Advertisement
০৬ মে ২০২৪
সৌরভের পর জন্ম নতুন নক্ষত্রের

ফুটন্ত আবেগেও নির্লিপ্ত থেকে গেলেন নায়ক

তোর ক্রিকেট নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। শুধু এটুকু বলব, তোর মতো মানুষকে এত কাছ থেকে জানতে পেরে নিজেকে আজ খুব গর্বিত লাগছে। ভাল থাকিস, পপস।

টিম হোটেলে উৎসব শুরু নায়ক ঋদ্ধিমানের কেক কাটা দিয়ে। ছবি: টুইটার

টিম হোটেলে উৎসব শুরু নায়ক ঋদ্ধিমানের কেক কাটা দিয়ে। ছবি: টুইটার

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:৩৪
Share: Save:

তোর ক্রিকেট নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। শুধু এটুকু বলব, তোর মতো মানুষকে এত কাছ থেকে জানতে পেরে নিজেকে আজ খুব গর্বিত লাগছে। ভাল থাকিস, পপস।

একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। সোমবার সন্ধেয় বঙ্গসন্তানের মোবাইলে যেটা ঢুকল। প্রেরক, ময়দানের এক কর্তা। প্রাপক, ঋদ্ধিমান সাহা।

পপস আসলে ঋদ্ধিমান সাহার আদরের ডাকনাম-অপভ্রংশ। আর এই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ উল্লেখ করার কারণ, এটা বাকিগুলোর চেয়ে একটু ব্যতিক্রমী। সোমবারের ইডেন কীর্তির পর ফোনে কম শুভেচ্ছাবার্তা পাননি বঙ্গসন্তান। বঙ্গ ক্রিকেটে তাঁর সতীর্থদের কেউ কেউ লিখে পাঠিয়েছেন যে, তুই আমাদের পুজো জমিয়ে দিলি। জীবনের প্রথম ম্যাচের সেরা হলি কি না ইডেনে! দেখে নিস, কম করে পঞ্চাশটা টেস্ট তোর বাঁধা! ধরে নেওয়া যায়, বাকি যে ক’টা ফোন বা মেসেজ পেয়েছেন, সবই প্রশংসাসূচক। সবই তাঁর ক্রিকেটকে অকাতর আবেগের শংসাপত্র দিয়েছে। তার প্রেক্ষিতে ক্রিকেটীয় গরিমা ছেড়ে মানুষ ঋদ্ধিকে নিয়ে মেসেজ, একটু ব্যতিক্রম বোধহয়।

নাহ্, নয়। ব্যতিক্রম এত কিছুর পরেও এক জনই। তিনি— স্বয়ং ঋদ্ধিমান সাহা!

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামের এক মহীরুহের পর সোমবার আবার এক বীরগাথার জন্ম দেখল বাঙালি। দেখল, ইডেনেরই ভূমিতে সদম্ভ উপস্থিতি ঘোষণা হচ্ছে আর এক বঙ্গ নক্ষত্রের। দু’ইনিংসে অপরাজিত দু’টো হাফসেঞ্চুরি দিয়ে। সৌরভের পর কোনও বাঙালি টেস্ট ম্যাচে সেরা হয়েছেন, মনে তো পড়ে না। অথচ তিনি, ঋদ্ধিমান সাহা কি না শারদোৎসবের শহরে আগাম অষ্টমী এনেও একই রকম অবিচল, একই রকম নিরুত্তাপ থেকে গেলেন!

হোয়াটসঅ্যাপের উত্তর ফুলের ইমোজি পাঠিয়ে, ‘থ্যাঙ্কসে’ শেষ করে দিয়েছেন, তবু মেনে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু তিনি যে জীবনের প্রথম ম্যাচের সেরা স্মারক পেয়েও স্ত্রী রোমির কাছে আবেগহীন! ‘‘ভেতরে ভেতরে আনন্দ কি আর হচ্ছে না ওর? ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু সত্যি এত এক্সপ্রেশনলেস, কী বলব,’’ ফোনে বলতে বলতে হাসছিলেন রোমি। শোনা গেল, ‘প্রচুর ফোন পাচ্ছি, প্রচুর লোক শুভেচ্ছা জানাচ্ছে’ বলে নাকি ব্যাপারটা এ দিন মিটিয়ে ফেলেছেন ঋদ্ধিমান। কোনও পার্টির খবর নেই। সিরিজের মধ্যে ও সব নাকি সম্ভবই নয়। ইনদওর টেস্ট আছে। তার পর ফিরলে মেনুতে একটু কেক কাটা আর খাওয়াদাওয়া থাকবে। কিন্তু বাড়াবাড়ি হবে না।

বঙ্গসন্তানকে কে বোঝাবে, এত কিছুর পর বাড়াবাড়ি না হওয়াটাই আদতে বাড়াবাড়ি?

আসলে ঋদ্ধিমানকে নিয়ে আজ শুধু কলকাতা নয়, কলকাতার বাইরেও অনেক কিছু ঘটেছে। কর্নাটকে তাঁর ব্যাটিং দেখবেন বলে টিভি খুলে বসেছিলেন সৈয়দ কিরমানি। পূর্বে প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক সাবা করিমের আবার ঋদ্ধিমানের ইনিংস দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এই সেরার সম্মান বঙ্গসন্তানের প্রাপ্য ছিল। যে কোনও দিন আসত।

কলকাতার আবার দু’টো ভাগ। ইডেন। তাঁর বাড়ি। ম্যাচের সেরা হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ামাত্র ইডেন যে কোন পর্যায়ের শব্দব্রহ্ম সৃষ্টি করেছে, ঋদ্ধি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাঁর স্ত্রী রোমি একটু তুকতাকে বিশ্বাসী। ঋদ্ধিমানের খেলা দেখেন না। এ বারই প্রথম দেখলেন। প্রথম ইনিংস ইডেনে, এ দিনেরটা টিভিতে। আর এক মুহূর্তের জন্যও টিভির সামনে ছেড়ে ওঠেননি! বরং ভুবনেশ্বর কুমার আউট হওয়ার পর প্রবল চিন্তায় পড়েছিলেন, হাফসেঞ্চুরি হবে তো? সঙ্গী পড়ে থাকবে তো? বিরাট কোহালি— তিনিও সমান বিমুগ্ধ। বলে ফেললেন, ‘‘উফ্, সাহা আমাকে বাঁচিয়ে দিল। কাল ভোর সাড়ে ছ’টায় আর অ্যালার্ম দিতে হবে না!’’ সৌরভও মিডিয়াকে বলেন, ‘‘ঋদ্ধির দুটো ইনিংসই ভারতকে জিতিয়ে দিল। এ রকম ইনিংস খেলা খুব সহজ নয়।’’

গাঙ্গুলি-পরবর্তী নক্ষত্রের জন্ম এর পরেও লিখে বোঝাতে হবে?

’৮৩-র বিশ্বজয়ী টিমের কিপার তো কথা শুরুই করলেন সেটা দিয়ে। ফোনে কিরমানি বলছিলেন, ‘‘সৌরভের পর আরও এক জনকে পেয়ে গেল বেঙ্গল। ওকে প্রথম থেকে দেখছি। জাত কিপার। কিপার কেমন বোঝা যায় স্পিনের সামনে সে কী করে, তা দেখে। ঋদ্ধিমান পারে সেটা। এখন দেখাচ্ছে, ব্যাটিংয়েও কিছু কম নয়। ইডেনে ওর গাটস্-টা বোঝাল।’’ সাবাও দেখা গেল একই মোহের চক্রব্যূহে বন্দি। ‘‘ভাবতেই পারছি না, গায়ে খেয়েও কেউ ও ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ইডেনে এত মারাত্মক বাউন্স দেখিনি আগে। ঋদ্ধিমান সেগুলো গায়ে নিল!’’

প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক সাবার মনে হচ্ছে, বঙ্গ উইকেটকিপারকে পাল্টে দিয়েছে দু’টো জিনিস। ড্রেসিংরুম পরিবেশ। যেখানে কুম্বলে থেকে কোহালি, কেউ ঋদ্ধিমানের উপর চাপ না তৈরি করে তাঁকে ফুরফুরে রেখেছেন। সহজে বুঝিয়েছেন তাঁর কাছে কী চাওয়া হচ্ছে। আর দুই, ক্যারিবিয়ানে সেঞ্চুরি। শুধু একটা ব্যাপার চান না তিনি। ঋদ্ধিকে শুধু বাংলার ঐশ্বর্য হিসেবে দেখতে চান না। দেখতে চান ভারতের ঐশ্বর্য হিসেবে।

সাবা দেখতে না চাইতে পারেন। ঋদ্ধিমান স্বয়ং চতুর্দিকের ফুটন্ত আবেগ-সমুদ্রের মধ্যেও নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারেন নির্লিপ্ততার হিমশৈলে, রবি শাস্ত্রীকে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে ‘‘ভাল লাগছে প্রথম ম্যাচের সেরা হয়ে... ওয়েস্ট ইন্ডিজে সেঞ্চুরি আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল... ইডেন দর্শক খুব সাপোর্ট করেছে...ব্যাটিংয়ের সময় খারাপ বলের অপেক্ষা করেছি...’’ জাতীয় সাধারণ কথাবার্তা বলে ছেড়ে দিতে পারেন, কিন্তু শহরের তাতে কিছু আসে-যায় না। বহু দিন ধরে সিংহাসনটা ফাঁকা ছিল। আট বছর প্রায়। আট বছর আগে এমনই এক দুর্গাপুজোর আবহে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আট বছর পর কাউকে পাওয়া গেল যাঁকে সেই শূন্যস্থান পুরণে ভাবা যায়, যাঁকে নিয়ে আশা করা যায়। ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ না হলেও আজকের পর ঋদ্ধিমান সাহাকে একটা নামে তো ডাকাই যায়।

‘কাউন্ট অব ক্যালকাটা’ খুব খারাপ হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eden Test Wriddhiman Saha Indian Cricket Team
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE