Advertisement
০২ মে ২০২৪
যাত্রা শুরুর সেই স্মরণীয় মাঠে এ বার ইতিহাসের হাতছানি

সতীর্থদের চোখে জয়ের নেশা দেখছেন কোহালি

সেই সফরে চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করার পর থেকেই পাল্টে যাওয়া এক ক্রিকেটার কোহালি। সিডনিতে ধোনির উত্তরসূরি হিসেবে প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দিতে নেমেও কোহালি প্রথম ইনিংসে ১৪৭ রানের দুরন্ত ইনিংস খেলেন।

বিরাট কোহালি।

বিরাট কোহালি।

সুমিত ঘোষ 
সিডনি শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৩০
Share: Save:

চার বছর আগে এখানেই অধিনায়ক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু। মেলবোর্ন টেস্টের পরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে আচমকা সরে দাঁড়ালেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সেই সময়ে ভারত টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে ছয় নম্বরে। কে জানত, চার বছরের মধ্যেই বিরাট কোহালির নেতৃত্বে তারা সিডনিতে ফিরবে র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর দল হিসেবে।

সেই সফরে চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করার পর থেকেই পাল্টে যাওয়া এক ক্রিকেটার কোহালি। সিডনিতে ধোনির উত্তরসূরি হিসেবে প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দিতে নেমেও কোহালি প্রথম ইনিংসে ১৪৭ রানের দুরন্ত ইনিংস খেলেন। প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া ৫৭২ রানের বিশাল স্কোরে পৌঁছে যায়। এখনকার দুই নির্বাসিত তারকা স্টিভ স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নার— দু’জনেই সেঞ্চুরি করেন। সিডনি দু’জনেরই নিজের শহর। কিন্তু কোহালি পাল্টা জবাব দিয়ে নিশ্চিত করেন যে, হার দিয়ে শুরু হবে না পাকাপাকি টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তাঁর যাত্রা।

সিডনির ওই টেস্টের পর থেকে যত দিন গিয়েছে, ততই চওড়া হয়েছে কোহালির ব্যাট। বিশ্বের সর্বত্র রান করে দেখিয়েছেন। সেই ড্র টেস্ট নিয়ে বলতে গিয়ে এ দিন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন ভারত অধিনায়ক। ‘‘সেই সময় আমরা ছিলাম ছয় কি সাত নম্বরে। সেখান থেকে আজ এক নম্বরে উঠে এসেছি। সেটা ছিল আমাদের ক্রিকেটে পরিবর্তনের সময়। ছেলেরা যে কত ভাল ভাবে সেই অধ্যায়টা সামলেছে, তা সকলে দেখতেই পাচ্ছে।’’

সে বার সিডনিতে নিউ ইয়ার টেস্ট খেলতে আসা অধিনায়ক কোহালি এখনকার মতো বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার ছিলেন না। সবে মিচেল জনসনকে পাল্টা প্রত্যাঘাতে চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করা দেখে ক্রিকেট বিশ্ব নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। এখন প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনগুলি ব্যাটিংয়ের মতোই তাঁর ডাকাবুকো চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। এ দিন যেমন বলে গেলেন, ‘‘আমরা জয়কে একটা নেশা হিসেবেই ধরি। শুধু আমি একাই আবেগপ্রবণ আর এ রকম ভাবি, তা নয়। দলের সকলে এই নেশা নিয়ে ছুটছে। মেলবোর্নে জেতার পরে যে রকম আবহ ছিল আমাদের ড্রেসিংরুমে, তা কখনও দেখিনি। গোটা টিমকে এত উত্তেজিত হতে আমি আর কখনও দেখিনি।’’

যখন বলছেন, মনে পড়ে যাচ্ছিল, এক দিন অস্ট্রেলীয় অধিনায়কদেরই ‘নির্মম আর ভয়ডরহীন’ বলা হত। সেটা যেন পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়েছে। নিজের দক্ষতার প্রতি অসম্ভব বিশ্বাস আর দলকে নিয়ে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী না হলে বলা যায় না, ‘‘আমাদের দলের মধ্যে সকলে জয়ের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। সকলের চোখে আমি জয়ের নেশা দেখতে পাচ্ছি। আর সেটা আছে বলেই দু’টো জয়েই কেউ থামতে চায় না।’’ মেলবোর্নে জিতে কোহালির দল নিশ্চিত করে ফেলেছে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি তাঁদের কাছেই থাকছে। শেষ বার ভারতের মাটিতে তাঁরাই সিরিজ জিতেছিলেন। এ বার ২-১ হয়ে থাকা সিরিজ হারার আর ভয় নেই। কিন্তু কোহালি বলে দিচ্ছেন, এটাকে সিরিজের চতুর্থ টেস্ট হিসেবে দেখছেনই না। ‘‘এটা আমাদের কাছে আর একটা টেস্ট। আর একটা সুযোগ,’’ বলে দিচ্ছেন তিনি। প্রশ্ন করা হল তাঁর কোমরের চোট নিয়ে। উদ্বিগ্ন হওয়ার লক্ষণই দেখালেন না। বলে দিলেন, ‘‘সাত বছর ধরে এই সমস্যাটা রয়েছে। নতুন নয়। মাঝেমধ্যে সামান্য অস্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু বড় কিছু ব্যাপার নয়।’’

অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকেরা এত কাল তাঁদের ক্রিকেট দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সফরকারী ক্যাপ্টেনদের দিকে মিসাইল ছুড়েছে। কিন্তু কোহালিকে নিয়ে অবিশ্বাস্য রকম সম্ভ্রমের বাতাবরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ দিন ভারত অধিনায়ক যখন ড্রেসিংরুম থেকে নিজের কাঁধে ভারী কিটব্যাগ নিয়ে নেমে আসছেন প্র্যাক্টিস করতে, এক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিককে বলতে শোনা গেল, ‘‘বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার। কিন্তু নিজের ব্যাগটা ঠিক নিজে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাট করতে নামার সময়ে যার সঙ্গে বডিগার্ড থাকে যাতে কেউ বিরক্ত করতে না পারে, সে তো কাউকে একটা বলতেই পারে, আমার ব্যাগটা মাঠে নিয়ে যাও।’’ এর পর তাঁর চোখ আরও বড় বড় হয়ে গেল যখন দেখলেন, ভারতীয় দলের ট্রেনার শুরুতেই তিন জনকে ইয়ো ইয়ো টেস্ট দিতে বললেন। তিন জনের মধ্যে সবার প্রথমে অধিনায়ক স্বয়ং। অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক বলে উঠলেন, ‘‘এত ফিট ভারতীয় দল আর কখনও আমরা অস্ট্রেলিয়ায় আসতে দেখিনি। এখন বুঝতে পারছি, এর পিছনে কার হাত। বুঝতে পারছি, কী করে ঘণ্টায় একশো পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার গতিবেগে বল করা এতগুলো পেসার একসঙ্গে উঠে এসেছে ভারত থেকে। ফিটনেস বিপ্লবেই সম্ভব হয়েছে এই সাফল্য।’’

স্বাধীনতার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়া সফর করছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। আজ পর্যন্ত কোনও অধিনায়ক এখান থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফেরেননি। কোহালির সামনে ইতিহাসের হাতছানি। কী বলছেন ছেলেদের? ‘‘কিছুই বলার দরকার পড়ছে না। সকলে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সকলে স্বপ্ন দেখতে জানে। সকলে চাইবে দারুণ ভাবে সিরিজ শেষ করে উৎসব করতে। যাতে অনেক দিন পরেও ফিরে তাকিয়ে এই মুহূর্তটার কথা ভেবে গর্বিত হওয়া যায়।’’ অন্তরের কত গভীর থেকে তিনি জিততে চান, তা বোঝা যায় এর পরের কথাগুলিতে। ‘‘এটা বিরাট এক সিরিজ জয় হবে শুধু আমার জন্য নয়, গোটা দলের কাছে। এখানেই শুরু হয়েছিল আমাদের দলের পরিবর্তন। ছয়-সাত নম্বর থেকে এক নম্বর হয়েছি আমরা। আমরা সকলে চাই, এক নম্বরের আসনকে ধরে রেখে পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।’’

তাঁর জীবনে একটা বৃত্তই যেন সম্পূর্ণ হতে যাচ্ছে সিডনিতে। অধিনায়কত্বের চার বছর। বিশ্বের সর্বত্র হেরে বেড়ানো একটা দল থেকে বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল। ব্যক্তিগত জীবনের কত উথালপাতালের তো সাক্ষী অস্ট্রেলিয়া। চার বছর আগে এখানে আসার আগে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবং জনতার একাংশ তীব্র আক্রমণ করছে বান্ধবী অনুষ্কাকে। ইংল্যান্ডে বিপর্যস্ত সফরের জন্য সকলে দায়ী করছে বান্ধবীকে।

ভারতীয় বোর্ড থেকে বিশেষ অনুমতি জোগাড় করে অনুষ্কাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এলেন কোহালি। তাঁকে বললেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ায় তুমি থাকবে। সকলের সামনে সেঞ্চুরি করব আর তোমাকে সেগুলো উৎসর্গ করব।’’ তার পর এক-একটা করে সেঞ্চুরি করতে থাকলেন আর ব্যাট বাড়িয়ে ‘ফ্লাইং কিস’ দিতে থাকলেন অনুষ্কার দিকে। সে দিনের বান্ধবী এখন তাঁর স্ত্রী। সিডনিতে এ বারও নতুন বছর উপলক্ষে এসেছেন অনুষ্কা। শোনা গেল, তারকার পৃথিবী থেকে ছুটি নিয়ে দু’জনে মিলে সিডনির খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে পড়ছেন। রেস্তরাঁয় খেতেও গিয়েছিলেন নিরাপত্তা রক্ষীদের ছাড়াই। অস্ট্রেলিয়ায় কোহালি মানেই তিনি একা নন বা শুধুই ক্রিকেট নয়। যেমন মাঠে চলবে বাউন্ডারি, তেমন মাঠের বাইরে বাজবে প্রেমের গান।

একদম ‘ব্যান্ড, বাজা বিরাট’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE