শনিবার গ্যালারিতে জয়ের উষ্ণ উৎসব।
পঞ্চাশ হাজারের রেইনএনার্জি স্টেডিয়াম জুড়ে শুধুই লাল-সাদা ঢেউ। যে গর্জনটা উঠছে, সাধারণত ইডেনে সচিন সেঞ্চুরি করলে উঠে থাকে। এবং সেটাও তুলনায় আসে না। ইডেনে কোথায় এত বাজনা, কোথায় এত রং? সেন্টারলাইনের সামনে দাঁড়িয়ে চিয়ারলিডারের দল। একটু আগে দেখে এসেছি, লাইন দিয়ে আট থেকে আশি, সরি, দুই থেকে আশি লাল-সাদা পতাকায় নিজেদের মুড়ে দিয়ে স্টেডিয়ামের গেটের সামনে ভিড় করছে।
আর মাঠে দেখা গেল ঝলকে ঝলকে আবেগের বিস্ফোরণ, ক্রুদ্ধ গর্জন, কপাল চাপড়ানো। মনে হবে বুন্দেশলিগা চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই বুঝি চলছে বায়ার্ন আর ডর্টমুন্ডে। অবিশ্বাস্য এই পরিবেশের মধ্যে পড়ে গেলে সেটা মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এবং তখন মনে করিয়ে দিতে হবে, এটা নিছকই এমন দুটো দলের মধ্যে ম্যাচ, যারা হয়তো চ্যাম্পিয়নশিপের ধারেকাছেও থাকবে না। কিন্তু ফুটবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ তাতে আটকাচ্ছে না। হোক না টিমের নাম দুটো কোলন আর হামবুর্গ।
ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন্স। যেখানে ফুটবল মানে জীবন, যেখানে ফুটবল মানে স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি। যেখানে ফুটবল মানে বিশ্বকে শাসন করার অধিকার। যেখানে ফুটবল মানে জার্মানি।
কোলনের বিখ্যাত ভাইস প্রেসিডেন্ট শুমাখারের সঙ্গে ম্যাসকট হেনেস।
হোটেল থেকে স্টে়ডিয়ামে আসার পথে বুন্দেশলিগার এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘জার্মানিতে তিনটে খেলা প্রচণ্ড জনপ্রিয়। এক, ফুটবল। দুই, ফুটবল। তিন, ফুটবল!’’ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার বারো মাস পূর্ণ হয়েছে এই ক’দিন আগে। কিন্তু উৎসব হয়েছে কোথায়? জার্মানরা বিশ্বাস করে চব্বিশ ঘণ্টা আগে মানেও সেটা অতীত। তা নিয়ে আর নাচানাচি করার কী আছে? বুন্দেশলিগার আন্তর্জাতিক পিআরও-র দায়িত্বে থাকা বছর পঁচিশেকের তরুণী এলিয়েনা বলছিলেন, ‘‘বিশ্বকাপ চার বার হয়ে গেল। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম গত বার ইউরোয় ভাল করব। পারিনি। পরের ইউরোর আর এক বছরও বাকি নেই। দেখবেন, আমরা ওটা জিতবই, জিতব।’’
ফুটবল নিয়ে জার্মানদের আবেগ আর সমর্থন কোথায় যেতে পারে, তা কোলনের মতো ছোট টিমের খেলা চাক্ষুষ দেখতে পারলে বোঝা যায়। আর সেটা ঘরের মাঠে হলে তো কথাই নেই।
এমনিতে কোলন এফসি বলে গুগলে সার্চ দিলে আগে দুটো তথ্যে চোখ আটকে যায়। এক, ক্লাবের ভাইস প্রেসি়ডেন্ট। দুই, ক্লাব ম্যাসকট। ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম হ্যারাল্ড অ্যান্টন শুমাখার। ১৯৮২, ১৯৮৬— দু’বারের বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট। কিন্তু সে জন্য নয়, শুমাখারকে বিশ্ব ফুটবল মনে রেখেছে বিশ্বকাপে জঘন্যতম ফাউল করার জন্য। বিরাশির সেমিফাইনালে জার্মান গোলকিপারের চার্জে শিরদাঁড়ার একটা অংশ ভেঙে গিয়েছিল ফ্রান্সের বাতিস্তঁর। বাতিস্তঁ ক’দিন আগেও বলেছেন, সেই মার তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। তা, শুমাখারকে অনেক খুঁজেও আবিষ্কার করতে পারলাম না শনিবার।
দ্বিতীয় জনের অবশ্য ডাক শুনতে পেলাম। মাঠ জুড়ে গর্জন উঠছিল মাঝে মাঝে, ‘‘ব্যা-অ্যা-অ্যা।’’ বেনফিকা, ক্রিস্ট্যাল প্যালেসের মতো বিশ্বে হাতেগোণা যে কয়েকটা ক্লাবের জীবন্ত ম্যাসকট আছে, কোলন এফসি তাদের মধ্যে একটা। নাম হেনেস। বিশালাকায় একটা ছাগল। যে এখানকার স্থানীয় চিড়িয়াখানার অধিবাসী। বংশপরম্পরায় এরা কোলন এফসি-র ম্যাসকট। ম্যাচের দিন জায়ান্ট স্ক্রিনে তাকে দেখানো হয় এবং ডাকও শোনানো হয়। এ দিন চিড়িয়াখানা থেকে বিশেষ ভ্যানে করে এসেছিল হেনেস। প্রত্যেক হোম ম্যাচেই হেনেসের উপস্থিতি গ্যালারির রং আরও বাড়িয়ে দেয়।
কোলন নিয়ে আরও একটা বিস্ময় আছে। যা মাঠে না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়। কলকাতা লিগে এরিয়ান বা আর্মি একাদশের হয়ে যদি পঞ্চাশ হাজার লোক গলা ফাটাত, তা হলে কেমন লাগত?
রিজার্ভ বেঞ্চের ঠিক পিছনের ভিআইপি জোনে বসে বসে ম্যাচটা দেখার পর ঘোর এখনও কাটছে না। এখনও কানে ভাসছে সেই গর্জন, সেই হাহাকার, সেই গান। যার নাম ফুটবল।
আর স্কোরটা? সেটা তো এ রকম মঞ্চে নিতান্তই গৌণ। তবু বলে রাখা যাক— কোলন ২, হামবুর্গ ১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy