Advertisement
০৩ মে ২০২৪

খেতাবের দৌড়ে ভেসে রইল ইস্টবেঙ্গল

অভিমানের জবাব। এক কথায় এটাই হতে পারে এই ম্যাচের শিরোনাম। নমুনা ১) জয়ের গোল করেই টিভি ক্যামেরার দিকে আঙুল তুলে ছুটলেন চিডি। ডান পায়ের থাই মাসলে জড়ানো ক্রেপ ব্যান্ডেজটা দেখালেন চোয়াল শক্ত করে। কেন? ম্যাচের পর বললেন, “ওই ডান পায়ের জন্যই তো মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে পারিনি। সবাই বলেছিল বেইমান।”

‘দেখে যাও কোথায় আমার চোট’। ডিকাকে নিয়ে চিডির দৌড়। মঙ্গলবার ম্যাচের পরে। ছবি: উৎপল সরকার।

‘দেখে যাও কোথায় আমার চোট’। ডিকাকে নিয়ে চিডির দৌড়। মঙ্গলবার ম্যাচের পরে। ছবি: উৎপল সরকার।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৪ ০২:৪৪
Share: Save:

ইস্টবেঙ্গল: ২ (মোগা, চিডি)
মহমেডান: ১ (তারো)

অভিমানের জবাব। এক কথায় এটাই হতে পারে এই ম্যাচের শিরোনাম।

নমুনা ১) জয়ের গোল করেই টিভি ক্যামেরার দিকে আঙুল তুলে ছুটলেন চিডি। ডান পায়ের থাই মাসলে জড়ানো ক্রেপ ব্যান্ডেজটা দেখালেন চোয়াল শক্ত করে। কেন? ম্যাচের পর বললেন, “ওই ডান পায়ের জন্যই তো মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে পারিনি। সবাই বলেছিল বেইমান।” গায়ে ঘামে সপসপে লাল-হলুদ জার্সি। এক ঢোক জল খেয়ে ফের বললেন, “গোলের পর বলছিলাম, স্যাক্রিফাইস করতে এসেছি। আজও কিন্তু খেলার মতো জায়গায় ছিলাম না।”

আর আর্মান্দো কোলাসো? প্রথমে সাংবাদিক সম্মেলনে আসতে চাইছিলেন না। পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সহকারি কোচ রঞ্জন চৌধুরীকে। কিন্তু ম্যাচ কমিশনার বলেন কোচকে পাঠাতে। এর পরেই সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির আর্মান্দো। স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় বেরিয়ে এল পাঁচ বারের আই লিগ জয়ী কোচের অভিমান। “এখানে তাঁদের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেখাতে হয় যাদের ক্যারেক্টারই নেই। তারাই বলে, আমি গোয়ায় সফল, কলকাতায় নই। শুনুন, আমি আর্মান্দো কোলাসো। সময় পেলে দেখিয়ে দেব আমি কী পারি।”

মাত্র একটা জয়। আর তাতেই বদলে গিয়েছে পুরো ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমের ছবিটা। এই টিমেই নাকি বিশ্বাসঘাতক মিলেছিল? যে মিডিয়ার কাছে আগাম টিম ফাঁস করে দেয়। এই টিমেই নাকি লিডার নেই? এই টিমেই নাকি রয়েছে স্বার্থপর ফুটবলার? চিডি-মোগা-সুয়োকার সম্পর্কে শীতল স্রোত নাকি অহর্নিশ? কিন্তু মহমেডানকে হারাতেই ওই সব ফ্যাক্টর আপাতত হিমঘরে।

মোগা বলে গেলেন, “চিডি ফর্মে চলে এসেছে। এ বার আমরা ছুটব।” আর ম্যাচের নায়ক তুলুঙ্গা আবার বলছেন, “কোচ তাতিয়ে দিয়েছিলেন আজ। এই জয়টা কনফিডেন্স দেবে।” টানা তিন ম্যাচে জয় আসেনি। পয়েন্ট প্রাপ্তি মোটে দুই। সেখান থেকে কী ম্যাজিক দেখালেন আর্মান্দো?

সুয়োকাদের ড্রেসিংরুম সূত্রে খবর, এ দিন মাঠে নামার সময় ছেলেদের আর্মান্দো বলেন, “তোমাদের নিয়ে এত সমালোচনা। জবাব দিতে ইচ্ছে করে না? যাও আজ জিতে জবাবটা দাও।” এতেই চেগে গিয়ে আর্মান্দোর ‘লিডার’ উগা হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি থাকতে পারলেন কোথায়। গোড়ালিতে চোট পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে গেলেন আধ ঘণ্টার মধ্যেই। ইস্টবেঙ্গল কোচের এই সময় উচিত ছিল গুরবিন্দরকে নামানো। কারণ স্টপারে রাজু-অর্ণব দু’জনেই ডান পায়ের ফুটবলার। কিন্তু নামলেন নওবা। ফলে ওপারাহীন লাল-হলুদ রক্ষণে এই সময় দাঁত ফোটানো শুরু তারো-নবিদের। কিন্তু তখনও যে চিত্রনাট্যে আরও অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের রসদ মজুদ। দ্বিতীয়ার্ধে টিম যখন নামছে তখন সজল চোখে ওপারা চিডিকে বলেন, “প্লিজ, ম্যাচটা জিতে ফিরিস।” আর ভোকাল টনিকেই কিস্তিমাত।

ম্যাচ বের করতে আবেগ-অভিমানের সঙ্গে আর্মান্দো মিশিয়েছিলেন কৌশল। সোমবার সুয়োকাকে উইং হাফে প্র্যাকটিস করিয়েও এ দিন জাপানি মিডফিল্ডারকে করে দিয়েছিলেন ‘থার্ড স্ট্রাইকার’। ইস্টবেঙ্গল আক্রমণে উঠলে ৪-৩-৩। মোগা, চিডির পিছনে সুয়োকা। সর্পিল গতিতে ডান দিক, বাঁ দিকে অপারেট করে মহমেডানের দুই স্টপার মেহরাজ এবং লুসিয়ানোকে ধাঁধায় ফেলছিলেন তিনি। দুই হাফের মধ্যে ডিকা ডাউন দ্য মিডল দৌড়ে লাল-হলুদের এই তিন মূর্তিকে বল বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর তুলুঙ্গা ধনরাজনের দিকে পাখির ডানার মতোই ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন উইং প্লে। এতেই খেই হারিয়ে ফেলল মহমেডান ডিফেন্স। আর্মান্দোর এই চাল যিনি ভণ্ডুল করতে পারতেন সেই রাকেশ মাসি যেন ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে এসেছিলেন। স্ন্যাচিং, ব্লকিং কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছিল না তাঁর।

মোগার গোলের সময় তাঁকে ধরতে ভুল করলেন মেহরাজও। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে দুরন্ত খেলেও কেন ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে মহমেডান কোচ সঞ্জয় এ দিন রক্ষণাত্মক কৌশল নিয়েছিলেন তা বোঝা গেল না। নবিদের আক্রমণের সময় ইস্টবেঙ্গল চলে যাচ্ছিল ৪-৪-২ ছকে। পেনকে ধরছিলেন খাবরা। আর জোসিমারের জন্য পাতা ছিল ডাবল কভারিংয়ের ফাঁদ। এক বার তাঁর বল পোস্টে লেগে ফেরা ছাড়া ফাঁদ কেটে বেরোতে পারেননি মহমেডানের এই ব্রাজিলীয়। তবে চিডির গোলের ক্ষেত্রে প্রতি-আক্রমণে গিয়ে নামতে দেরি করেছিলেন সাদা-কালোর দুই স্টপারই। লুসিয়ানো থাকলে (চোটের জন্য উঠে গিয়েছিলেন) এই সুযোগ পাওয়া কিন্তু সহজ হত না। মহমেডানের গোলের সময় জাপানি তারো যে ভাবে লেফট ব্যাক রবার্টের পিছন থেকে চিলের মতো উড়ে এসে এরিয়াল বলে গোল করে গেলেন তা মোটেও স্বস্তির নয়। নবিরা কাউন্টার অ্যাটাকে বারবার আসছিলেন এই রাস্তা ধরেই। ওপারার সার্ভিসও এই মরসুমে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। মিস পাসও হল প্রচুর। কাজেই জিতলেও আর্মান্দোর চিন্তা একটু হলেও থাকছে। তবে ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে বইছে আত্মবিশ্বাসের প্লাবন। ১৫ ম্যাচের পর ২৩ পয়েন্ট নিয়ে আপাতত সাত নম্বরে লাল-হলুদ। শীর্ষে থাকা বেঙ্গালুরুর চেয়ে তিন ম্যাচ কম খেলে এগারো পয়েন্ট পিছনে। পরপর জিতলে কিন্তু কলকাতায় খেতাবের গন্ধ একটা থাকছেই। বাড়ি যাওয়ার আগে কোচ ফুটবলারদের কাছে জানতে চাইছিলেন বাকি নয় ম্যাচেও জয় আসবে কি না? অর্ণবদের সেই ‘জিতবই’ হুঙ্কার শোনা গেল ড্রেসিংরুমের বাইরে থেকেও।

এই মেজাজটাই ইস্টবেঙ্গলে জ্বালিয়ে রাখছে আই লিগ খেতাবের আশার মশাল।

ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, রাজু, অর্ণব, উগা (নওবা), রবার্ট, তুলুঙ্গা (লেন), খাবরা, সুয়োকা, লালরিন্দিকা, মোগা (লোবো), চিডি।
মহমেডান: লুইস, নির্মল, মেহরাজ, লুসিয়ানো (সন্দীপ), ধনরাজন, মণীশ, রাকেশ (অসীম), মণিরুল (তারো), পেন, নবি, জোসিমার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debanjan bandhopadhyay eastbengal iLeague
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE