তাকে বাড়িতে রেখে মানুষ করেছেন। সরকারি চাকরি পেলেও এখনও রেজিনা থাকেন তাঁর বাড়িতেই। সুজাতা বলছিলেন, ‘‘আমি জন্মদাত্রী না হলেও রেজিনা আমার বড় মেয়ে। অফিস সামলে আমার ছোট মেয়েকে রেজিনাও সামলায়। তাই অসুবিধা হয় না।’’

সুনামি অনাথদের আলোয় ফেরানোর জন্য সব কষ্ট-ই যে এখন সুজাতার কাছে তুচ্ছ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sujata Kar Puducherry football Tsunami-orphans
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE