Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
’৮৩-র পরে ২০১৭, ইতিহাসের অপেক্ষা সেই লর্ডসে

কেউ পাত্তা না দিলেই জেদ বাড়ে

সচিন তেন্ডুলকর আমার প্রিয় মানুষ। ওঁর কাছ থেকে পুরস্কার নিয়েছি। পরিচয় আছে। কথাও বলেছি বেশ কয়েকবার। তা সত্ত্বেও ক্রিকেট আমার পছন্দের খেলা ছিল না কখনও।

মহারণ: অধিনায়ক ও তাঁর সেরা অস্ত্র। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ভারতের অনুশীলনে মিতালি রাজ এবং হরমনপ্রীত কৌর। শনিবার লর্ডসে। ছবি: রয়টার্স।

মহারণ: অধিনায়ক ও তাঁর সেরা অস্ত্র। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ভারতের অনুশীলনে মিতালি রাজ এবং হরমনপ্রীত কৌর। শনিবার লর্ডসে। ছবি: রয়টার্স।

দীপা কর্মকার
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৭ ০৭:১৮
Share: Save:

ওদের কারও সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি। মাঝেমধ্যে ওদের নাম শুনি। কিন্তু ঝুলন গোস্বামী, মিতালি রাজ বা হরমনপ্রীত কৌর— ওদের হাতে বিশ্বকাপ দেখার জন্য আজ আমরা, মেয়ে জিমন্যাস্টরা গলা ফাটাব।

আমি এখন আছি দিল্লির জাতীয় জিমন্যাস্টিক্স শিবিরে। সাইয়ের হোস্টেলে থাকি। ঘরে কোনও টিভি নেই। টিভি আছে ডাইনিং হলে। তাই ইচ্ছে থাকলেও মেয়ে ক্রিকেট দলের একটা খেলাও দেখা হয়নি। কিন্তু আজ ফাইনালটা আমরা শিবিরে থাকা মেয়েরা একসঙ্গে বসে দেখব বলে ঠিক করেছি। আমরা মানে প্রণতি দাশ, প্রণতি নায়েক-রা। প্রার্থনা করব, যেন ভারত জেতে। তবে সেটা শুধু ক্রিকেটে জয়ের জন্য নয়, ফের নারীশক্তির উত্থান দেখার আশায়।

সচিন তেন্ডুলকর আমার প্রিয় মানুষ। ওঁর কাছ থেকে পুরস্কার নিয়েছি। পরিচয় আছে। কথাও বলেছি বেশ কয়েকবার। তা সত্ত্বেও ক্রিকেট আমার পছন্দের খেলা ছিল না কখনও। বরং আমি মনে করি ক্রিকেটের রমরমার জন্য অন্য খেলাগুলো মার খাচ্ছে। তবুও আজ আমি ঝুলনদের জয় চাই। মেয়েরাও যে পারে, এটা আরও একবার প্রমাণ করার জন্য লর্ডসে ট্রফিটা দরকার।

আরও একটা কারণ আছে ওদের সমর্থন করার। আর তা হল, আমার মতো ওদেরও কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি বিশ্বকাপের আগে। আমি অল্পের জন্য পদক পাইনি রিও-তে। কিন্তু এখান থেকে ব্রাজিলে যাওয়ার আগে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘‘আগে ফাইনালে উঠুক, তার পর পদকের কথা ভাবা যাবে।’’ বিশ্বমঞ্চে কিছু করে দেখানোটা যে কত কঠিন, সেটা না বুঝেই এ সব বলা হচ্ছিল।

তবে তাতে লাভই হয়েছিল। সেটা আমার এবং আমার কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার করা প্রোদুনোভা ভল্ট নিয়েও তো কটাক্ষ শুনেছি কত। হয়তো মেয়ে এবং সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসেছি বলেই এত সমালোচনা হজম করতে হয়েছিল। ঝুলন-মিতালিদেরও কেউ পাত্তাই দেয়নি ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে। ছেলেদের ক্রিকেট টিম নিয়ে যে উদ্দীপনা দেখানো হয়, সেটার ধারেকাছেও যায়নি ঝুলনদের ঘিরে প্রচার। তবুও ওরা দেশকে গর্বিত করেছে। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠাটাই একটা বিশাল ব্যাপার। আমি চেষ্টা করেও পদক আনতে পারিনি। যদি মেয়েদের ক্রিকেট টিম চ্যাম্পিয়ন হয় তা হলে পদক পেলে যে আনন্দটা পেতাম সেটাই পাব।

আমি মনে করি খেলার মাঠে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা পিছিয়ে এই ধারণাটা ভাঙতে শুরু করেছে। সানিয়া মির্জা, সাইনা নেহওয়ালরা নারীশক্তির যে জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন, রিও অলিম্পিক্স তা আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে পিভি সিন্ধু, সাক্ষী মালিকরা। সিন্ধু বা সাক্ষী যে দিন পদক পেল সে দিন যে কী আনন্দ হয়েছিল, বোঝাতে পারবো না। নিজের পদক খোয়ানোর দুঃখ ভুলে গেমস ভিলেজে ওদের অভিনন্দন জানিয়ে এসেছিলাম। বিশেষ করে সাক্ষীকে। কত প্রতিকূলতা সহ্য করে ও পদকটা পেয়েছিল ভাবলে অবাক লাগে। আজ আবার সে রকম একটা দিন। মেয়েদের দেখিয়ে দেওয়ার দিন।

ভারতের প্রথম মেয়ে জিমন্যাস্ট হিসেবে আমি অলিম্পিক্সে সুযোগ পাওয়ার আগে সে ভাবে জিমন্যাস্টিক্স নিয়ে কেউ ভাবতই না। এখন তো শুনি ঘরে ঘরে লোক জিমন্যাস্টিক্স, প্রোদুনোভা নিয়ে আলোচনা করে। ঝুলনদের এই সাফল্য মেয়েদের ক্রিকেটকেও নিশ্চয়ই এক ধাক্কায় অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছেলেদের মতো পাড়ায় পাড়ায় ব্যাট হাতে নামবে এ বার মেয়েরাও। এমনিতে ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস বা সাঁতারের মতো কয়েকটা খেলা বাদ দিলে সব খেলাতেই ছেলেদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমার প্রশ্ন, কেন মেয়েদের ফুটবল বা মেয়েদের ক্রিকেট সে ভাবে প্রচার পায় না। স্পনসররাও ছোটে শুধু ছেলেদের পিছনেই।

মেয়ে মানেই শুধু বিয়ে করবে, সংসার করবে, ছেলে-মেয়ে মানুষ করবে, সে দিন কিন্তু চলে গিয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্তে তো বটেই, নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি মেয়েরা কত বড় বড় সব পদে আছেন। কিন্তু খেলার মাঠে সেই রাজটা এত দিন ছিল না। সেটা এ বার শুরু হয়েছে।

সাইতেও দেখলাম সবাই হরমনপ্রীতের সেঞ্চুরি নিয়ে আলোচনা করছে। যা আগে কখনও দেখিনি। ক্রিকেটের প্রতি তেমন অনুরাগ না থাকলেও এটা ভেবে আমার ভাল লাগছে যে, মেয়েদের ক্রিকেট নিয়েও সবাই খোঁজ রাখছে। আমাদের টিম যদি ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, লর্ডসে ওড়াতে পারে জাতীয় পতাকা, তা হলে নারীশক্তির জয়ধ্বনি আরও বাড়বে।

সেই আশা নিয়েই আজ আমরা টিভির সামনে বসব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE