বিশ্বকাপে টিকে থাকতে আজ মরণবাঁচন লড়াই। তার আগে নিজের সেরা অস্ত্রে শান দিয়ে নিচ্ছেন কোচ। অনুশীলনে নেইমারকে পরামর্শ স্কোলারির। ছবি: এএফপি।
নেইমারের ব্রাজিল গ্রুপ শীর্ষে যাওয়ার সব রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েও নিজের দেশে অপ্রত্যাশিত শরশয্যায়!
টিম মাত্র ক’দিন আগে এত বন্দিত হচ্ছিল সম্ভাব্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে। বলা হচ্ছিল, মারাকানার ফাইনালে ঐতিহাসিক বদলা নেবে ব্রাজিল! সে বিপক্ষেই উরুগুয়েই পড়ুক বা অন্য কেউ! হঠাৎ গত ক’দিনে আন্ডারডগদের ক্রমাগত ওলট-পালট করে দিতে থাকা আর মেসির উপর্যুপরি গোল, দুইয়ের মিলিত প্রভাবে স্কোলারির ব্রাজিলের পেনাল্টি বক্সে অদ্ভুত সব আক্রমণ। কে জানত কাপের মাত্র এগারো দিন যেতে না যেতেই সাম্বার সুর মৃদুমন্দ হয়ে যাবে!
নিজেদের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় সোমবার গ্রুপের দুর্বলতম দলকে পাচ্ছে ব্রাজিল। অন্তর্দ্বন্দ্ব আর যাচ্ছেতাই ডিফেন্স জর্জরিত ক্যামেরুন। এটাই হল সেই প্রকৃষ্ট লগ্ন, যখন গোলের মালা পরিয়ে গ্রুপ শীর্ষে চলে যাওয়ার সুযোগ...দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ডসকে এড়াতে পারবে আবার নিজেদের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সেরে নেওয়া যাবে!
কিন্তু ক্যামেরুন খেলবে কি, ম্যাচের আগে তো ব্রাজিল উত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে প্রাক্তন ফুটবলার আর নিজের দেশের ভক্তদের সামলাতে। তাঁদের চাহিদা মেটাতে। টিমের ওপর এমন চাপ বাড়ছে যে সমালোচনার উত্তর দিতে গিয়ে মাথা গরম করে ফেলছেন ফুটবলাররা। দানি আলভেজ যেমন বেসক্যাম্পে বসে দেওয়া মিডিয়া সেশনে অ্যালান শিয়ারারকে ‘মূর্খ’ বললেন। বললেন, “ফুটবলার হিসেবে ওর লজ্জা হওয়া উচিত এত বাজে বকার জন্য।” বিবিসি টিভিতে শিয়ারার বলেছিলেন, “ব্রাজিল কেন ফ্রেডকে খেলিয়ে চলছে আমার মাথায় ঢুকছে না। ও স্লো। আক্রমণে যেতে পারছে না। এখনই ওকে বসানো উচিত।”
এটা তো সমালোচনা হতেই পারে। অনবরত সব টিমে হয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় দল থেকে তার এমন রূঢ় প্রতিক্রিয়া দেখে ফুটবলমহল স্তম্ভিত। অনেকেরই মনে হচ্ছে টিম যে মানসিক চাপের সুড়ঙ্গে ঢুকে গিয়েছে এটা তার অব্যর্থ প্রমাণ!
আর সমালোচনা তো শুধু বিবিসি বক্স থেকে উঠে আসছে না। বারো বছর আগের ব্রাজিলের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিমের অন্যতম সদস্য এডমিলসনও লিখেছেন, ‘এখনই ফ্রেডকে বসানো হোক। ক্যামেরুনের সঙ্গে পরীক্ষা করা হোক উইলিয়ানকে খেলিয়ে।’ নেইমারকেও ভুল জায়গায় খেলানো হচ্ছে বলে মনে করছেন এডমিলসন। তাঁর মতে, জার্মানি যে ভাবে টমাস মুলারকে একটা গুপ্ত জায়গা থেকে ব্যবহার করছে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের পিছনে রাখছে, নেইমারকেও তাই করা হোক।
ফ্রেডকে নিয়ে এত সমালোচনা একটু বিস্মিত করার মতো। কারণ বরাবরই তিনি একটু নিঃসাড়ে খেলেন। অ-ব্রাজিলীয় খেলার ভঙ্গি বলেই তাঁকে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ বলা হয়। গত বছর কনফেড কাপে তো ফ্রেড দারুণ খেলেছেন! এই প্রসঙ্গ আসতে যে ট্যাক্সি চালকটি এই এবিপি-র সাংবাদিককে স্টেডিয়াম নিয়ে আসছিল, সে ঘোষণা করল, ঠিক কথা। কিন্তু এই ফ্রেডের গত বছরের ফিটনেস নেই! ব্রাজিলের কোচ একমাত্র স্কোলারি মনে করলে ডাহা ভুল করা হবে। ট্যাক্সিচালক থেকে লন্ড্রিওয়ালা প্রত্যেকের জাতীয় দল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
আর সেই ব্রাজিলীয় জনমানসের নির্ঘোষ হল, ব্রাজিল টিম ঘুম থেকে ওঠো। ফুটবলটা সে ভাবেই খেলো যে ভাবে আমাদের দেশ বরাবর খেলে এসেছে।
জিকো যাঁর কি না দুর্দান্ত একটা মূর্তি আছে মারাকানার ভেতরে, তিনিও নেমে পড়েছেন টিমের বিরুদ্ধে জনজোয়ারে। মূর্তি হল জিকো সাইডভলি মারছেন। স্কোলারির টিমের বিরুদ্ধে তাঁর টাটকা রবিবাসরীয় সাইডভলি হল পওলিনহো সম্পর্কিত। লিখেছেন, স্কোলারি ভুল দল খেলিয়েছেন মেক্সিকোর বিরুদ্ধে। পওলিনহো কী করে পুরো নব্বই মিনিট মাঠে থাকে! ও যে খেলাটা খেলত বক্স টু বক্স সেটার আজ ছায়া হয়ে গিয়েছে।
জিকো বিশ্বকাপ না জিততে পারুন, এ দেশে খুব সম্মানীয় ফুটবল ব্যক্তিত্ব। তাঁর সমালোচনার প্রভাব তো আছেই। আমজনতাও নিজেদের মতো করে বিরক্তি জানাচ্ছে। ব্রাসিলিয়ার এই স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে মানে গ্যারিঞ্চা স্টেডিয়াম। এ দিন কাগজে এক ফুটবলপ্রেমী চিঠি লিখেছে গ্যারিঞ্চার স্মৃতিতে অন্তত আবেগ দিয়ে খেলো।
জনতা গজগজ করছে, তোমাদের খেলায় না পাওয়া যাচ্ছে গোল। না দেখছি পুরনো লাবণ্য। তা হলে তো আমরা মুখ খুলবই।
কোথাও বোধহয় সমর্থকদের একটা ভীতি কাজ করছে, এ বারের বিশ্বকাপে যেমন যে কোনও টিম যে কাউকে রুখে দিচ্ছে, হারাচ্ছে, তাতে ব্রাজিল এখনই উন্নতি না করলে পরে গিয়ে না সর্ষেফুল দ্যাখে। এই ভীতি থেকেই বোধহয় হাহাকারটা আরও বেশি হচ্ছে যেটা এই পর্যায়ে কখনও ওঠে না।
নেইমার টিমের হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কাউকে গালাগাল না দিয়েই বলেছেন, “আপনারা ধৈর্য ধরুন। এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু হয়নি। তা ছাড়া বোঝার চেষ্টা করুন, এখন আমাদের টিম অঙ্ক-নির্ভর একটু শুকনো ফুটবলই খেলে। এই ভাবেই আমরা জিতছি।” নেইমার এই মুহূর্তে দেশের জনপ্রিয়তম। ব্রাজিলীয় ফুটবল-দর্শকের চোখের তারা। কিন্তু ফুটবল-দর্শন তারা নেইমারের থেকেও শিখতে রাজি নয়।
গোল করো, অ্যাটাক করো, সৃষ্টিশীলতা দেখাওব্রাজিল ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে টিমের প্রতি এমন চাপ যে দানি আলভেজ হতাশ ভাবে বলেছেন, “সমর্থকেরা চান প্রতি ম্যাচে পাঁচ গোল। দশ গোল। যখনই সেটা ঘটে না, ওদের আবেগধর্মী বহিঃপ্রকাশ হয়।”
বিশ্বকাপ প্রথমার্ধের খেলা শেষ হতে না হতেই ব্রাজিলীয় জনতার চাহিদা আর টিমের মডেলের মধ্যে একটা পরিষ্কার কন্ট্র্যাডিকশন হাজির হয়েছে। ব্রাজিল বড় স্কোরে জিতলে সেই স্ব-বিরোধীতা ক্যামোফ্লেজ হয়ে যাবে। কিন্তু না জিতলেই সেটা বার হয়ে পড়বে।
ক্যামেরুন কী ভাবে ব্রাজিল ম্যাচ নেয়, সেটাই এখন দেখার। আন্ডারডগদের চমকপ্রদ সব সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আফ্রিকান সিংহ কি প্রতিযোগিতায় অন্তত একবারের জন্যও কেশর দোলাবে? নাকি হারার আগেই হেরে বসে থাকবে?
লাস ভেগাসের যে জুয়াড়ি আর্জেন্তিনার গোলে কোটি টাকার বাজি জিতলেন, তিনিই একমাত্র লোক এ বারের বিশ্বকাপ নিয়ে পূর্বাভাস যাঁর মিলেছে! লাস ভেগাসে তাঁকে যোগাযোগ করে দেখলে কেমন হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy