স্পনসরের ফটোশ্যুটে ঢোকার কথা ছিল সন্ধে ছ’টায়। কমলা মোহক ছাঁটের মালিক রাজকীয় মেজাজে সেখানে হাজির হলেন ঝাড়া আড়াই ঘণ্টা পর।
কী ব্যাপার? না, রবিবার ভোররাত পেরিয়ে চলেছে কেকেআরের পার্টি। সে সব শেষ করে যখন ঘুমোতে গিয়েছেন, তখন সোমবার সকাল। আর আন্দ্রে রাসেল যে ঘুমোতে একটু বেশি ভালবাসেন এবং ঘুমিয়ে পড়লে একটু বেশিক্ষণই ঘুমোন, নাইট সংসারে কারও অজানা নয়। তাই তাঁর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে কারও আপত্তি দেখা গেল না।
এবং সেই অপেক্ষার পরে যে আন্দ্রে রাসেলকে পাওয়া গেল, তাঁকে দেখে কে বলবে, ইনিই রবিবার রাতের পার্টিতে ডান্স মাস্টারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন! নাইট টিমমেটদের তো বটেই, আপাত-সিরিয়াস জয় মেটা এবং বেঙ্কি মাইসোরকেও নাচিয়ে ছেড়েছেন! কী নাচ? কেন আবার, চ্যাম্পিয়ন!
‘‘আরে, ওঁরা তো বেশ ভালই নাচেন দেখলাম! আসলে নাচটা বেশ সহজ তো, তাই বোধহয় চ্যালেঞ্জটা নিতে পেরেছেন,’’ হাসতে হাসতে বলছিলেন রাসেল। আর টিম মালিক? শাহরুখ খানকে বিখ্যাত ওই নাচটা শিখিয়ে দেবেন না? ‘‘অফ কোর্স। শাহরুখকে তো নাচাতেই হবে।’’
কেকেআরের পার্টি না হয় রবিবার প্রথম ম্যাচ জেতার পর শুরু হয়েছে। তাঁর, আন্দ্রে রাসেলের উৎসব তো তার এক সপ্তাহ আগে থেকেই চলছে। কেমন কাটল এই সাতটা দিন? বাড়ি ফিরে কাপ-জয়ের আরও একপ্রস্ত সেলিব্রেশন হয়েছে নিশ্চয়ই? অবাক করে দিয়ে আন্দ্রে রাসেল বললেন, না, হয়নি। ‘‘বিশ্বাস করুন, বেশি কিছুই করিনি। বাড়ি ফিরে শুধু পরিবারের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটালাম। বিশেষ কিছু সেলিব্রেশন করতে গিয়ে সময় নষ্ট করিনি। যতক্ষণ পেরেছি, আমার পরিবারের সঙ্গে সাধারণ ভাবে থাকার চেষ্টা করেছি। আসলে এই তো আবার বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হল। ফিরতে ফিরতে আরও দু’মাস।’’
উত্তরটার সঙ্গে উৎসবপ্রিয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মানসিকতা মেলাতে একটু অসুবিধে হচ্ছে? পরের মন্তব্যগুলো শুনলে আরও চমকে যেতে হবে। এর পরই তো রাসেল বলতে শুরু করে দিলেন, ‘‘হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা আমাদের জন্য দারুণ ছিল। জানি না, টিমের বাকিরা হয়তো এখনও সেটা সেলিব্রেট করছে। আমিও মনে মনে কিছুটা যে করছি না, তা নয়। কিন্তু ওই জয়টা আস্তে আস্তে অতীত হয়ে যাচ্ছে আমার কাছে।’’
জয়ের রেশটা ফিকে হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বিশ্বজয়ের রাস্তার প্রতিটা হোঁচট, প্রতিটা হার্ডল এখনও টাটকা ঘায়ের মতো বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর ক্যাপ্টেন ডারেন স্যামি বলেছিলেন, কী ভাবে জার্সি ছাড়াই বিশ্বকাপ খেলতে আসতে হয়েছিল তাঁদের। আর এ দিন টিম হোটেলের প্রাচুর্যের মধ্যে বসে রাসেল স্বগতোক্তির মতো বলে যাচ্ছিলেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট-সংসারের অভাব-অনটনের কথা। বলছিলেন, বিশ্বের বাকি টিমের কাছে যেগুলো খুব স্বাভাবিক, তার কিছুই পায়নি তাঁর টিম। ‘‘জানেন, আমাদের দেশে ক্রিকেটের পরিবেশটা এখন এমন যে, কোনও বিলাসিতায় আমরা অভ্যস্ত নই। বিলাসিতা মানে বলতে চাইছি, এই যে বাকি টিমগুলো সব কিছু সময়ের মধ্যে হাতের কাছে তৈরি পেয়ে যায়, আমরা সেটা পাই না। যে জিনিসগুলো পাই, জানি যে সেগুলো মোটেও সেরা নয়। কোনও দেশের জাতীয় দলকে এমন অবস্থায় পড়তে হয়েছে? বিশ্বকাপ খেলতে নামছি, অথচ কেউ একটা কিটব্যাগ পর্যন্ত পাইনি।’’
অভাবের ক্যারিবীয় সংসার আর শাহরুখ খানের কেকেআরে বাহ্যিক পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আন্দ্রে রাসেলের কাছে দু’দলের বহিরঙ্গ এক। কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর কেকেআর, দুটো টিমই তাঁর কাছে পরিবারের মতো। দুটো টিমেই তিনি সমান স্বচ্ছন্দ, সমান স্বাধীন। প্রাপ্য টাকা না পেয়েও দেশের কথা ভেবে যেমন তিনি বিশ্বকাপ খেলতে নেমে পড়েন, তেমন দীর্ঘ বিমানযাত্রার প্রচণ্ড ধকল উপেক্ষা করে নাইট জার্সিতে খেলতে নামেন। নেমে তিন উইকেট তুলে নেন, সঙ্গে ম্যাচ সেরার পুরস্কারটাও। ‘‘গতকাল সকালে প্রচণ্ড জেটল্যাগে ভুগছিলাম। কিন্তু জানতাম টিমের কাছে প্রথম ম্যাচটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আর কাল যে ভাল বল করলাম, তার পিছনে গম্ভীরেরও কৃতিত্ব রয়েছে। প্রথম ওভারে তেরো রান দিলাম, তার পরেও যে ও আমাকে বল দিল, অনেক ক্যাপ্টেনই কিন্তু সেটা করত না। গম্ভীর এমন একজন অধিনায়ক যাকে আমি কোনও দিন হতাশ করতে পারব না।’’
গত বছর দারুণ শুরু করেও শেষ লেগে ছিটকে গিয়েছিল কেকেআর। এ বার সেটা আটকানোই গম্ভীরের টিম থিম। রাসেল যেমন বলছিলেন, তাঁর ক্রিকেটে আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। টিম জিতুক বা হারুক। তাঁর ক্রিকেট-দর্শন বলে, জয়ের মধ্যেও ঢিলে দেওয়া চলবে না। কোনও দিন প্র্যাকটিসে যেতে ইচ্ছে না করলেও প্র্যাকটিসে যেতে হবে। ‘‘আমি বিশ্বাস করি ক্রিকেটের সঙ্গে যে ব্যবহারটা তুমি করবে, ক্রিকেট তোমাকে সেই ব্যবহারটাই ফিরিয়ে দেবে। তাই ভাল খেললে আমি আরও বেশি করে নেটে পড়ে থাকি। কারণ আমি মনে করি, শেখার কোনও শেষ নেই।’’
কে বলে, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট মানে শুধু নাচ-গান-সেলিব্রেশন? ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট মানে তো গভীর ক্রিকেট-বোধও। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট মানে তো চোয়ালচাপা যুদ্ধও। আর সাম্প্রতিকে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণস্পর্শ? আন্দ্রে রাসেল মারফত ওটা কেকেআরে আমদানি হয়ে যাক। তার পর শুধু শাহরুখ কেন, নাচের ক্লাসে ভিড় জমাবে একটা গোটা শহর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy