Advertisement
১৭ মে ২০২৪

সঙ্গাদের শেষ ম্যাচ, সেই চাপেই শেষ লঙ্কা

এই বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালটা বেশ অবাক করা একটা ম্যাচ হয়ে থাকল। ভাববেন না দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে বলে আমি অবাক হয়েছি। যেটা বেশ আশ্চর্যের সেটা হল বুধবার ওদের জয়ের ধরনটা। ম্যাচের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একবার ভেবে দেখুন।

দীপ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০৪:৪৫
Share: Save:

এই বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালটা বেশ অবাক করা একটা ম্যাচ হয়ে থাকল। ভাববেন না দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে বলে আমি অবাক হয়েছি। যেটা বেশ আশ্চর্যের সেটা হল বুধবার ওদের জয়ের ধরনটা।

ম্যাচের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একবার ভেবে দেখুন। বিপক্ষের নাম শ্রীলঙ্কা, যারা বড় টুর্নামেন্টে নকআউট খেলে খেলে অভ্যস্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা যে পর্যায়ের ম্যাচে বরাবর ব্যর্থ। তার পর ম্যাচটা হল সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, যেখানে ডেল স্টেইন-মর্নি মর্কেলের কার্যত অল পেস অ্যাটাকের চেয়ে স্পিনার-নির্ভর শ্রীলঙ্কার বোলিং খাতায়কলমে বেশি কার্যকর হওয়া উচিত। তা সে যতই এ বার ওদের বোলিংটা দুর্বল দেখাক। আর ম্যাচের প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ টসটাও জিতল শ্রীলঙ্কা। জিতে আগে ব্যাট করল আর রান তাড়া করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চোক করে যাওয়া ডে’ভিলিয়ার্সদের ঘাড়ে চেজ করার মাথাব্যথাটা চাপিয়ে দিল।

শ্রীলঙ্কার টিম সিলেকশন নিয়ে কেউ কেউ অবাক হলেও আমি হইনি। থারিন্ডু কৌশলের কথা বলছি। ওদের হাতে যখন ভাল পেস-বিকল্প নেই, তখন বাড়তি স্পিনার নেওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে ম্যাচের প্রথম বল পড়ার আগে তাই মনে হচ্ছিল, অ্যাডভান্টেজ শ্রীলঙ্কা। মনে হচ্ছিল, আড়াইশো প্লাস টার্গেট দিয়ে দিতে পারলে মোটামুটি নিরাপদ অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজের টিম। আর গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং যে রকম ঝকঝকে ছন্দে ছিল, তাতে এই রানটা ওদের কাছে প্রত্যাশিতই ছিল।

দ্বিতীয় ওভারে পেরেরা ফিরে যাওয়ার পর ছবিটা দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল। সত্যি বলতে কী, তার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও শ্রীলঙ্কাকে দেখে মনে হয়নি ওরা লড়াইয়ে আছে। ম্যাচটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এটা কোন শ্রীলঙ্কা? এদের সঙ্গে রোজকার শ্রীলঙ্কা টিমের কোনও মিল পাচ্ছি না কেন? মনে হচ্ছিল ওরা যেন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাঠে নেমেছে। শ্রীলঙ্কাকে এ রকম চাপে পড়ে যেতে অনেক দিন দেখিনি।

আমার মনে হয় বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টর ওদের স্বাভাবিক খেলাটাকে বেরিয়ে আসতে দেয়নি। এক, ওদের অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক মনোভাব। দুই, এটা সঙ্গকারা-জয়বর্ধনের শেষ ম্যাচ হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই চিন্তা মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করা। তিন, দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্দান্ত বোলিং আর ফিল্ডিং। এ সবের সঙ্গে যোগ করুন নকআউট খেলার স্বাভাবিক চাপ। সব মিলিয়ে টেনশনের প্রেশার কুকারে ঢুকে গেল টিমটা।

এ বারের বিশ্বকাপে একটা ফর্মুলা প্রায় সেট হয়ে গিয়েছে। প্রথম কুড়ি-পঁচিশ ওভারে বেশি রান না উঠলেও পরে সেটা তুলে নিচ্ছে টিমগুলো। শেষ দশ ওভারে গড়ে একশোর উপর রান উঠছে। টিমগুলো জানে, চল্লিশ ওভারে দুশোর আশেপাশে স্কোরটা রাখতে পারলে শেষ দশ ওভারে বড় শট মেরে সেটা ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। শ্রীলঙ্কাও আজ বোধহয় সেই মানসিকতা নিয়ে নেমেছিল। কিন্তু ফল হল উল্টো। শুরু থেকেই ডিফেন্সিভ হয়ে যাওয়ায় রান তো আসেইনি। উল্টে পরপর উইকেট চলে যাওয়ায় আরও বেশি করে চাপে ডুবে গিয়েছে টিম।

যে চাপটা থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও ওদের বেরোতে দেয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা। ইমরান তাহির, দুমিনিরা দুর্দান্ত বল করেছে। তাহির চার উইকেট নিল, দুমিনি তো আবার প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করল বিশ্বকাপে। তবে আমার সবচেয়ে ভাল লাগল ওদের ফিল্ডিং। দক্ষিণ আফ্রিকাকে কেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ডিং সাইড বলা হয়, এই প্রথম যেন সেটা প্রমাণ করল ওরা। বিশেষ করে সঙ্গকারার বিরুদ্ধে ওদের গেমপ্ল্যান অসাধারণ। ও শুরু থেকে কখনওই বড় শট মারে না, এক বা দু’রান নিয়ে আস্তে আস্তে সেট হয়। তা সেই সময়টায় ক্লোজ-ইন ফিল্ডার বাড়িয়ে ওর সিঙ্গলস নেওয়া আটকে দিল এবি। উইকেট পড়লে সার্কেলের মধ্যে ফিল্ডার আরও বাড়িয়ে দিল। এই অবস্থায় ব্যাটসম্যান যদি ভাবে এখন ধরে খেলি, পরে মারব, তা হলে আরওই চোরাবালিতে ডুবে যাবে।

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকান স্পিনারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স কি নিয়তির ব্যঙ্গ? হতে পারে। কিন্তু এই বিশ্বকাপে স্পিনাররা যে এত ভাল বল করছে, সেটা মোটেও নয়। অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে স্পিনারদের ভূমিকা খুব বড় হবে না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এক মাসের মধ্যে সেই ধারণা বদলে দিয়েছে অশ্বিন, তাহির। প্রথম দিকে রঙ্গনা হেরাথ-মইন আলি, ম্যাক্সওয়েলের পার্ট-টাইম স্পিন। আর ড্যানিয়েল ভেত্তোরির ইকনমি রেট তো এ বার অন্যতম সেরা।

বিশ্বকাপে স্পিনারদের সাফল্যের রহস্য আমার মতে ওদের অ্যাটাকিং মনোভাব। ভেত্তোরি বা অশ্বিন বল করছে একটা স্লিপ নিয়ে, অ্যাটাকিং ফিল্ড নিয়ে। আসলে ওরা জানে যে, নতুন নিয়মের ধাক্কায় সব বোলারই মার খাচ্ছে। তাই বেশি রান দিলেও তার খুব বেশি সমালোচনা হবে না। তাই রান আটকানো নয়, উইকেট নেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বল করছে ওরা। প্লাস সার্কেলে পাঁচ ফিল্ডার থাকার ফলে ব্যাটসম্যানকে আক্রমণও করা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ‘রান দেব না’ মনোভাব নিয়ে নামলে রান আটকানো বা উইকেট নেওয়া কোনওটাই হয় না। সেটা বুঝে বল করছে বলেই অশ্বিনরা এত সফল। তার উপর সবাই যে ওদের অঙ্কের বাইরে রেখেছিল, সেটা নিশ্চয়ই একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করেছে।

সব শেষে সঙ্গা আর মাহেলার কথা বলি। ওরা খেলাটার সবচেয়ে বড় দু’জন অ্যাম্বাস্যাডর। শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই রোল মডেল। দু’জনেই খুব শিক্ষিত, নম্র, দু’জনেই খুব ভাল কথা বলতে পারে। ওদের অবসর ওয়ান ডে বিশ্বের কাছে বড় ক্ষতি সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি আমার একটা ভবিষ্যত্‌ লাভের কথা ভাবছি।

মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়িই সঙ্গাকে কমেন্ট্রি বক্সে সঙ্গী হিসেবে পাব!

সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা ৩৭.২ ওভারে ১৩৩ (সঙ্গকারা ৪৫, থিরিমান্নে ৪১, তাহির ৪-২৬, দুমিনি ৩-২৯)
দক্ষিণ আফ্রিকা ১৮ ওভারে ১৩৪-১ (ডি’কক ৭৮ ন:আ:)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

world cup 2015 deep dasgupa sangakkara
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE