ক্রিকেট খেলার সময় একটা কথা প্রায়ই শুনতাম। কিছু ক্রিকেটার নাকি এমন থাকে, যাদের সম্পর্কে ওই কথাটা খাটে ইট ক্রিকেট, ড্রিংক ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট। যারা ক্রিকেটের বাইরে কোনও জীবন থাকতে পারে বলে ভাবতে পারে না। স্টিভ স্মিথকে নিজের চোখের সামনে না দেখলে বোধহয় কথাটা বিশ্বাস করতাম না।
চার-পাঁচ বছর আগের কথা। আইপিএলে পুণে ওয়ারিয়র্স ওকে নিয়েছে। আমি তখন পুণের সঙ্গে ছিলাম। ওর সঙ্গে কথা বলে মনে হল, ছেলেটা যে শুধু ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকে তা নয়। ছেলেটার মতো ক্রিকেট নিয়ে অনেকেই ভাবতে পারে না। ভাববেন না, মেলবোর্নে আজ ও ১৯২ করল বলে কথাটা বলছি। আমি যা দেখেছি, তা-ই লিখছি।
প্রথমেই বলি, স্মিথের ব্যাটিংয়ে আপনি রোমান্স পাবেন না। কোনও কবিতা-টবিতা ওর ব্যাটিংয়ে নেই। বরং ওর টেকনিক দেখলে মনে হতে পারে, এই দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট কী ভাবে হবে? স্মিথ নিজেও সেটা জানে। কিন্তু ওর প্লাস পয়েন্ট হল ওর ভাবনাচিন্তা। ওকে যে কোনও ম্যাচ সিচুয়েশনে ফেলে দিন, ও ভাবতে শুরু করবে কী ভাবে ম্যাচটা বার করা যায়? পুণেতে থাকার সময় কোনও দিন ওকে বলতে শুনিনি, নাহ্, ম্যাচটা জেতা সম্ভব নয়। এক বলে যদি ৩৬ লাগে, তখনও ও ভাববে কী করে সেটা তোলা যায়। অসম্ভব জেনেও!
তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্মিথের সাধনা। যেমন? পুণেতে এক বার স্পনসরদের অনুষ্ঠান শেষে গেট-টুগেদার ছিল। স্মিথ এসেই বলল, এ সব ছাড়ো। পরের ম্যাচটা নিয়ে চলো একটু বসি! আবার ম্যাচের দিন ধরুন। সাধারণত সে সব দিনে যারা খেলত না, তারা মাঠে দু’ঘণ্টা আগে গিয়ে প্র্যাকটিস করত। যারা খেলত, তারা যেত আধ ঘণ্টা আগে। স্মিথ খেললেও কিন্তু যেত আগের গ্রুপটার সঙ্গে! নেট বোলার আগেভাগে চেয়ে রাখত। পরের গ্রুপটা ঢুকলে আবার প্র্যাকটিস করত। দু’ঘণ্টার প্র্যাকটিসে দু’মিনিটও ওকে বসে থাকতে দেখিনি। হয় ব্যাট করছে, নইলে নকিং। ওর হাঁটাচলাটা খেয়াল করবেন, মনে হবে এতটুকু সময় নষ্টে রাজি নয়।
এটাই স্মিথ। যে জানে, মাইকেল ক্লার্কের মতো বক্তৃতায় টিমকে চাগিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু এমন একটা দর্শন টিমের সামনে রাখবে যে, বাকি দশও তাতে মারাত্মক প্রভাবিত হবে। ভাবতে শুরু করবে, ও বসে থাকছে না। আমরা কেন থাকব?
অস্ট্রেলিয়ারও যা হচ্ছে।
প্রত্যেক লিডারেরই নিজস্ব একটা দর্শন থাকে। মার্ক টেলরের ছিল, দাদির (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) ছিল। স্মিথের আছে। একটা টিম তার অধিনায়কের দর্শনে বিশ্বাস করতে শুরু করলে যে কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তার প্রমাণ অস্ট্রেলিয়া। টিমটার ব্যাটিং লাইনআপ দেখলে প্রশ্ন উঠবে, এরা সত্যিই সাড়ে পাঁচশো তুলেছে তো? আসলে স্মিথ টিমটার মজ্জায় ঢুকিয়েছে যে, আমরা দুর্দান্ত প্রতিভাবান না হতে পারি। কিন্তু খাটুনি দিয়ে সেটা ম্যানেজ করে দেব। রায়ান হ্যারিস, মিচেল জনসন, জশ হ্যাজলউডদের দেখুন। এমসিজির ব্যাটিং উইকেটে কিছু পাবে না জেনেও চেষ্টা করে যাচ্ছে কী ভাবে উইকেট বার হবে। ওরা বিশ্বাস করছে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নেমেছি যখন, পারতেই হবে। ভাল সময় তৈরি করতে হবে নিজেদেরই। ধোনির ভারতের মতো ‘কখন ভাল সময় আসবে’, সে আশায় বসে নেই।
ভারতীয় পেসাররাও অবিশ্বাস্য! গত সিরিজে স্মিথকে সামনে বল করে বারবার আউট করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শামি-উমেশরা ওকে নিয়ে গেল ব্যাকফুটে! ১৯২-এর মধ্যে বেশির ভাগ রান ও নিল পয়েন্ট অঞ্চল থেকে। এই বোলিংয়ে শৃঙ্খলাই নেই। দেখছিলাম, অস্ট্রেলীয় পেসাররা এক ফুট বাই এক ফুট একটা অঞ্চলে নাগাড়ে বল রেখে গেল। ভারতীয়রা সেটা রাখল তিন বাই তিনের অঞ্চলে। শৃঙ্খলায় কে কোথায়, এর থেকেই বোঝা যায়। উইকেট থেকে কিছু না পেলে অ্যাঙ্গল ছোট করা যায়। ইশান্ত বাদে কেউই সেটা করল না।
কী হবে টেস্টে? যে টিমের ভাবনায় নতুনত্ব নেই, যারা ভাবে স্মিথ নামলেই একশো হবে, যারা নামে অঘটনের আশায়, তাদের যা হওয়ার তাই-ই হবে।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস
(আগের দিন ২৫৯-৫)
স্মিথ বো উমেশ ১৯২
হাডিন ক ধোনি বো শামি ৫৫
জনসন স্টাঃ ধোনি বো অশ্বিন ২৮
হ্যারিস এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৭৪
লিয়ঁ বো শামি ১১
হ্যাজলউড নঃআঃ ০
অতিরিক্ত ১৬
মোট ৫৩০
পতন: ০, ১১৫, ১১৫, ১৮৪, ২১৬, ৩২৬, ৩৭৬, ৪৮২, ৫৩০।
বোলিং: ইশান্ত ৩২-৭-১০৪-০, উমেশ ৩২.৩-৩-১৩০-৩, শামি ২৯-৪-১৩৮-৪, অশ্বিন ৪৪-৯-১৩৪-৩, বিজয় ৫-০-১৪-০।
ভারত প্রথম ইনিংস
বিজয় ব্যাটিং ৫৫
ধবন ক স্মিথ বো হ্যারিস ২৮
পূজারা ব্যাটিং ২৫
মোট ১০৮-১।
পতন: ৫৫।
বোলিং: জনসন ৯-৩-২৪-০, হ্যারিস ৭-৩-১৯-১, হ্যাজলউড ৯-৪-১৯-০, ওয়াটসন ৪-০-১৪-০, লিয়ঁ ৮-০-৩২-০।
...আগের দিন আমার শুরুটা একটু স্লো হয়েছিল। প্ল্যান ছিল, ধৈর্য ধরে ক্রিজে থাকা। যাতে বোলাররা ক্লান্ত হয়ে যায়। ভারতের তো মাত্র তিন পেসার, এক স্পিনার। আমরা যত বেশি ব্যাট করব, ওদের তত বেশি বল করতে হবে আর তত ক্লান্ত হবে। পরের দিকে বড় শট খেলতে বেশ মজা পেয়েছি।
—স্টিভ স্মিথ