Advertisement
E-Paper

টাইব্রেকারে অনুমান ক্ষমতাই আসল

মনে পড়ছে, সে বার গোলকিপারদের টিভি ধারাভাষ্যকাররা মজা করে বলতেন ‘ড্রাকুলা’। কারণটা আরও মজার। আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকারের লেখায় রয়েছে, ড্রাকুলারা পবিত্র ‘ক্রস’ দেখলে ভয় পায়।

তরুণ বসু

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৮ ০৫:৪১
দুর্ভেদ্য: ক্রোয়েশিয়ার সুবাসিচ

দুর্ভেদ্য: ক্রোয়েশিয়ার সুবাসিচ

গত কয়েকটি বিশ্বকাপে অত্যাধুনিক বল গোলকিপারদের কাছে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুই প্রান্ত থেকে ভেসে আসা বল এতটাই বাঁক নিচ্ছিল, যে তা সামলাতে গিয়ে রীতিমতো সমস্যায় পড়ছিলেন গোলকিপারেরা।

মনে পড়ছে, সে বার গোলকিপারদের টিভি ধারাভাষ্যকাররা মজা করে বলতেন ‘ড্রাকুলা’। কারণটা আরও মজার। আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকারের লেখায় রয়েছে, ড্রাকুলারা পবিত্র ‘ক্রস’ দেখলে ভয় পায়। সে বার বিশ্বকাপেও গোলকিপাররা দুই প্রান্ত থেকে বিপক্ষ খেলোয়াড়ের ক্রস দেখলেই কেঁপে যাচ্ছিলেন। তাই এই নামকরণ।

রাশিয়ায় অবশ্য এ বার বল বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবুও নাম করা গোলকিপারদের অনেককেই নড়বড়ে দেখাল। যার মধ্যে রয়েছেন, স্পেনের গোলকিপার দাভিদ দা হিয়া, জার্মানির গোলকিপার ম্যানুয়েল নয়্যারের মতো বড় নাম। আসলে সব জায়গাতেই গোলকিপাররা দু’টো বিশেষ গুণকে কাজে লাগিয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে যান। ‘রিফ্লেক্স’ এবং ‘অ্যান্টিসিপেশন’ বা অনুমানক্ষমতা। এর সঙ্গে এক জন গোলকিপার নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান, তাঁর ফিটনেসকে কাজে লাগিয়ে। আমার ফুটবল-ভুবন আর ন্যয়ার, দা হিয়াদের ফুটবল বিশ্বে এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার কেন জানি এই দুই গোলকিপারকে দেখে মনে হয়েছে, বিশ্বকাপে এই দু’জনই তাঁদের সেরা ছন্দ পাননি ফিটনেসের অভাবে। তাই দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে ম্যানুয়েল নয়্যারের হাত থেকে বল বেরিয়ে যেতে দেখলাম। স্পেনের গোলকিপার দা হিয়াকেও রবিবার রাশিয়া ম্যাচে অনেক সময় দেখলাম, দুই প্রান্ত থেকে ক্রস উড়ে আসার সময়ে ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। ফুটওয়ার্কও ভাল লাগল না। এটা একমাত্র হতে পারে ফিটনেস লেভেল ঠিক জায়গায় না থাকলে। অবশ্য ফুটবলারদেরও দোষ দিই কী ভাবে? গর্ডন ব্যাঙ্কস, লেভ ইয়াশিনদের আমলে এক জন গোলকিপার ক্লাব ও দেশ মিলিয়ে গোটা বছরে যে পরিমাণ ম্যাচ খেলতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচ খেলতে হয় এ বারের বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া গোলকিপাররা।

ক্রোয়েশিয়ার আকিনফেভ।

আর্জেন্টিনার দুই গোলকিপার ফ্রাঙ্কো আর্মানি এবং কাবায়েরোকে দেখে আবার আমার মনে হল গোলকিপিংয়ের কিছু মূল ব্যাপারেই খামতি রয়েছে। অনেক সময়েই বলের উপর থেকে ওঁরা চোখ সরিয়ে নেওয়ায় সমস্যায় পড়েছে আর্জেন্টিনা। আমার চোখে এই বিশ্বকাপে যে গোলকিপার সব চেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন, তিনি কিন্তু এই সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্ত। তিনি হলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার গোলকিপার জো হাইয়োনো। ছেলেটা বারের উপরে চার ইঞ্চি উপরের বল তালুবন্দি করে যখন নিচে নামছে তখন ওর শরীর পুরো সোজা থাকতে দেখলাম। কী অসম্ভব নমনীয়তা শরীরের, দুর্দান্ত ফিটনেস এবং অসম্ভব অনুমানক্ষমতা। মেক্সিকোর গোলকিপার ওচোয়াও বেশ ফিট। ওঁর ‘রিফ্লেক্স’ও দেখার মতো। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে খেলেও ও বিপক্ষ ফুটবলারদের ত্রাস হয়ে উঠতে পেরেছে।

রবিবার বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে দু’টি ম্যাচই গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। রবিবারের দুই নায়ক দুই দলের গোলকিপার। রাশিয়ার ইগর আকিনফেভ এবং ক্রোয়েশিয়ার দানিয়েল সুবাসিচকে নিয়ে হইচই হওয়াটাই স্বাভাবিক। টাইব্রেকার আটকানোটা ফুটবল খেলার খুব বড় একটা কৃতিত্ব। তবে ওঁদের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার পাশাপাশিই চোখে পড়ল টাইব্রেকারের সময় ১৯টি শটের মধ্যে ১৫টাতেই গোলকিপার লাইন থেকে এগিয়ে এসেছিলেন। যা খেলার নিয়ম বিরুদ্ধ। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এ বারের বিশ্বকাপে রেফারিং হচ্ছে। তা হলে এই ভুলটা হবে কেন?

আমার মনে হয়, গোলকিপাররা এই অন্যায় সুবিধেটা নিচ্ছিলেন দু’টো কারণে। পেনাল্টি মারার সময় ফুটবলাররা সব সময় দুই কোণে বল পাঠাতে চান। এক জন গোলকিপার চান, লাইন বরাবর সমান্তরাল ভাবে না ঝাঁপিয়ে লাইন থেকে একটু সামনের দিকে কোনাকুনি ঝাঁপাতে। যাতে বলের নাগাল পাওয়া যায়। কারণ যেখান থেকে পেনাল্টি মারা হচ্ছে সেই জায়গা থেকে গোলের দুই কোণ একটা কাল্পনিক শঙ্কুর মতো। যত আগে গোলরক্ষক লাইন থেকে ঝাঁপ মেরে বলের কাছে পৌঁছতে পারবে, তত সম্ভাবনা বাড়ে পেনাল্টি বাঁচিয়ে ফেলার। গোলকিপাররা সেটা করতে গিয়েই একটু এগিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তবু এটা নিয়ম-বিরুদ্ধ এবং রেফারির চোখে পড়া উচিত ছিল। অথবা ভিডিয়ো রেফারিও টিভি দেখে বলতে পারতেন।

স্পেন বনাম রাশিয়া ম্যাচে আকিনফেভকে দেখছিলাম বলের দিক থেকে কখনও চোখ সরাননি। নজর করলে দেখবেন স্পেনের যে দু’জন পেনাল্টি নষ্ট করেছেন, তাঁরা কিন্তু মাথা নিচু করে আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিলেন কোন দিকে বলটা মারবেন। পেনাল্টি বা টাইব্রেকারের সময়ে গোললাইনে দাঁড়িয়ে গোলকিপারকে সবার প্রথমে এই মনস্তত্ত্বটাই ধরতে হয় যে, শট মারতে আসা ফুটবলার কোন দিকে মারতে পারেন। এখনকার দিনে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সব গোলকিপারই কিন্তু আগাম জেনে রাখেন, কে কোন দিকে বেশি পেনাল্টি মারেন। সেটাও সঠিক অনুমান করতে সাহায্য করে।

রাতের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালটায় লড়াইটাই যেন হয়ে দাঁড়াল দুই গোলকিপারের। টাইব্রেকারে দু’জনেরই হার-না-মনোভাব দেখলাম। ডেনমার্কের গোলকিপার ক্যাসপার স্কেমিশেল বলের থেকে চোখ সরাননি। দু’টো পেনাল্টি বাঁচিয়েছেন টাইব্রেকারে। কিন্তু ডেনমার্কের ফুটবলাররা পেনাল্টি নিলেন সোজা। তাই জেতা হল না তাঁদের গোলকিপারের। শেষ শটটায় রাকিতিচ গোল করে দেওয়ায় জিতে গেলেন ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার দানিয়েল সুবাসিচ। নক-আউট পর্বে যা শুরু হয়েছে দেখছি, এখান থেকে না গোলকিপারদের বিশ্বকাপ হয়ে দাঁড়ায়!

ফাইল চিত্র

Football বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ FIFA World Cup 2018
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy