জয়ের উচ্ছ্বাস। অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরলেন অমিত মিশ্র। ছবি: এফএফপি।
তিরিশ বছর আগে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেটে একসঙ্গে খেলা লেগস্পিনারকে তিনি কি কোথাও এ বারের বিশ্বকাপে খুঁজে পাচ্ছেন? অমিত মিশ্রর পারফরম্যান্স দেখে নস্ট্যালজিক লাগছে না তাঁর?
কপিল দেব বেশ অবাক। তার পর একচোট হাসলেন, “আরে না না। শিবার কন্ট্রোল অনেক বেটার ছিল। এই মিশ্র ছেলেটার হার্টটা আরও বড়। তবে শিবার সঙ্গে তুলনাই হয় না।”
বোলারের গুণগত মান নিয়ে কপিলের মনে দ্বিধা থাকলেও স্কোরবোর্ডকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার উপায় নেই। আফ্রিদির টিমের বিরুদ্ধে আগের দিন মোক্ষম দুটো উইকেট নিয়ে মাজা ভেঙে দিয়েছিলেন মিশ্র। রোববার গেইলের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিমের বিরুদ্ধে নিলেন ২-১৮। আসলে তিন। গেইলের সহজ ক্যাচ যে দু’বার তাঁর বলে পড়ল। পঁচাশিতে অস্ট্রেলিয়ার সেই বেনসন-হেজেস কাপে যেমন স্বাদগন্ধহীন পেশাদারিত্বে পরপর সিঁড়ি ভেঙেছিল ভারত, এ বার পদ্মাপারেও তারই ছায়া! সে বারে অধিনায়ক গাওস্কর যেমন অপত্যস্নেহে আগলে ছিলেন শিবরামকৃষ্ণণকে। ধোনি আর মিশ্রর মধ্যে কখনও সেই সম্পর্ক ছিল বলে কেউ শোনেনি। বরঞ্চ উল্টোটাই বলা হয়েছে যে মিশ্র হলেন সহবাগ-গম্ভীর লবির। ধোনির অধিনায়কত্বে বাইরে বসবেন এটাই চূড়ান্ত এগারোর স্বাভাবিক নেটওয়ার্ক। এ বার সেই এত বছর কাব্যে উপেক্ষিত মিশ্রই কিনা সাত বছর পর ধোনির টিম ইন্ডিয়াকে ফের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পা-দানিতে এনে দিয়েছেন। গ্রুপে আর একটা ম্যাচ জিতলেই শেষ চার।
গেইলের খেলার পর জিতে গ্যাংনাম নাচার কথা ছিল। সেটা নেচেছেন তিনি ক্রিজেই। ভারতীয় বোলিংয়ের বিরুদ্ধে।
গেইল-বধ ছিল দিনের প্রথম কর্মসূচি। ভারতীয় পেসাররা তাঁকে বল করছিলেন অফ স্টাম্প ও খুব সামান্য বাইরে। বোঝা গেল এটাই ধোনির নির্দিষ্ট লাইন যে দুটো স্লিপ রেখে ওঁকে একটুও জায়গা না দেওয়া। আরসিবির জার্সিতে থাকলে এতেও থামানো যেত কি না ঘোরতর সন্দেহ। কিন্তু ইনি তো আর্জেন্তিনার মেসি। দেশের হয়ে টানা ভয়ঙ্কর হতে পারেন না। গেইল শুরু থেকেই ক্যাচ তোলা শুরু করেন। একটা কঠিন। দুটো সহজ ক্যাচ পড়ল তাঁর। তার মধ্যে ডিপ মিড উইকেটে যুবরাজেরটা সহজতম। বাংলাদেশ ম্যাচেও এই ব্যর্থতা চললে অজিঙ্ক রাহানেকে আর হয়তো ডাগআউটে দেখা যাবে না।
ধোনির সেই স্টাম্পিং।
ইউএস ওপেন টেনিসে যেমন এককালে সুপার স্যাটারডে-র চল ছিল। একই দিনে দু’টো পুরুষ সিঙ্গলস সেমিফাইনাল আর মেয়েদের ফাইনাল। মিরপুরে আজ তেমনই ছিল সুপার ক্রিকেট সানডে। একই দিনে গেইল-কোহলি-ওয়ার্নার-আফ্রিদি-ওয়াটসন। কোহলির কথাটা বাদ দিচ্ছি। তাঁর ব্যাট দেখে সময় সময় মনে হচ্ছে ব্যাটিংয়ের মতো সহজ কাজ পৃথিবীতে নেই। কোহলি সেই রান পেলেন কিন্তু সুপার ক্রিকেট সানডেটা যেন আন্ডারডগদের জন্য রাখা থাকল। ম্যাক্সওয়েল, উমর আকমল, মিশ্র।
বাংলাদেশ দর্শক ক্যারিবিয়ানদের ১২৯ রানে ইনিংস শেষ হওয়া থেকেই টিটকিরি দিতে শুরু করে—ভুয়া ভুয়া। আদৌ নয়। এই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিমটার তুখোড় সব গোলন্দাজ ছাড়াও সুনীল নারিন নামের এক স্পিনার ছিলেন। এই মাগ্গি গণ্ডার বাজারেও ওভার পিছু পাঁচের বেশি দেননি। কিন্তু ক্যারিবিয়ান টিমটার ওজন বোঝাই গেল না। ভারত শুরু থেকে পেশাদারি নৈপুণ্যে ম্যাচের ট্যাকটিক্যাল দখল নিয়ে নেওয়ায়।
দিনের প্রথম ম্যাচে ওই রকম যুদ্ধ বাঁধার পর দ্বিতীয়টা যে একপেশে অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স হয়ে যাবে কেউ ভাবতেই পারেনি। টস জিতে ফিল্ড করা থেকেই যেন ধোনি সর্বাত্মক চার্জ নিয়ে নেন। সবাই জানত গেইলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করবেন অশ্বিন। তিনি নিয়ে এলেন ভুবনেশকে। দ্বিতীয় ওভারেও স্পিনার নেই। এলেন শামি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওপেনাররা বোধহয় বিস্ময়াবিষ্টই হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা রান ওঠার যে টেম্পোটা তৈরি করতে হয় তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি।
কাল রাত্তির থেকে বাজ-টাজ পড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি। সকালে দেখা হতে এক ভারতীয় ক্রিকেটার জিজ্ঞেস করলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানি কি না? বললাম, রাত আটটা থেকে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। ক্রিকেটারটি শুনে আতঙ্কিত, “ডাকওয়ার্থ-লুইস হয়ে গেলে পুরো ভাগ্যের ওপর চলে যাবে।” অনেক সময় বড় টিমের সঙ্গে খেলা থাকলে লোকে বৃষ্টি-বাদলা হলেও ভাবে, ক্ষতি কী একটা জিতে আছি। আর একটা থেকেও এক পয়েন্ট পেয়ে গেলাম।
এই টিম সেই দলে পড়ছে না। তাদের এখনও ডেথ বোলারের খোঁজ নেই। শেষ ওভার কে করবেন চাপের মুখে, তা নির্দিষ্ট হয়নি। যুবি ছন্দে ফিরছেন না। কিন্তু এরা ট্রফি জেতাকে পাখির চোখ করেছে। এরা মিরপুর উইকেটের সঙ্গে নিজেদের খেলার স্টাইল আর দলের শক্তি খুব ভাল মিশিয়েছে। এরা মোটেও উনিশ দিন আগের এশিয়া কাপের দল নয়। সেই দলে ধোনি ছিলেন না। তিনি এসে যাওয়ায় বিরাট কোহলি অনেক নির্ভার ব্যাট করছেন। আর দীর্ঘ এত দিনের ফর্ম-বিহীন রোহিত শর্মাও রান করে ফেললেন। ধোনি টস জিতলেন বলেই ম্যাচ জিতেছেন, এটা মানা যাচ্ছে না। এই খেলাটাই অন্য ধাঁচের উইকেটে হলে ছবিটা বদলে যেত, কিন্তু মিরপুরে যে দুর্গসদৃশ ভারতীয় বসতি ইতিমধ্যে স্থাপিত, অস্বীকার করবে কে!
জিতিয়ে ফিরছেন রায়না-রোহিত। রবিবার। ছবি: এপি।
ঢাকা এমনিতেই বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেট প্রেসবক্স যেখানে এই আলোচনা অনবরত চলা সম্ভব যে কবি হিসেবে শঙ্খ ঘোষ না সুনীল কে এগিয়ে? কলকাতার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা ইদানীং ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’-তে কেন সুচিত্রা মিত্র-র গায়কি অনুসরণ করছেন না? রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘সুনীল সাগরে/ শ্যামল কিনারে... তুলনাহীনারে’ কি ভিক্টোরিয়া ওক্যাম্পোর জন্য লেখা? রোববার ম্যাচের ওপর ভারতের একচেটিয়া কারবার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসবক্স আরও শান্তিনিকেতনী আলোচনায় চলে যাচ্ছিল।
ধোনির ভারত মাঠে যদিও একেবারেই শান্তিনিকেতনী ক্রিকেট খেলছিল না। প্রেসবক্সের দূরত্ব যেটাকে সহজ, গা না ঘামিয়ে অনাকর্ষণীয় জেতা হিসেবে দেখছিল সেটা আসলে অসম্ভব চাতুর্য আর পারফেকশনে তৈরি একটা সমন্বয়। ধোনির স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী একটা কাজই অসম্পূর্ণ থাকল। এই রকম স্মরণীয় ম্যাচ জিতে-টিতে উঠে তিনি সাধারণত একটা স্টাম্প তুলে নেন। রাঁচির বাড়িতে শোনা যায় প্রচুর জায়গা জুড়ে তাঁর অনেক স্মারক স্টাম্প রয়েছে। মিরপুরে কিন্তু আজও স্টাম্প তোলার কোনও কাহিনি নেই। উইকেটের কাছে পাহারা দিচ্ছেন আম্পায়ার। এক-একটা এলইডি স্টাম্পের দাম চব্বিশ হাজার টাকা। ওগুলো আর কারও স্মারক হওয়ার উপায় নেই।
ওহ বলতে ভুলে গিয়েছি আবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ অমিত মিশ্র। বিচারের বাণী তার মানে মোটেও নীরবে নিভৃতে কাঁদে না। চিটফান্ড না হয়েও ২৪ পারসেন্ট ইন্টারেস্ট সহ জীবনে ফেরত আসে!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
স্মিথ ক ও বো অশ্বিন ১১
গেইল রান আউট ৩৪
স্যামুয়েলস স্টা: ধোনি বো মিশ্র ১৮
সিমন্স ক ধবন বো জাডেজা ২৭
ব্র্যাভো এলবিডব্লিউ মিশ্র ০
স্যামি ক রোহিত বো জাডেজা ১১
রাসেল ক কোহলি বো জাডেজা ৭
নারিন ন.আ. ৭
রামদিন ন.আ. ০।
অতিরিক্ত ১৪
মোট ২০ ওভারে ১২৯-৭।
পতন: ৩৮, ৬২, ৭৪, ৭৪, ৯৭, ১০৮, ১২১।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৩-০-৩-০, শামি ৩-০-২৭-০, অশ্বিন ৪-০-২৪-১,
মিশ্র ৪-০-১৮-২, রায়না ২-০-৮-০, জাডেজা ৪-০-৪৮-৩।
ভারত
রোহিত ন.আ. ৬২
ধবন এলবিডব্লিউ বদ্রি ০
বিরাট বো রাসেল ৫৪
যুবরাজ ক গেইল বো স্যামুয়েলস ১০
রায়না ন.আ. ১।
অতিরিক্ত ৩
মোট ১৯.৪ ওভারে ১৩০-৩।
বোলিং বদ্রি ৪-০-২৮-১, সান্তোকি ৪-০-২৭-০, নারিন ৪-০-২০-০,
ব্র্যাভো ১-০-১২-০, স্যামি ১-০-৯-০, স্যামুয়েলস ৩.৪-০-২২-১, রাসেল ২-০-১২-১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy