Advertisement
০৭ মে ২০২৪

বিরাটদের ব্যর্থতায় আশঙ্কা ইডেনে

দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় ইডেন গ্যালারিতে যত লোক দেখা গেল, মহালয়ার সকালে বাবুঘাটে পিতৃতর্পণের ভিড় তার চেয়েও বেশি! দেবীপক্ষ পড়ার দিন ইডেনে টেস্ট শুরু হলে যা হয়। ক্রিকেট তো এখন সারা বছরের উৎসব। দুর্গোৎসব বছরে একবারই।

বিরাট প্রস্থান।ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

বিরাট প্রস্থান।ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

রাজীব ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:২২
Share: Save:

দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় ইডেন গ্যালারিতে যত লোক দেখা গেল, মহালয়ার সকালে বাবুঘাটে পিতৃতর্পণের ভিড় তার চেয়েও বেশি!

দেবীপক্ষ পড়ার দিন ইডেনে টেস্ট শুরু হলে যা হয়। ক্রিকেট তো এখন সারা বছরের উৎসব। দুর্গোৎসব বছরে একবারই। তাই শহরবাসী এই সময়ে ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে না-ই বা কেন?

তর্পন সেরে ইডেন ক্লাব হাউসে ঢুকতে ঢুকতে এক প্রবীণ ক্রিকেটভক্ত বলছিলেন, ‘‘প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ইডেনে টেস্ট দেখছি ভাই। কখনও এমন পুজোর মুখে টেস্ট হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না।’’

ইতিহাস ঘেঁটেও তা-ই দেখা গেল। সেপ্টেম্বরে ইডেন টেস্ট? নৈব নৈব চ। জানা গেল, ১৯৬৪-তে নাকি ১৭ অক্টোবর ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট শুরু হয়েছিল। আর সে জন্য নাকি অনেক ক্ষোভ-বিক্ষোভও দেখা দিয়েছিল শহরের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে। সে বছর টেস্টের প্রথম দিন ছিল একাদশী। বাবুঘাটে ভাসান আর ইডেনে টেস্ট একসঙ্গে সামলাতে হিমশিম খেয়েছিল কলকাতা পুলিশ।

ক্রিকেট মরসুমে এর আগে এই শহরে এই সময়ে টেস্ট কেন, ওয়ান ডে ম্যাচও হয়নি। এ বারই প্রথম সব প্রথা ভেঙে সেপ্টেম্বরে টেস্ট। তাই উইকেটের অবস্থাও প্রথাগত ইডেনের উইকেটের চেয়ে আলাদা। যেটা ভারতীয় ক্রিকেটাররাও বলছেন। একটা সময় টানা বৃষ্টি, রোদের অভাব, আর্দ্রতা— সব মিলিয়ে কিছুটা বদলে দিয়েছে ইডেনের উইকেটকে। উপরে কঠিন। ভিতরে কিছুটা কাঁচা। তাই এমন বাউন্সও হচ্ছিল, যা অনুমান করা কঠিন।

কিন্তু তা বলে শিরশিরানি ধরিয়ে দেওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু ভারতীয় ব্যাটিংয়ে দু’জন ছাড়া বাকিদের দেখে মনে হল ঠকঠকানি হচ্ছে। টস জিতেও দিনের শেষে বিরাট কোহালিদের স্কোর ২৩৯-৭। কানপুরে প্রথম দিন ন’উইকেট খুইয়েও দেশের ৫০০তম টেস্ট জিতেছিল ভারত। সেই যুক্তিতে দেশের মাঠে আড়াইশোতম টেস্টও জেতা উচিত। কিন্তু গ্রিনপার্ক আর ইডেনের বাইশ গজের চরিত্রে ফারাক আছে যে। এই উইকেট অশ্বিন-ম্যাজিকের আদর্শ মঞ্চ কি না, সে কথা বলার ঝুঁকি এখন কেউ নিতে চাইছেন না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য আগেই বলেছিলেন, দু’দিন উইকেটে ক্যারি থাকবে, বল সিম করবে। তাঁর বোঝাটা ঠিকই ছিল। কিন্তু কোহালিরা বোধহয় ততটা ভাল বুঝতে পারেননি উইকেট-চরিত্র।

কোহালি আগের দিন বলেছিলেন, ‘‘এই উইকেটে ভাল ব্যাট করা যাবে, যেমন ইডেনে সাধারণত হয়।’’ কিন্তু অজিঙ্ক রাহানে দিনের শেষে বলে দিলেন, ‘‘টিপিকাল ইডেন উইকেট এটা নয়। আমরা ভেবেছিলাম সে রকমই পাব। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর দেখলাম, অন্য রকম। ডাবল পেসড্ উইকেট।’’

সারা দিনে ২৩৯-এর মধ্যে ১৪১-ই তুলে দিলেন চেতেশ্বর পূজারা (৮৭) ও অজিঙ্ক রাহানে (৭৭) জুটি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইডেন গ্যালারিতে লোক বাড়লেও ভারতের রান কিন্তু তেমন বাড়ল না।

দেবীপক্ষের প্রথম সকালে পছন্দের উইকেট পেয়ে লাল চেরি হাতে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের যে রকম রক্তচক্ষু দেখাতে শুরু করেছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরিরা, তা যেন জঙ্গিদের উপর ভারতীয় সেনার ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর মতোই আগ্রাসী। যা সামলাতে পারলেন না মুরলী বিজয়, শিখর ধবন। এমনকী বিরাট কোহালিও।

শিখর ধবন যে ভাবে হেনরির শর্ট বল না এগিয়ে, না পিছিয়ে তেরছা ব্যাটে খেলতে গিয়ে বল স্টাম্পে টেনে নিলেন, তার পর রাহানের কথাটা সত্যিটা বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। গত দু’দিনে ধবন নেটে ও নেটের বাইরে শর্ট বলে প্রচুর প্র্যাকটিস করলেও ম্যাচে সেটা করে দেখাতে পারলেন কই? বলের পেসটাই বুঝতে পারলেন না।

ভোরে রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রর পর সকালেবেলায় টিভিতে বীরেন্দ্র সহবাগ। ধবন আউট হওয়ার পর তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘‘ওর হয়তো রিফ্লেক্সে সমস্যা হচ্ছে, যা ওকেই শোধরাতে হবে। কেউ সাহায্য করতে পারবে না।’’ ভারতীয় দলের ‘গব্বর’ দ্বিতীয় ইনিংসে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে না পারলে যে ইন্দওরে ফের গৌতম গম্ভীরকে এগারোয় আনার দাবি উঠতে পারে, তার ইঙ্গিত এ দিনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ওঠা এক ঝাঁক প্রশ্নেই রয়েছে।

কিন্তু ভারত অধিনায়ক এ দিন ট্রেন্ট বোল্টের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলকে যে ভাবে স্লাইস করতে গিয়ে গালিতে টম ল্যাথামের হাতে ধরা পড়লেন, সেটা বোধহয় রোহিত শর্মা, ধবনের আউটের চেয়ে অনেক বড় ‘ক্রাইম’।

পরপর তিন ইনিংসে কোহালি একই ভাবে অযথা শট নিতে গিয়ে ফিরে যাওয়া দেখেও তাঁর সদ্য দ্রোণাচার্য পুরস্কার পাওয়া কোচ রাজকুমার শর্মা ফোনে বলছেন, ‘‘এটা ব্যাড প্যাচ বা খারাপ পারফরম্যান্স কোনওটাই না। ক্রিকেটে আউট তো এক সেকেন্ডের ভুলেই হয়। যে কোনও ব্যাটসম্যানেরই হতে পারে। বিরাটকে একটা ভাল ইনিংস খেলতে দিন। ও আবার রানে ফিরবে।’’ ক্যারিবিয়ান্সে ডাবল সেঞ্চুরির পর ছ’টা ইনিংসে কোহালির রান ৯৪।

দুপুরে দ্বিতীয় সেশনটাই ছিল এই ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়। ভারত ডুববে, না ভেসে থাকবে, তা নির্ভর করছিল এই সেশনের উপরই। আর এই দু’ঘণ্টাতেই হাল ধরেন পূজারা ও রাহানে। অসাধারণ প্লেসিং, নিখুঁত শট বাছাই— ভাল পার্টনারশিপের নিখুঁত রেসিপিই ছিল এই দুই ব্যাটিং মায়েস্ত্রোর কাছে। মাঝের দু’ঘণ্টায় কিউয়িদের টাইট বোলিং সামলে নিয়মিত বাউন্ডারি হাঁকিয়ে যাচ্ছিলেন দু’জনে।

পূজারা আশি পেরনোর পরই রাজকোটে তাঁর বাবা অরবিন্দ টিভির সামনে থেকে উঠে যান। ফোনে বলছিলেন, ‘‘আমিই খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম তখন। বিশ্বাস করুন, মন বলছিল ও একশো ছুঁয়ে ফেলবে। কিন্তু দেখছিলাম, ও ক্রমশ চাপে পড়ে যাচ্ছে। সেজন্যই আর টেনশনটা নিতে পারলাম না।’’ রাহানে বললেন, ‘‘একজন যদি একটা সেঞ্চুরি পেয়ে যেতাম, তা হলে দিনের শেষে ছবিটাই অন্য রকম হত।’’ তা আর হল কই? রাহানের কোচ প্রবীণ আমরের অবশ্য আফসোস নেই। বলছেন, ‘‘সেঞ্চুরি পায়নি তো কী হয়েছে? দলকে বিপদ থেকে তো বাঁচিয়েছে। ব্যাটসম্যানদের এটাই ধর্ম।’’

ইডেনে এখন আশা ঘরের ছেলে ঋদ্ধিমান সাহা। যিনি জিতেন পটেলকে লং অনের উপর দিয়ে দিনের একমাত্র ছয়টা মেরে আশা জিইয়ে রেখেছেন।

দেবীপক্ষের দ্বিতীয় সকালে ঋদ্ধির ব্যাটে কোহালিরা সিদ্ধিলাভ করেন কি না, সেটা যেমন বড় প্রশ্ন, তার চেয়ও বড় প্রশ্ন অবশ্য অশ্বিন-জাদু নিয়ে।

পি সি সরকারের শহর এখন জাদুকর অশ্বিনের অপেক্ষায়।

ইডেন টেস্টের স্কোর

ভারত

প্রথম ইনিংস:

ধবন বো হেনরি ১,

বিজয় ক ওয়াটলিং বো হেনরি ৯,

পূজারা ক গাপ্টিল বো ওয়্যাগনার ৮৭,

বিরাট ক ল্যাথাম বো বোল্ট ৯,

রাহানে এলবিডব্লিউ পটেল ৭৭,

রোহিত ক ল্যাথাম বো পটেল ২,

অশ্বিন এলবিডব্লিউ হেনরি ২৬,

ঋদ্ধিমান ন.আ. ১৪,

জাডেজা ন.আ. ০,

অতিরিক্ত ১৪,

মোট ২৩৯-৭।

পতন: ১, ২৮, ৪৬, ১৮৭, ১৯৩, ২০০, ২৩১।

বোলিং: বোল্ট ১৬-৮-৩৩-১, হেনরি ১৫-৬-৩৫-৩,

ওয়্যাগনার ১৫-৫-৩৭-১, স্যান্টনার ১৯-৫-৫৪-০, পটেল ২১-৩-৬৬-২।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eden garden Virat Kohli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE