Advertisement
০৪ মে ২০২৪

আঠারো ফুট জলের তলা থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রতিজ্ঞা ‘ভবঘুরে’ রসুলদের

ওঁদের ক্রিকেট স্টেডিয়াম ডুবে থাকে আঠারো ফুট জলের তলায়। ওঁদের জিমের সরঞ্জাম, মাঠের রোলার সব আজ নষ্ট। ওঁদের ক্রিকেট এখন খেলতে হয় ‘ভাড়া বাড়ি’তে। ঘরের মাঠ বলে আর কিছু নেই। যেতে হয় নাগপুর, রঞ্জির আগে প্রস্তুতির জন্য ওখানে পড়ে থাকতে হয় এক মাস। ওঁদের ক্রিকেট মরসুম কেড়ে নেয় দুঃসহ শীত। তাপমাত্রা নামে শূন্যে, ক্রিকেটকিটও তখন চলে যায় হিমঘরে। ওঁদের অধিনায়কের গুলির শব্দে এখন আর অবাক লাগে না। ছোটবেলা থেকে শুনছেন তো! পরভেজ রসুল জানতেন, প্রশ্নটা আসবে। জানতেন তিনি কাশ্মীরি বলে লোকে জানতে চাইবে, জীবন যেখানে বিপন্ন সেখানে কী ভাবে ক্রিকেটে মন রেখে মুম্বইকে হারান আপনারা?

ইডেনে প্র্যাক্টিস কাশ্মীর অধিনায়কের। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

ইডেনে প্র্যাক্টিস কাশ্মীর অধিনায়কের। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৪৩
Share: Save:

ওঁদের ক্রিকেট স্টেডিয়াম ডুবে থাকে আঠারো ফুট জলের তলায়। ওঁদের জিমের সরঞ্জাম, মাঠের রোলার সব আজ নষ্ট।

ওঁদের ক্রিকেট এখন খেলতে হয় ‘ভাড়া বাড়ি’তে। ঘরের মাঠ বলে আর কিছু নেই। যেতে হয় নাগপুর, রঞ্জির আগে প্রস্তুতির জন্য ওখানে পড়ে থাকতে হয় এক মাস।

ওঁদের ক্রিকেট মরসুম কেড়ে নেয় দুঃসহ শীত। তাপমাত্রা নামে শূন্যে, ক্রিকেটকিটও তখন চলে যায় হিমঘরে। ওঁদের অধিনায়কের গুলির শব্দে এখন আর অবাক লাগে না। ছোটবেলা থেকে শুনছেন তো!

পরভেজ রসুল জানতেন, প্রশ্নটা আসবে। জানতেন তিনি কাশ্মীরি বলে লোকে জানতে চাইবে, জীবন যেখানে বিপন্ন সেখানে কী ভাবে ক্রিকেটে মন রেখে মুম্বইকে হারান আপনারা? কী ভাবে বংশ-মর্যাদায় ঘরোয়া ক্রিকেটের ‘শিশু’ হয়েও আমদানি হয় তাঁদের বেপরোয়া মনোভাব যা কাঁপিয়ে দেয় তুলনায় রাশভারী প্রতিপক্ষকেও?

“আমি জানি রাজনৈতিক অস্থিরতা বলতে আপনারা কী বোঝাতে চাইছেন। সেগুলো আমরা এখন আর গায়ে মাখি না। আমাদের খেলাতেও আর প্রভাব পড়ে না। আসলে বিষেণ সিংহ বেদী আমাদের কোচ হয়ে আসার পর টিমটার মানসিকতাই পাল্টে গিয়েছিল। উনি টিমটার মধ্যে একটা বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, নিজেদের ছোট ভাবার কারণ নেই। রাজ্যে কী হল না হল, সে সব নিয়েও ভাবার দরকার নেই,” টিম হোটেলে শনিবার সন্ধেয় বলছিলেন রসুল। “আমার ক্রিকেটজীবনও বেদী পাল্টে দিয়েছিলেন। আমি দু’বছর আগেও জানতাম না যে, এই পর্যায়ে ক্রিকেটটা খেলতে পারব। আসলে ছোট থেকে ওই অস্থির অবস্থার মধ্যে কাটানোটাই বোধহয় আমাদের বারুদ। ছোট থেকে লড়াইয়ের ওই স্পিরিটটাই আমাদের ক্রিকেটের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে।”

রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতবর্ষের ওই প্রদেশে আজন্মের। বিপণ্ণতার মানচিত্রে গত বছর নতুন বিপর্যয় যোগ করেছিল কাশ্মীরের ভয়াবহ বন্যা। যে স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করত জম্মু-কাশ্মীরের রঞ্জি টিম, সেটা চলে যায় আঠারো ফুট জলের তলায়! মাঠের রোলার থেকে শুরু করে অন্যান্য যন্ত্রপাতি সারানোর কাজ আজও চলছে। এবং টিমটার ভবিতব্যও দাঁড়ায় ভবঘুরের। বোর্ডকে বলা হয়, বোর্ড তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করে নাগপুর অ্যাকাডেমিতে। সেখানে পঁচিশ দিনের প্র্যাকটিস। তার পর সোজা রঞ্জি, সোজা সামনে মুম্বই আর অবিশ্বাস্য জয়।

রঞ্জি ট্রফির মহীরুহদের হারানোর পর কাশ্মীর ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। রসুলদের মনে আছে এখনও। উত্‌সাহ দিয়েছিলেন, টিপস দিয়েছিলেন উন্নতির। কাশ্মীর ক্যাপ্টেনকে দেখা গেল, জীবনে প্রথম বারের জন্য ইডেনে এসে এক জনকে খুঁজছেন। যদি তিনি আসেন এক বার, যদি ক্রিকেট নিয়ে কিছু বলে যান, খুব ভাল হয়।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ওঁরা খুঁজছেন।

“সচিনের মতো উনিও একজন কিংবদন্তি। আশা করি, আসবেন। আমাদের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথাবার্তা বলবেন একটু। তাতে আমাদের উন্নতি হবে,” ঘোর লাগা গলায় বলে যান কাশ্মীর অধিনায়ক। নিরুপায় তিনি। ঘরে তো আর এত কিছু সম্ভব নয়। দেশের আর পাঁচটা রঞ্জি ট্রফি টিম যে সুযোগ সুবিধে পায়, সেগুলোর কিছু জোটে না। বছরে তিন-চারটে মাস ক্রিকেট খেলাটা সম্ভব হয়। বাকি সময় শীত। বড় কোচ বলতে আজ পর্যন্ত বেদী। বর্তমানে প্রাক্তন ভারতীয় স্পিনার সুনীল জোশী। সীমিত ক্ষমতা দিয়েই চেষ্টা হয়। জম্মু-কাশ্মীরের বত্রিশ ক্লাবে জোর দেওয়া হয় ক্রিকেটের অ-আ-ক-খ-তে। পরিকাঠামোর অভাবে জোর দেওয়া হয় জেতার ইচ্ছেয়, খিদেয়। হালফিলে তিনশো একর জায়গা নিয়ে একটা স্টেডিয়াম হচ্ছে। যেটা হলে শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়ামের একটা বিকল্প পাওয়া যাবে। “আমরা আসলে এটা ভেবে নামি যে, ভারতীয় ক্রিকেটে নিজেদের একটা জায়গা তৈরি করব। যাতে লোকে কাশ্মীর ক্রিকেটকে চেনে। ভাবি এমন পারফর্ম করব যাতে, কাশ্মীর ক্রিকেট নিয়ে বাকিরা ভাবতে বাধ্য হয়,” বলে দেন রসুল। জম্মু-কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এখন নাকি ক্রিকেট খেলতে আসেন তাঁরা। সামনে রেখে এগোন রসুলকে। বিশ্বাস করেন, চরম দারিদ্রকে জয় করে একটা রসুল পারলে, আমরাও পারব। ইয়ান দেব সিংহ সেটা ভাবেন। মহম্মদ মুদহাসির ভাবেন।

আগামী মঙ্গলবার থেকে ইডেনে যেমন তাই দু’টিমের গনগনে ক্রিকেটীয় যুদ্ধের সঙ্গে রোমান্সও থাকবে। ভবঘুরে টিম হোক আর যা-ই হোক, সে দিন থেকে তো ইডেনে এক টুকরো ভূস্বর্গ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ranji trophy eden jammu & kashmir
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE