লাতিন আমেরিকার ফুটবলের ছবি কি এখন এটাই?
লাতিন আমেরিকা বনাম ইউরোপ! ফুটবলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। এবং চিরকালই বিশ্বজয়ের টক্করটা চলত এক্কেবারে সমানে সমানে। দুই মহাদেশের ফুটবল ঘরানা আলাদা। খেলার শৈলি, ফুটবলদর্শনও আলাদা। তবে লড়াই ছিল সমানে-সমানে। সমানে সমানে বিশ্বকাপ যেত দুই মহাদেশে। কিন্তু চলতি শতকে সেই ছন্দের পতন ঘটে গিয়েছে। এখন ইউরোপেরই শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা উড়ছে বিশ্বকাপ-যুদ্ধে। ২০০২ সালের পর, কোনও লাতিন আমেরিকান দেশ আর বিশ্বকাপ জেতেনি।
পুরোন হিসেবটা একবার দেখে নেওয়া যাক। ১৯৩০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। সেই থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত, মোট ১৮টা বিশ্বকাপের মধ্যে ৯ বার কাপ গিয়েছে লাতিন আমেরিকায়, ৯ বার ইউরোপে। আর ১৯৬২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হিসেবটা আরও নিখুঁত। একবার ইউরোপ, পরের বার লাতিন আমেরিকা, তার পর আবার ইউরোপ,তার পর আবার লাতিন আমেরিকা... এ ভাবেই যাতায়াত করেছে বিশ্বকাপ।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
২০০২ সালে লাতিন আমেরিকায় শেষ বার বিশ্বকাপ নিয়ে গিয়েছিল ব্রাজিল। তার পর ২০০৬ সালে কাপ জেতে ইতালি। ‘এক বার এই মহাদেশ, আর এক বার অন্য মহাদেশ’— এই তথ্যে যাঁরা বুঁদ হয়ে ছিলেন, ২০১০ সালে তাদের অবধারিত বাজি ছিল ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা। কিন্তু হিসেব বদলে দিয়ে কাপ জেতে স্পেন। সেটাই স্পেনের প্রথম বিশ্বজয়।
তার পর ২০১৪-র বিশ্বকাপ হয়েছিল ব্রাজিলে। সে বারও কাপ নিয়ে গেল জার্মানি। সেমিফাইনালে দুরমুশ করল ব্রাজিলকে। ফাইনালে হারাল আর্জেন্টিনাকে। আর এ বার জিতল ফ্রান্স। অর্থাত্ ২০০৬ থেকে ২০১৮, টানা ৪টে বিশ্বকাপেই ইউরোপের বাজিমাত। এমনটা আগে কখনও ঘটেনি। ২০০৬ পর্যন্ত ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ যাওয়ার ফলটা যেখানে ছিল ৯-৯, ২০১৮ সালে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ১২-৯।
এখানেই প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে। লাতিন আমেরিকার ফুটবলটা কি তবে শেষ হয়ে গেল? এ বারের বিশ্বকাপে তো সেমিফাইনালে ওঠা চারটে দলের চারটেই ইউরোপের। দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা ১৬ দলের মধ্যে লাতিন আমেরিকান দল ছিল তিনটে। কনকাফাফের মেক্সিকোকে ধরলে তা চার।
তবে কি শুধুমাত্র ইউরোপে ফুটবলার সাপ্লাই-এর দেশ হয়ে উঠছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনারা? একেবারেই এর সঙ্গে একমত নন কিংবদন্তি চুনী গোস্বামী। প্রাক্তন অলিম্পিয়ান ফুটবলার আনন্দবাজারকে বললেন, “ইউরোপের দলগুলো ভাল। এ ছাড়া এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। মানসিকতার কোনও ঘাটতির প্রশ্নও নেই। এটা স্রেফ কো-ইনসিডেন্স। আর কিছু নয়।”
ময়দানে একসময়ের শিল্পী ফুটবলার হিসেবে পরিচিত সুরজিত্ সেনগুপ্ত টেনে আনছেন দিয়েগো মারাদোনার উদাহরণ। তিনি বললেন, “ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকা একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা যে রয়েছে— তা মারাদোনার প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা গিয়েছে বারবার। মারাদোনা চাইছিলেন, লাতিনের কোনও দল যেন জেতে। লাতিনের দলগুলোকে ভাবতে হবে— গত চার বিশ্বকাপ ধরে ইউরোপই শুধু চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে কেন। কোথাও পিছিয়ে পড়ছে তারা, বের করতে হবে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানি লাতিনের দুই সেরা দলকে হারিয়ে কাপ জিতেছে। নিজেদের দেশে জঘন্য ভাবে হারতে হয়েছে ব্রাজিলকে।”
লাতিন আমেরিকার সেরা ফুটবলাররা এখন ইউরোপেই নানা ক্লাবে খেলেন।
রক্ষণে একদা নির্ভরতার প্রতীক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের অবশ্য একটা অন্য থিওরি রয়েছে। তিনি বললেন, “এর এক নম্বর কারণ হল, ইউরোপের দলগুলো খুব ভাল। দু’নম্বর কারণ হল, এখন লাতিনের অধিকাংশ ফুটবলারই ইউরোপে খেলতে চলে যাচ্ছে। তিন নম্বর কারণ হল, লাতিনের থেকে ইউরোপেই এখন ভাল ফুটবলারের সংখ্যা বেশি। আগে লাতিনের দলগুলো এক-দু’জন ফুটবলারের ওপর নির্ভর করে চ্যাম্পিয়ন হত। এখন একাধিক ফুটবলারকে ভাল খেলতে হবে দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে। যেমন ফ্রান্সের দিক তাকালে বিভিন্ন পজিশনে দক্ষ ফুটবলার দেখতে পাওয়া যাবে। ফ্রান্সের অনেক নতুন ছেলে উঠেও আসছে। বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়ারও তাই।"
লাতিন আমেরিকান ফুটবল মানে সূক্ষ্ণ স্কিল, শিল্প, জালে বল জড়ানোর নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী রাস্তা খোঁজা, সর্বদা আক্রমণের রাস্তায় থাকা। ছক বা ফর্মেশনের কথা বেশি না ভেবে মনের আনন্দে ছন্দ তোলা ফুটবল। ইউরোপ আবার সাবধানী, সতর্ক। আগে ঘর সামলানো ও ঝোড়ো কাউন্টার অ্যাটাকের ইতালির কাতানেশিও সিস্টেম যেমন। ইংল্যান্ড বিশ্বাস করে শর্টকাটে। গোলমুখে বল তুলে দেওয়া হয় স্ট্রাইকারের উদ্দেশে। মাঝমাঠে বিল্ড আপ কম, বলকে ছোটানো বেশি, নিজেরা কম ছুটে। স্পেন আবার তিকিতাকা নামে পাসিংয়ের স্টাইল বের করেছে। যার মূল কথা, বল নিজের দখলে রাখা। দখল হারালে জলদি তা ফেরত আনা। যদিও বলের দখল রাখাই সব ক্ষেত্রে জয়ের সরণিতে পৌঁছে দেয় না।
আরও পড়ুন: ভেবেই ক্লাব বদল, মত রোনাল্ডোর
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল আবার সৃষ্টিশীল ফুটবলে বিশ্বাসী। নানান পথে ঢেউ তুলে গোলমুখ খোলাতেই আনন্দ। তবে সাধারণত, কোনও না কোনও মহাতারকাকে কেন্দ্র করে আক্রমণ গড়ে ওঠে। পেলে-জিকো-মারাদোনা-রোমারিও-রো
মহাতারকাদের একার কাঁধে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন শেষ বলেই মনে করা হচ্ছে। তা হলে কি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার আগামী দিনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরও কমছে?ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা মুখ বাইচুং ভুটিয়া তা একেবারেই মানছেন না। তাঁর মতে, “এর কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। এখন কম্পিটিশন অনেক ক্লোজ, অনেক টাফ। তার জন্যই হয়তো এটা হচ্ছে। এ বার অবশ্য ইউরোপের দলেরই জেতার কথা ছিল। কারণ, খেলাটা ইউরোপে হয়েছে। টেকনিক্যাল, ট্যাকটিক্যাল বা মেন্টাল কারণ তফাত গড়েছে বলে মনে করি না। ইউরোপে খেলা হলে জলবায়ু, সমর্থক, সংস্কৃতি এগুলোও একটা বড় ভূমিকা নেয়। এ বারও অনেক হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ হয়েছে। লাক-ফ্যাক্টরও থাকে।”
লাতিন আমেরিকার দেশের ক্লাবে মহাতারকা এখন বিরল। বোকা জুনিয়র্সের জার্সিতে মারাদোনা।
সহমত পোষণ করছেন মনোরঞ্জনও। প্রাক্তন ডিফেন্ডার বললেন, “আসলে ইউরোপে খেলা হলে ইউরোপের দলগুলো বেশি সুবিধা পায়। বিশ্বাস বলব না, তবে পরের বছর লাতিন আমেরিকার কোনও দল চ্যাম্পিয়ন হলে আমি অবাক হব না। অবশ্য ব্রাজিল একসময় চার বছরের মধ্যে তিন বার জিতেছে বলে এখনও তাই হবে, এটা ভাবা ভুল।ফুটবল অনেক পালটে গিয়েছে। অনেক দলগত হয়ে গিয়েছে। আর এখানেই এগিয়ে ইউরোপের দলগুলো।”
ক্লাব ফুটবলে এই মুহূর্তে ইউরোপের একচ্ছত্র আধিপত্যকেও বিশ্ব ফুটবলের সমীকরণ বদলে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। লাতিন আমেরিকার একদা বিখ্যাত ক্লাবগুলোর দাপট কমে গিয়েছে অনেক। ব্রাজিলের স্যান্টোস, সাও পাওলো, করিন্থিয়াস, ফ্ল্যামেঙ্গো, গ্রেমিওর জৌলুস ছিল আলাদা। আর্জেন্টিনায় রিভারপ্লেট, বোকা জুনিয়র্সও ছিল উজ্জ্বল। এখন যা নেই। টান পড়ছে প্রতিভার ভাঁড়ারেও। সুরজিত্ বললেন, “প্রত্যেক বিশ্বকাপেই নতুন মুখ বা প্রতিভা বেরিয়ে আসে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা থেকে। কিন্তু, গত দুই-তিন বিশ্বকাপে তা মিস করছি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, পেরু বা লাতিনের অন্য দলগুলো থেকে নতুন প্রতিভা কিন্তু একেবারেই বেরিয়ে আসছে না। তবে ক্লাব-ফুটবলে ইউরোপকে কোনও দিনই লাতিনের ক্লাবরা টেক্কা দিতে পারেনি।”
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপের শিক্ষা: থেমে যাওয়া বলও গুরুত্বপূর্ণ
তারকা-নির্ভরতাকে অবশ্য লাতিন আমেরিকার দলের সমস্যার কারণ বলে চিহ্নিত করতে চান না বাইচুং। প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়কের কথায়, “ফুটবলে দলই গুরুত্বপূর্ণ। এটা এখন থেকে নয়। অনেক আগে থেকেই। মেসিরা পারছে না, কারণ দল শক্তিশালী নয়।” কিন্তু, কাতার বিশ্বকাপেই কি জিততে পারে লাতিন আমেরিকার কোনও দল? থমকে যেতে পারে ইউরোপের এই একচ্ছত্র দাপট? বাইচুং আশাবাদী, “কেন নয়? আগামী দিনে কেন লাতিনের কোনও দল জিততে পারবে না? জিততেই পারে কাপ।”
কিন্তু,লাতিনের কাপ জেতার মতো দল বলতে তো সেই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। তাও নীল-সাদা জার্সিধারীদের কাপ জয়ের ৩২ বছর বয়ে গিয়েছে. উরুগুয়ে অনেক বছর ধরেই কাপ জেতার দাবিদার হিসেবে চিহ্নিত হয় না। শেষবার বিশ্বকাপ জিতেছে ৬৮ বছর আগে. তুলনায়, ইউরোপে কাপের দাবিদার অনেক। জার্মানি-ইতালি ছাড়াও ফ্রান্স-স্পেন-ইংল্যান্ড রয়েছে বিশ্বজয়ীর তালিকায়। নেদারল্যান্ডস চ্যাম্পিয়ন না হলেও বরাবরই বড় শক্তি। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ফাইনালে লড়ে হারল ক্রোয়েশিয়া। রাশিয়া বিশ্বকাপে বেলজিয়াম হল তৃতীয়।
কেরিয়ারের সেরা সময়েও ব্রাজিলের ক্লাব ভাস্কো দা গামায় খেলেছেন রোমারিও।
ইউরোপ বনাম লাতিনের লড়াই তাই কার্যত দুই বনাম অনেকের। যা চাপ বাড়াচ্ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ওপর। প্রাক্তন উইঙ্গার সুরজিত্ তা মানছেন না। তাঁর যুক্তি, “অনেকদিন ধরেই এরা চাপ নিয়েই খেলছে। এটা নতুন কিছু নয়। বিশ্বের প্রথম সারির দলকে তো চাপ নিয়েই খেলতে হবে। লাতিন আমেরিকার দলের প্রতিনিধি হিসেবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ওপর যে আলাদা দায়িত্ব, এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এটাকে চাপ ভাবলে তা দুর্ভাগ্য।”
যা দাঁড়াচ্ছে, স্থানীয় ফুটবলমহল কিন্তু চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বে সিলমোহর দিচ্ছে না। বরং লাতিন আমেরিকার ফুটবলের পুনরুত্থানের স্বপ্নই দেখছেন বাংলার ফুটবল তারকারা। আর সত্যিই তো... ছক কাটা ফুটবল যেমন সাফল্য এনে দেয়, আবার সেই ছককে ভেঙেচুরে দেওয়া শিল্পীদের জন্যই তো অপেক্ষা করে থাকে ফুটবল। লাতিন আমেরিকাই তো সেই জাদুকরদের জন্ম দিয়েছে বারবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy