Advertisement
০৭ মে ২০২৪

চলমান রূপকথার দখলে রাজপুত্রের শহর

আমাদের এসপ্ল্যানেড কিংবা বিবাদী বাগকে অন্তত পঞ্চাশ দিয়ে গুণ করলে একটা আবছা আন্দাজ পাওয়া যাবে। আর ঠিকঠাক ধারণা পেতে হলে? নাহ্, সোজা একশো দিয়ে গুণ!

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
প্যারিস শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ১০:০৫
Share: Save:

আমাদের এসপ্ল্যানেড কিংবা বিবাদী বাগকে অন্তত পঞ্চাশ দিয়ে গুণ করলে একটা আবছা আন্দাজ পাওয়া যাবে। আর ঠিকঠাক ধারণা পেতে হলে? নাহ্, সোজা একশো দিয়ে গুণ!

প্যারিসের যৌবন এবং পৌরাণিক মাদকতা একই জায়গায় যদি খুঁজতে হয়, সঁজেলিজের আর্ক দ্য ত্রিয়ম্ফ চত্বর যে কারও গন্তব্য হওয়া উচিত। এত গমগমে, এত প্রাণবন্ত, এত রঙিন এলাকা পৃথিবীতে আর ক’টা আছে সন্দেহ।

প্রায় আকাশ ছুঁয়ে থাকা ফরাসি বিপ্লবের প্রতিনিধি যে কোনও ইতিহাসপ্রিয় পর্যটককে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে ধীরে ধীরে চেতনা অবলুপ্তির পথে টেনে নিয়ে যাবে। ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়ান-যুগে প্রয়াত যোদ্ধাদের খোদাই করা পরের পর নাম, ফ্রান্সের ঐতিহাসিক সব যুদ্ধজয়ের মহান উল্লেখ নিয়ে অপরূপ স্থাপত্যের দু’শো বছরের উপর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ধমনীতে শিরশিরানি তোলে।

ইতিহাস ভাল না লাগলেও সঁজেলিজের এই শার্ল দ্য গল এলাকার নাগরিকত্বে কোনও অসুবিধে নেই। রাস্তার ধারে টেবল-চেয়ার পাতা। এক কাপ কফি নিয়ে বসে পড়ুন। ইচ্ছে হলে সিগারেটেও টান দিতে পারেন প্রকাশ্যে। কারণ অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশের মতো ফরাসিদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে নাক সিঁটকানোর ব্যাপার নেই। আবার ঝাঁ চকচকে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকলেও কম ভাল লাগবে না।

ইউরো কাপ নামের প্রেমিকের প্রেমে পড়া প্যারিস এমনিতেই এখন অনেক বেশি রূপসী। রাস্তার যে কোনও দিকে চোখ রাখলেই ‘ইউরো ২০১৬’ নীল পতাকার ওড়াউড়ি। রূপের মাদকতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ছোট ছোট ফুটবল জয়েন্টগুলো। আইফেল টাওয়ারের মিনিয়েচার থেকে স্পেন-জার্মানি-পর্তুগালের জার্সি, পতাকা, রিস্টব্যান্ড— ফুটবলপিপাসুর পক্ষে লোভ সামলানোই মুশকিল।

গ্যারেথ বেলের আজ এত কিছু দেখার কথা নয়, দেখার উপায়ও ছিল না। ক্রিস কোলম্যানের টিমের ইউরো বেসগ্রাউন্ড সঁজেলিজের অনেক, অনেক দূরে দিনার্দে। গুগল সার্চ দিলে দূরত্বটা প্রায় চারশো কুড়ি কিলোমিটার দেখায়। গাড়িতে আসতে হলে হাতে অন্তত ঘণ্টাচারেক রাখতে হবে। এক দিক দিয়ে ভাবলে ঠিকই আছে। সঁজেলিজের ফুটবল-শপে যে জার্সি নিয়ে হুড়োহুড়ি অধিকাংশ সময় চলতে দেখা গেল, বেলের দেখতে তো খুব ভাল লাগত না। ক্লাব এক, দেশজ দায়িত্ব পালনের সময়টুকু বাদ রাখলে অধিকাংশ সময় এক দেশে থাকেনও তাঁরা। কিন্তু তাঁরই সাম্রাজ্যে, তাঁকে বাদ দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ সতীর্থ নিয়ে হুড়োহুড়ি, ওয়েলস উইজার্ডের খুব ভাল লাগার তো কথা নয়।

গ্যারেথ বেলের শহর যে এখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর অধীনে!

বিলেতের কাগজগুলো বেশ কিছু দিন ধরেই বেলকে নিয়ে একটার পর একটা প্রশংসামূলক লেখা লিখে চলেছে। লেখা উচিতও। টুর্নামেন্টের এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্কোরার তিনি। ওয়েলসের মতো একটা টিমকে, যাদের ফ্রান্স ইউরোর আগে শেষ বড় টুর্নামেন্ট ছিল আটান্ন বিশ্বকাপ, ইউরোর আগে যে দেশের বিরুদ্ধে শেষ গোল করে গিয়েছিলেন এডিসন আরান্তেস দো নাসিমেন্টো বলে কোনও একজন, সেই টিমকে একক শৌর্যে টেনে নিয়ে সটান শেষ ষোলোর যুদ্ধে বসিয়ে দেওয়া— খুব সহজসাধ্য নয় বোধহয়।

এ দিন বিলেতের একটা কাগজ লিখেছে, ক্রিশ্চিয়ানোর চেয়েও বেল এগিয়ে। ফুটবলের বিবর্তন মেনে নিজের খেলা শুধু পাল্টাননি, রায়ান গিগসের ধাঁচে উইঙ্গারের ট্যাগ থেকে নিজেকে শুধু বার করে আনেননি, রোনাল্ডোর চেয়ে কাগজে-কলমে অনেক দুর্বল, অনেক অপরিচিত সতীর্থ নিয়ে খেলছেন। রোনাল্ডোর একটা মুটিনহো আছে। একটা রেনাতো সাঞ্চেজ আছে। একটা নানি আছে। বেলের সেখানে অ্যালান র‌্যামসে ছাড়া আর কে আছে? পর্তুগাল ইউরোপ যুদ্ধে বরাবর সম্মান সরণিতে। বেলের ওয়েলস তো সেখানে এখনও ‘স্মল নেশন।’

কিন্তু সঁজেলিজে ঘুরে অন্তত এ দিন বেল নিয়ে উজ্জীবিত হওয়ার মতো কিছু পাওয়া গেল না। চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ে পার্ক দে প্রিন্সেসে নামবেন ওয়েলস-রাজপুত্র। তাঁর প্রজাদের তো অন্তত একটু-আধটু এখন দেখা পাওয়া উচিত। ফুটবল-শপে ঢুকে পড়ে ওয়েলস পতাকা নিঃশেষ করে ফেলা উচিত। গ্যারেথ বেলের জার্সিও আর একটাও পড়ে থাকার কথা নয়।

পড়ে থাকার কথা নয়, কিন্তু পড়ে থাকছে। সঁজেলিজের ফুটবল-শপের একটায় এক তামিল যুবককে পাওয়া গেল। প্যারিসে মাস্টার্স ডিগ্রি করছেন। ফাঁকে-ফাঁকে দোকানে কাজ করে হাতখরচ তুলে নেওয়া। শ্রীরাম নামের ওই যুবক বলছিলেন, জনপ্রিয়তার বিচারে এক নম্বরে এখন ল্যে ব্লুজ জার্সি। তার পর স্পেন, তার পর পর্তুগাল। কিন্তু সেটা দেশের ক্ষেত্রে। কোনও ব্যক্তি বিশেষে এলে আলোচনাটা খুব ছোট। কারণ, নাম স্রেফ একটা।

সিআর সেভেন।

শোনা গেল, রোনাল্ডোর নাম লেখা এক-একটা জার্সির দাম প্রথমে ছিল ঊনচল্লিশ ইউরো। হাঙ্গেরি ম্যাচের পর সেটা পঞ্চাশ করা হয় দ্রুত। কিন্তু তাতেও নাকি সামলানো যাচ্ছে না। পর্তুগিজ জলদস্যুর মতো এঁরা নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকছেন এবং সব নিঃশেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন! শনিবার রোনাল্ডোর ম্যাচ অন্য শহরে, তবু। “ওয়েলসের সেখানে দু’-একটা ছাড়া আজ বিক্রিই হয়নি,” বলছিলেন প্যারিসের দোকানি শ্রীরাম।

কে জানে, এঁরা রোনাল্ডোর দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তন দেখার সঙ্গে সঙ্গে নানির কথাবার্তাও ইন্টারনেটে পড়ে-টড়ে এ দিন দোকান সাফ করতে ঢুকে পড়েছিলেন কি না! নানি তো এ দিন বলে দিয়েছেন যে, এ বার গোল-প্রপাত শুধু আসবেই নয়, নিয়মিত আসবে। “ক্রিশ্চিয়ানো কী, এক মিনিটে ও কী করে ফেলতে পারে-না পারে, সবাই জানে। আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত যে, ও আরও গোল করবে এখন।” প্রিয় ক্যাপ্টেনকে নিয়ে এত দিনের সমালোচনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়া নানি আরও বলেছেন যে, ক্রিশ্চিয়ানো নিয়ে কথা বলার কোনও জায়গাই নেই। কারও বলা উচিতও নয়। হাঙ্গেরি ম্যাচটা দেখার পর সবার এ বার চিরকালের মতো চুপ করা উচিত।

আর তাই বোধহয় এ দিনের মতো সঁজেলিজের সমর্থন প্রভেদেও দুই মহাতারকাকে কোথাও গিয়ে মিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এক জন রূপকথার পিছনে ছুটছেন। ওয়েলসের ‘বালা’ নামের গ্রামটা আপাতত ‘বেল’ করে দেওয়া হয়েছে। এ দিনই সেখানকার কাউন্সেলর নাকি ঘোষণা করেছেন, তাঁকে ‘অনারারি ফ্রিডমও’ দেওয়া হবে। আর এক জন, নিজেই চলমান রূপকথা। বারো বছর আগে ইউরো ফাইনালে উঠেও পারেননি। এ বারই ইউরোয় শেষ সুযোগ রোনাল্ডোর। বেলও কি আর আসবেন ফের ইউরো খেলতে? নিশ্চিত করে কি বলা যায়?

এঁরা কেউ পারলে, যুগ যুগ ধরে অবিনশ্বর থেকে যাবেন নিঃসন্দেহে। ইতিহাস হয়ে থেকে যাবেন আর্ক দ্য ত্রিয়ম্ফের ওই অজানা যোদ্ধার মতো। যাঁর নাম কেউ জানে না। কিন্তু ফুলে ঢেকে, আগুন জ্বালিয়ে আজও রক্ষা করে তাঁর স্মৃতি।

বীরত্বের স্মৃতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ronaldo Portugal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE