Advertisement
০২ মে ২০২৪

আমির নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক খেলা শুরু পাকিস্তানের

এমনিতে লন্ডনে কাল্পনিক সব বিখ্যাত চরিত্রকেও এমন যত্ন আর শ্রদ্ধা নিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, মনে হবে তাঁরা ‘ফিকশন’ কোথায়? জলজ্যান্ত রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। যেমন ২২১বি, বেকার স্ট্রিট। শার্লক হোমসের ঠিকানা। বেকার স্ট্রিটে রাস্তার একটা বড় অংশ জুড়ে শুধু শার্লকের নামে দোকান।

নজরে: প্র্যাকটিসে পাকিস্তানের অন্যতম ভরসা আমির। ছবি: রয়টার্স।

নজরে: প্র্যাকটিসে পাকিস্তানের অন্যতম ভরসা আমির। ছবি: রয়টার্স।

সুমিত ঘোষ
লন্ডন শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৭ ০৪:১৯
Share: Save:

মহম্মদ আমির চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে খেলবেন কি খেলবেন না? ভারত-পাক ব্লকবাস্টার দ্বৈরথ নিয়ে উন্মাদনার পারদ চড়া আর ইন্টারনেট যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে কৌতূহল তৈরি করেছে এই প্রশ্ন।

এমনিতে লন্ডনে কাল্পনিক সব বিখ্যাত চরিত্রকেও এমন যত্ন আর শ্রদ্ধা নিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, মনে হবে তাঁরা ‘ফিকশন’ কোথায়? জলজ্যান্ত রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। যেমন ২২১বি, বেকার স্ট্রিট। শার্লক হোমসের ঠিকানা। বেকার স্ট্রিটে রাস্তার একটা বড় অংশ জুড়ে শুধু শার্লকের নামে দোকান।

কেক থেকে বই, সব রকম দোকানেরই নামে পাওয়া যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সবচেয়ে জনপ্রিয় থেকে যাওয়া প্রাইভেট ডিটেকটিভকে। সে সব দেখে কে বলবে, তিনি কখনও বেকার স্ট্রিটের উপর দিয়ে পাইপ মুখে নিয়ে হাঁটেননি। বেঁচে ছিলেন শুধুই আর্থার কোনান ডয়েলের উপন্যাসের পাতায়।

তেমনই ভক্সহল ক্রসের সেই বিখ্যাত বিল্ডিং। ব্রিটিশ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার্স। ভক্সহল ব্রিজের ঠিক পাশে টেমসের পারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ’, ‘ডাই অ্যানাদার ডে’ বা ‘স্কাইফল’ দেখে থাকলে নিশ্চয়ই বিল্ডিংটা চেনা-চেনা লাগবে। এটাই যে জেমস বন্ডের অফিস। মিস্টার বন্ডের সঙ্গে এমনই সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে এই বিল্ডিং যে, সিক্রেট এজেন্টের অফিস হিসেবে আর কেউ এর নাম নেয় না। বলে, ওই যে জেমস বন্ডের অফিস। বিখ্যাত সেই এম আই সিক্স বিল্ডিং। কে বলবে, সত্যিকারের কোনও জেমস বন্ড বাস্তবে কোনও দিন এই বিল্ডিংয়ের ভিতরে পা-ই রাখেননি।

২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের ফাইনালে ওঠাটাও ‘ফিকশন’ মনে হতে পারে কারও কারও কাছে। যদি কেউ রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে পকিস্তানের হারের পর ঘুমিয়ে পড়ত আর জেগে উঠত কার্ডিফে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর দিনে, তা হলে নির্ঘাৎ এটাকে কল্পকাহিনি আখ্যা দিত।

সরফরাজদের নিজেদের দেশেই অবিশ্বাস আর রহস্যের ফর্মুলা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। যেমন প্রাক্তন পাক অধিনায়ক আমির সোহেল বিস্ফোরক দাবি করেছেন যে, পাকিস্তানের ফাইনালে ওঠার পিছনে নাকি বাহ্যিক শক্তির প্রভাব রয়েছে। সরাসরি না বললেও আমিরের ইঙ্গিত, গড়াপেটার মাধ্যমে পাকিস্তানকে তুলে দেওয়া হয়েছে। পাক জনতা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তুলোধনা হচ্ছেন আমির সোহেল। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, যে টিভি অনুষ্ঠানে আমির এই মন্তব্য করেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদও। তিনি চুপচাপ ছিলেন। প্রতিবাদ করলেন না কেন?

পাকিস্তানের সময় সন্ধের দিকে সোহেলকে পাল্টা আক্রমণ করে বিবৃতি দেন পাক বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহরিয়র খান। তিনি সরফরাজদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে আমাদের ক্রিকেট দল। আর কিছু ঈর্ষান্বিত প্রাক্তন এই ক্রিকেটারদের অসাধারণ প্রচেষ্টাকে রক্তাক্ত করার চেষ্টা করছে।

সব মিলিয়ে চিরকালের সেই পাক ক্রিকেট। অন্তর্কলহের আগুন জ্বলছে। গা ছমছমে রহস্যের প্লটও এ দিন যোগ করার চেষ্টা হল পাকিস্তান টিমের পক্ষ থেকে। তাদের প্রধান পেস অস্ত্র মহম্মদ আমিরকে খেলানো হবে কি হবে না, তা নিয়ে। কিন্তু এই রহস্যের কিনারা করতে মনে হয় না কেউ বেকার স্ট্রিট বা এম আই সিক্স বিল্ডিংয়ে ছুটবে বলে। আমির পুরো ফিট হয়ে গিয়েছেন এবং তিনি খেলবেন। তা সে যতই ইনিয়ে-বিনিয়ে আর নানা নাটক করে তাদের বোলিং কোচ আজহার মেহমুদ বলে যান, ‘‘আমির ফিট হয়ে গিয়েছে কিন্তু সেমিফাইনালে ওর জায়গায় রুমান রইস ভাল বল করেছে। আমিরের অভাব সে দিন ও বুঝতেই দেয়নি। আমরা এখনও ঠিক করিনি, আমিরকে ফাইনালে খেলাব কি না।’’

পাক শিবিরে খোঁজ নিয়ে অবশ্য জানা গেল, এ দিন নেটে আমির পুরোদমে ব্যাটিং, বোলিং করার পরে ঠিক হয়ে গিয়েছে আমির খেলবেন। তাঁর মতো প্রধান বোলারকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনও জায়গাই নেই। ক্রিকেট বিশ্ব গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমির বনাম বিরাট কোহালি দ্বৈরথের দিকে। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বনাম বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার। ঢাকায় এশিয়া কাপে কোহালি জিতেছেন। ইডেনে কোহালি জিতেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ওভাল কার হতে যাচ্ছে?

কারও কারও আবার মনে হতে পারে, আমির বনাম রোহিত শর্মা দ্বৈরথও খারাপ কীসের! কোহালির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল আমিরের। পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার যখন ম্যাচ গড়াপেটার অভিশপ্ত অধ্যায় কাটিয়ে এশিয়া কাপে প্রত্যাবর্তন ঘটাচ্ছিলেন, কোহালি পাশে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এর পর কোহালির ভক্ত হয়ে যাওয়া আমির ইডেনে খেলতে এসে তাঁর কাছ থেকে ব্যাট উপহার নিয়ে গেলেন।

কিন্তু রোহিতের সঙ্গে সে রকম কোনও প্রেম পর্ব নেই। বরং রোহিত বেশ কয়েক বার আমিরকে নিয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলেছেন। তাঁকে দেখলে তাই পাক পেসারের বলের গতি বেড়ে যায়। এজবাস্টনে এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচেই রোহিতকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়ে আমির এমন দু’টো আগুনে ওভার করেন যে, মনে হচ্ছিল তাঁর প্রথম স্পেলই না ভারতীয় ব্যাটিংকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। রোহিত ফাইনাল খেলতে আসছেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করে। ফলে আমিরের বিরুদ্ধে এ বার বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাতে পারে তাঁকে।

বরং পাকিস্তানের উদ্বেগ হয়ে দাঁড়াতে পারেন হাসান আলি। এই টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনি। ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে পিটুনি খেয়ে ৭০ রান দেওয়ার পরে দারুণ ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সকলকে চমকে দিয়েছেন তিনি। যেমন পেস, তেমন সুইং, তেমন নিয়ন্ত্রণ। ইমরান, আক্রম, ওয়াকারদের শক্তিমান পাক পেস বোলিংয়ের ইতিহাসে নতুন সংযোজন এ বার হাসান আলি। আর উদ্বেগের কারণ, শুক্রবার প্র্যাকটিসে এসেও তাঁর বল না করা।

পাকিস্তান শিবির থেকে যদিও দাবি করা হল, কোনও চোটের গল্প নেই। সে তো আজহার মেহমুদও দাবি করলেন, আমির অটোমেটিক চয়েস নন। কে তাঁর কথা বিশ্বাস করবে? শার্লকের প্রাথমিক ফর্মুলা প্রয়োগ করেও যে হচ্ছে না! ‘হোয়েন ইউ হ্যাভ এলিমিনেটেড দ্য ইম্পসিব্‌ল...’।

মহারণের ফাইনালে অসম্ভবের তালিকায় কে রাখার সাহস দেখাবে আমিরকে! বেকার স্ট্রিট থেকে আধ ঘণ্টা দূরত্বের ওভালে বসে আজও বা কে খণ্ডানোর সাহস দেখাবে বিশ্বের সবচেয়ে দুঁদে ডিটেকটিভকে! হোক না যতই ‘ফিকশনাল’ চরিত্র। লন্ডনের রাস্তা জুড়ে আজও যে শার্লক হোমসের জন্য শুধু সম্ভ্রম আর সম্ভ্রম!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE