Advertisement
E-Paper

অসন্তোষের আগুনেই মশাল জ্বলার অপেক্ষা

এয়ারপোর্টের বাইরের দেওয়ালেই হেলান দিয়ে রাখা আছে ব্যানারটা— ‘এটা নরক, এখানে আসবেন না!’ রিওর আন্তোনিও কার্লোস জোবিম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে শহরমুখী হলেই পড়বে একটা উড়ালপুল।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৬ ০৪:১৪
অসন্তোষ ছড়িয়েছে পথে

অসন্তোষ ছড়িয়েছে পথে

এয়ারপোর্টের বাইরের দেওয়ালেই হেলান দিয়ে রাখা আছে ব্যানারটা— ‘এটা নরক, এখানে আসবেন না!’

রিওর আন্তোনিও কার্লোস জোবিম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে শহরমুখী হলেই পড়বে একটা উড়ালপুল। চোখ অবধারিত চলে যাবে তার গায়ে আঁকাবাঁকা লেখাটায়। ‘ওয়েলকাম! উই ডোন্ট হ্যাভ হসপিটালস।’

স্টেডিয়াম আর মেট্রো রেলের নতুন রুট তৈরির জন্য জমি নিয়েছে সরকার। কিন্তু বিকল্প বাসস্থান পাননি অনেকেই। মাঝেমধ্যেই এই শহরের রাজপথে গৃহহীনদের বিক্ষোভ। থমকে যাচ্ছে গাড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

ঝাঁ চকচকে রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকলেই খানাখন্দ। খোলা নর্দমা, ডোবা। অলিম্পিক্সের শহর না, ঢাকুরিয়ার রেললাইনের ধার— গুলিয়ে যাবে। রিওর এই পাড়াগুলোই নাকি জিকা ভাইরাস ছড়ানো মশার আঁতুড়ঘর। যে রোগের ভয়ে বেশ কিছু তারকা ক্রীড়াবিদ এ বারের অলিম্পিক্স থেকে নামই তুলে নিয়েছেন!

আরও আছে। মাইনে না পেয়ে পুলিশি বিক্ষোভ, দমকল কর্মীদের হুঁশিয়ারি, মেট্রো রেল কর্মীদের ধর্মঘট। মিডিয়া সেন্টারে স্থানীয় সাংবাদিক জানালেন, একটি বড় নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে নাকি চুক্তি হয়েছিল রিওর অলিম্পিক্স কর্তাদের। কিন্তু প্রশাসন টাকা দিতে না পারায় তারা সরে দাঁড়িয়েছে। ফলে নামাতে হয়েছে প্রায় তিরিশ হাজার সেনা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, স্টে়ডিয়ামের তিন-চার কিলোমিটার চৌহদ্দি জুড়ে এখন সেনার দাপাদাপি।

প্রশাসনকে দুষে লাভ নেই। অলিম্পিক্সের কয়েক সপ্তাহ আগেও বিশ্ব জুড়ে ঘটে চলা পরের পর হামলা আর তার অনেকগুলোতেই জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের নাম উঠে আসা অদ্ভুত এক ভয়ের চাদরে মুড়ে দিয়েছে এ বারের অলিম্পিক্সকে। ‘জঙ্গি’ শব্দটা এখানে লোকের মুখে মুখে। বাঙালি সাংবাদিককে রিওর ঠিকানায় নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিচালকও বলে গেলেন, ‘‘যে কোনও সময় হতে পারে হামলা।’’ সঙ্গে পরামর্শ দিলেন— রাতে এটিএম থেকে টাকা তুলবেন না, মোবাইল কানে রাস্তায় একা বেরোবেন না। শেষ সতর্কবার্তাটা দেশে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া গুন্ডা-ছিনতাইবাজদের কথা মাথায় রেখে।

আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুর্নীতির অভিযোগ। আর রাস্তায় বেরোলে ভারী বুটের শব্দ। এই আবহেই কি জ্বলে ওঠার কথা ছিল অলিম্পিক্স মশালের? তোমায় দেখে কষ্ট হয় রিও। কান্না পায়!

অথচ মাত্র সাত বছর আগে ব্রাজিলকে যখন ২০১৬ অলিম্পিক্সের জন্য বেছে নেওয়া হয়, জনতার কার্নিভাল দেখেছিল রিওর রাজপথ। পেলেকে সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা নিজে পড়ে থেকে দেশে এনেছিলেন অলিম্পিক্স। পাগল-উচ্ছ্বাস, গান, সবুজ-হলুদ কাগজের টুকরোর বৃষ্টি নেমেছিল সে দিন। প্রথম বার লাতিন আমেরিকায় অলিম্পিক্স নিয়ে আসতে পেরে সে দিন গর্বিত ছিল ব্রাজিল।

২০১৬-র অগস্টে সেই রিওর উপকণ্ঠেই কি না জল ঢেলে অলিম্পিক্সের মশাল নেভানোর চেষ্টা করছেন একদল বিক্ষোভকারী। পুলিশি ঘেরাটোপে মশাল নিয়ে দৌড়চ্ছেন রিওর মেয়র। আর লুলা? তিনি কবেই পদচ্যুত। উত্তরসূরি দিলমা রুসেফও ইমপিচমেন্টের মুখে। কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট মিশেল টেমারের নাজেহাল দশা। ১৯৩০-এর পর ব্রাজিলের আর্থিক অবস্থা এত খারাপ তো কখনও হয়নি! রাস্তা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, ঘুরেফিরে আসছে একটাই সুর— ‘মানুষ খেতে পাচ্ছে না, তখন অলিম্পিক্সের নামে টাকা ওড়ানো হচ্ছে কোন সাহসে?’

দু’বছর আগে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন ঘিরেও যথেষ্ট ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল ব্রাজিলে। সে বারও ক্ষোভের মূলে ছিল অর্থনৈতিক সঙ্কট। তবে টুর্নামেন্টটা শেষ করা গিয়েছিল নির্বিঘ্নে। এ বার সেই নিশ্চয়তাটুকুও মিলছে না। কারণ, একে তো আর্থিক পরিস্থিতির কোনও উন্নতি নেই। দুই, ঘেরা স্টেডিয়ামে ৩২ দেশের ফুটবল বিশ্বকাপের মতো একটা ইভেন্ট করা আর ২০৬ দেশের এগারো হাজার অ্যাথলিটকে নিয়ে জলে-স্থলে-সমুদ্র সৈকতে ৩০৬ ইভেন্টের অলিম্পিক্স আয়োজনের মধ্যে ফারাক বিস্তর!

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটির প্রেসি়ডেন্ট টমাস বাখ নিজেই ঘুরে ঘুরে দেখছেন রিওর স্টেডিয়াম, ট্র্যাক, গেমস ভিলেজ। আর বলছেন, ‘‘চিন্তায় আছি। শেষ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চললে হয়!’’ টুনার্মেন্ট শুরুর চব্বিশ ঘণ্টা আগেও দেখা যাচ্ছে, চতুর্দিকে কত কাজ বাকি। শহরের বহু জায়গায় অলিম্পিক্সের পোস্টার পর্যন্ত পড়েনি। গেমস ভিলেজ নিয়েও অভিযোগের বন্যা। এই খাটের সমস্যা মিটল তো, ছাউনি উড়িয়ে নিল সমুদ্রের হাওয়া। জলের পাইপ, ভাঙা বাথরুম সারানো হল, তো জলে জীবাণু সংক্রমণ নিয়ে হইচই। অস্ট্রেলিয়ার সমস্যা মিটল তো শুরু করল আমেরিকা।

ভারতের হকি কোচ রোল্যান্ট অল্টমান্স টিম মিটিং করতে গিয়ে দেখেন, হলঘরে চেয়ার নেই, ঘরে টিভি নেই। অ্যাথলেটিক্স কোচ বাহাদুর সিংহেরও একই অবস্থা। শেফ দ্য মিশন রাকেশ গুপ্তকে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশনের সাহায্যে নিজেদের টাকায় চেয়ার-টেবিল কিনতে হয়েছে! হকি দলের এক তারকা বলছিলেন, ‘‘দিল্লির কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে এত সমালোচনা হয়েছে। এখানকার চেয়ে তার অবস্থা অনেক ভাল ছিল।’’

বিশ্বের ইতিহাসে এর আগে দু’বছরের ব্যবধানে একটা দেশই অলিম্পিক্স আর বিশ্বকাপ করেছিল। জার্মানি। ’৭২ আর ’৭৪-এ। কিন্তু জার্মানির অর্থনৈতিক বুনিয়াদ আর সাংগঠনিক দক্ষতার কাছে ব্রাজিল নস্যি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুটবল, কফি আর পর্যটন যে দেশের ব্র্যান্ড, সেখানকার রাজনৈতিক নেতারা অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে গিয়েই এই বিড়ম্বনা ডেকে আনলেন। সাত বছর আগের পরিস্থিতি সামান্য উন্নত হয়তো ছিল। কিন্তু বর্তমান সমীক্ষা বলছে, ব্রাজিলের ৫৭% মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নীচে। ফলে বেড়েছে অপরাধপ্রবণতা। খুন, ছিনতাই, মারামারি বেড়েছে ২৫%। শুধু রিওতেই নাকি নাবালিকা যৌনকর্মীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। খেলার গ্রহের দুই মেগা ইভেন্ট আয়োজনের বাড়াবাড়ি ঝুঁকি নিয়ে এর পরেও প্রশ্ন না ওঠাটাই অস্বাভাবিক!

অলিম্পিক্স কমিটির তদারকিতে এর পরেও হয়তো উতরে যাবে রিও। পর্দা উঠতেই হয়তো নতুন নতুন রেকর্ডের ছটায় ঢেকে যাবে বিক্ষোভ। ইতিহাসে ঢুকে পড়বেন বহু অ্যাথলিট। বস্তুত, তার ‘ট্রেলার’ শুরু হয়েও গিয়েছে। ব্রাজিলেরই মেয়েদের ফুটবল টিম বুধবার জিতেছে প্রথম ম্যাচে। দীপিকা কুমারী-অতনু দাশদের তিরন্দাজির গুরুত্বপূর্ণ ড্র হয়ে যাবে শুক্রবার উদ্বোধনের আগেই। এরই মধ্যে সেরিনা উইলিয়ামস সাংবাদিক সম্মেলনে বলে গিয়েছেন, ‘‘সানিয়া মির্জার সঙ্গে খেলাটা সব সময়ই চ্যালেঞ্জের। ও যাকে নিয়েই ডাবলস খেলুক, পদকের অন্যতম দাবিদার।’’ উসেইন বোল্ট, মাইকেল ফেল্পস, লিয়েন্ডার পেজ বা অভিনব বিন্দ্রার মতো সেরিনারও হয়তো এটাই শেষ অলিম্পিক্স। কে না জানে, নতুনের উত্থানের চেয়ে চেনা তারকার সোনালি বিদায়ের জৌলুস যে কোনও টুনার্মেন্টের বাড়তি টিআরপি!

কিন্তু পনেরো দিনের জৌলুসের পর কী হবে সাম্বার দেশের? জানা নেই, অপেক্ষা করে কোন অন্ধকার। যেখানে অলিম্পিক্স নয়, ক্ষোভের আগুনই জ্বলতে থাকে ধিকিধিকি!

Rio Olympics Olympic torch protest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy