Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ছিয়াশি না ছুঁলেও দুঃখ থাকবে না ডি’রাইডারের

জয়ের ভাবনা ছুড়ে ফেলে নতুন বিপ্লব শুরু শিফোর দেশের

রাজা ফিলিপকে দেখে মনে হচ্ছে না, দেশটার তিনি শাসনকর্তা। বরং ব্রাজিলের গ্যালারিতে ফ্যানের চেয়ারে তাঁকে বেশি মানাচ্ছে। দেশের ফুটবল নায়কদের সঙ্গে যত্রতত্র সেলফি তুলছেন। ফেলাইনি, জানুজাজের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তাঁর সদাহাস্য মুখ, টিমটার বন্ধু তিনি এখন অনেক বেশি। গত চব্বিশটা ঘণ্টা যে অসম্ভব গর্বের! নকআউটে ওঠার জাতীয় গর্ব।

প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৪ ০৫:৪৭
Share: Save:

রাজা ফিলিপকে দেখে মনে হচ্ছে না, দেশটার তিনি শাসনকর্তা। বরং ব্রাজিলের গ্যালারিতে ফ্যানের চেয়ারে তাঁকে বেশি মানাচ্ছে। দেশের ফুটবল নায়কদের সঙ্গে যত্রতত্র সেলফি তুলছেন। ফেলাইনি, জানুজাজের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তাঁর সদাহাস্য মুখ, টিমটার বন্ধু তিনি এখন অনেক বেশি।

গত চব্বিশটা ঘণ্টা যে অসম্ভব গর্বের! নকআউটে ওঠার জাতীয় গর্ব।

বেলজিয়ামের আমি-তুমি-আমরার মধ্যে দেশের রাজা-রানিও এখন মিশে গিয়েছেন ফুটবলপ্রেমের সমুদ্রে। দেশে এই মুহূর্তে নেই, কিন্তু না থেকেও ফুটবলকে ঘিরে দেশের উন্মাদনার খবরাখবর ফিলিপ ডি’রাইডারের কাছে অহরহ পৌঁছচ্ছে। ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে কোচিং করিয়ে যাওয়া বেলজিয়ান কোচ এই মুহূর্তে ব্যাংককে। সোমবার সন্ধেয় দেশজ গর্বের কথা বলতে বলতে ডি’রাইডার আনন্দবাজারকে বলে ফেললেন, “সবচেয়ে ভাল কী লাগছে জানেন? আমরা একটা টিম হিসেবে খেলতে পারছি। বিশ্বকাপে কিন্তু শুধু ব্যক্তিগত দক্ষতা দিয়ে চলে না। বিশ্বকাপে যারা খেলতে আসে, তারা সবাই হয় ভাল, না হলে খুব ভাল। সেখানে টিম হিসেবে কে কেমন করল, সেটাই আসল। আর টিম বেলজিয়াম আমাদের রাজা-রানি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাইকে গর্বিত করে দিয়েছে।”

ডি’রাইডারের সঙ্গে বর্তমান বেলজিয়ান ফুটবলারদের পরিবারের যোগাযোগ আছে। ফেলাইনির উঠে আসা তিনি জানেন। জানেন, ভিনসেন্ট কোম্পানি আর ইডেন হ্যাজার্ডের স্ফুলিঙ্গ থেকে তারকায় রূপান্তরিত হওয়ার বাস্তব রূপকথা। যে তিন প্রশ্নাতীত ভাবে বহন করে চলেছেন এনজো শিফোর উত্তরাধিকার।

“তিন জনের উঠে আসার কাহিনি আলাদা। সাফল্যের কাহিনি স্বতন্ত্র,” বলছিলেন ডি’রাইডার। স্বতন্ত্র তো বটেই, শিহরণও জাগাবে ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে।

ফেলাইনি: একদম ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন দশ হাজার মিটার দৌড়বেন। কিন্তু আট বছর বয়সে ট্র্যাক সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে ফুটবল পৃথিবীতে পা। ফুটবলার বাবার পরামর্শে। আর অ্যান্ডারলেখ্ট ক্লাবে প্রথম মরসুমে ঢুকেই ২৬ গোল, পরেরটায় ৩৭!

ইডেন হ্যাজার্ড: তাঁকে তো ফুটবলার হতেই হত। মা অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থাতেও ফুটবল খেলতেন, বাড়িটাও মাঠের তিন মিটারের মধ্যে। বাবা? অবশ্যই ফুটবলার।

ভিনসেন্ট কোম্পানি: শুরুটা একটু দেরিতে, সতেরোয়। বাবা কঙ্গো ছেড়ে বেলজিয়ামে এসে বিয়ে করেন এক বেলজিয়ান মহিলাকে। জাতক ফুটবলার। কোম্পানি আবার ইংল্যান্ডে খেলতে খেলতে ম্যাঞ্চেস্টার বিজনেস স্কুলে পড়াশোনাটাও চালাচ্ছেন।

এঁরাই বেলজিয়ান ফুটবলের নতুন প্রজন্ম। এবং সোনার। ঠিক যেমন ছিলেন শিফোরা।

কিন্তু ফুটবলের এমন নতুন স্বর্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা এক দিনে হয়নি। প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল ২০০৬-এর সেপ্টেম্বরে, মিশেল সাবলন নামের এক ভদ্রলোকের হাত ধরে। যিনি বেলজিয়াম ফুটবলের প্রাক্তন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এবং বর্তমান বেলজিয়াম-বিপ্লবের নীরব নেপথ্য নায়ক। জানা গেল সাবলন বুঝেছিলেন, পরের পর বিশ্বকাপে ভাল খেলার ট্র্যাডিশন যদি ধরে রাখতে হয়, দেশের ফুটবলের খোলনলচে বদলাতে হবে। তাঁর ত্রিমুখী ফুটবল-দর্শন বলত:

এক, ৪-৩-৩ ফর্মেশনে একেবারে জুনিয়র স্তর থেকে খেলা অভ্যাস করতে হবে। যার জন্য ব্রশিওর হাতে তিনি গোটা দেশের স্কুল-কলেজে ঘুরে বেরিয়েছেন। সময় লেগেছে, কিন্তু ব্যাপারটা বেলজিয়ামের মজ্জায় তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

দুই, দেড় হাজার ফুটবল ম্যাচের ভিডিও খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে দেখিয়ে বিশ্বাস করিয়েছেন যে, জেতার কথা বেশি ভাবতে গিয়ে প্লেয়ারদের ভুগতে হচ্ছে। জিততেই হবে, এই ভাবনাটাই তুলে দেওয়া দরকার। বরং মডেলটা হবে ভাল খেলার। দেশের ফুটবলের এবং ফুটবলারদের উন্নতি করার।

তিন, এক বার জুনিয়র লেভেল থেকে কেউ সিনিয়র টিমে ঢুকে গেলে এবং ভাল খেললে তাকে কোনও ভাবে জুনিয়র স্তরে আবার ফিরিয়ে আনা হবে না। তাতে তার ফুটবল-শিক্ষা পিছিয়ে পড়বে।

ডি’রাইডারও দেখা গেল একই দর্শনে বিশ্বাসী। বলছিলেন, “আমাদের দর্শন এখন পাল্টে গিয়েছে। আমরা মোটেও ভাবছি না যে, আমরাই বিশ্বের সেরা টিম। ভাবছি না, আমরাই বিশ্বকাপ জয়ের একমাত্র দাবিদার। ভাবছি না, আমরা সবার চেয়ে বেশি বিজ্ঞ। আর সেটাই আমাদের মধ্যে থেকে সেরাটা বার করে আনছে। সে কারণেই বোধহয় ইপিএলের সব বড় ক্লাবেই বেলজিয়ান প্লেয়ারদের দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ তো ক্যাপ্টেনও!” কোথাও গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, বাকি বেলজিয়ামের সঙ্গে ডি’রাইডারও স্বপ্ন দেখছেন ছিয়াশিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। যে বছর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দিয়েগো মারাদোনার আর্জেন্তিনার কাছে থেমে গিয়েছিল বেলজিয়াম বিপ্লব। “গোটা দেশ তো প্রার্থনা করছে, আমরা যেন ছিয়াশিকে টপকে যাই। কিন্তু সেটা যদি না-ও হয়, দুঃখ নেই। টিমটা যা খেলেছে, সেটাই অনেক। আমরা ছোট দেশ, বড় স্বপ্ন দেখি না। কিন্তু ভাল খেলার স্বপ্ন দেখি। সেটা তো পারছি!”

ডি’রাইডারের দেশ এক ঝাঁক দুধর্র্র্ষ প্রতিভা তুলে এনেও স্বপ্ন দেখে না তারা কোনও দিন ব্রাজিল হবে। তারা স্বপ্ন দেখে না, কোনও এক নেইমার বা অস্কারকে টপকে সেরা প্রতিভার সিংহাসনে বসছে হ্যাজার্ড বা জানুজাজ।

ডি’রাইডারের দেশ মনে করে, এক দিনে বড় হওয়া যায় না। মনে করা হয়তো ঠিকও নয়। তার চেয়ে ছোট ছোট পা ফেলে বড় হওয়া অনেক ভাল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE