কারও বয়স তিন মাস। কারও বা ছ’মাস। নাম-পরিচয় ছিল না। বালাই ছিল না অভিভাবকের। সেই অনাথ-দশা থেকে হোম ঘুরে অন্তত আটটি শিশুর থিতু হওয়ার ঠাঁই মিলেছিল। কিন্তু আইনি টানাপড়েনে তাদের ভবিষ্যৎ ঘিরে ফের ঘনিয়েছে অন্ধকার। এই টানাহেঁচড়ার মূলে আছে সংশ্লিষ্ট হোম আর শিশু কল্যাণ সমিতির বিরোধ।
আপাতদৃষ্টিতে যা বিরোধ, তার নেপথ্যে উঠেছে অসাধু যোগসাজশের অভিযোগও। ছেলেমেয়ে দত্তক দেওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতার ওই বেসরকারি হোমের সঙ্গে রাজ্যের শিশু কল্যাণ সমিতির অসাধু যোগাযোগের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে কলকাতা হাইকোর্টে জানিয়েছেন সরকারি আইনজীবী।
ঝামেলা বেধেছে কয়েকটি শিশুকে দত্তক দেওয়ার পরেও শিশু কল্যাণ সমিতি অভিভাবকদের কাছ থেকে তাদের ফিরিয়ে নিতে চাওয়ায়। ‘ভুল হয়েছে’ বলে জানিয়ে শিশুগুলিকে ফেরত চেয়েছে সমিতি। তার বিরুদ্ধেই হাইকোর্টে মামলা করে ওই হোম। আর ‘অশুভ আঁতাঁত’-এর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সেখান থেকেই। প্রশ্ন উঠছে, যেটাকে ভুল বলা হচ্ছে, সেটা সত্যিই ভুল, নাকি পাওনাগণ্ডা নিয়ে বিরোধের প্রকাশ? এবং সেই জন্যই কি মামলা?
বৃহস্পতিবার বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের আদালতে হোমের মামলার শুনানি ছিল। তখনই অসাধু আঁতাঁতের অভিযোগের কথা জানিয়ে সরকারি আইনজীবী বলেন, ওই অভিযোগ নিয়ে সরকার ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে। বিচারপতি দত্ত নির্দেশ দেন, মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত শিশুগুলি এখন যাঁদের কাছে রয়েছে, তাঁদের কাছেই থাকবে।
সরকারি আইনজীবী শুভব্রত দত্ত জানান, ১৯৯৮ সাল থেকে কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে ওই হোম চালাচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পরিচয় না-থাকা, অভিভাবকহীন ছেলেমেয়েদের কিছু দিনের জন্য রাখতে শিশু কল্যাণ সমিতি তাদের অনুমতি দিয়েছিল। গত ডিসেম্বরে ওই হোম শহরের কয়েকটি জায়গায় ব্যানার, ফেস্টুন লাগিয়ে জানিয়ে দেয়, দত্তক দেওয়ার ক্ষেত্রে যে-সব সরকারি নিয়ম ও যোগ্যতা (স্পেশ্যালাইজড অ্যাডপশন এজেন্সি) থাকা দরকার, তা তাদের আছে। চলতি বছরের গোড়ায় তিন থেকে ছ’মাসের আটটি শিশুকে তারা আট দম্পতির হাতে দত্তক হিসেবে তুলে দেয়। সেই সময় শিশু কল্যাণ সমিতি ওই আটটি শিশুকে দত্তক দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিল বলে সরকারি আইনজীবীর দাবি।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, সম্প্রতি অভিযোগ মেলে, ওই হোম আদৌ ‘স্পেশ্যালাইজড অ্যাডপশন এজেন্সি’ নয়। এবং শিশু কল্যাণ সমিতির কলকাতা শাখা হোমের যোগ্যতা বিচার না-করেই আটটি শিশুকে দত্তক দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে হোম-কর্তৃপক্ষকে। দত্তক নিতে চেয়ে দীর্ঘদিন আগে আবেদন করে রাখা অন্য অনেক দম্পতিকে ডিঙিয়ে আট দম্পতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ আসে।
হোম সূত্রের খবর, শিশু কল্যাণ সমিতি ১০ জুলাই হঠাৎই তাদের একটি চিঠি দিয়ে জানায়, দত্তক দেওয়া আটটি ছেলেমেয়েকে তাদের এখনকার অভিভাবকদের কাছ থেকে ফিরিয়ে এনে সমিতির কার্যালয়ে হাজির করাতে হবে। সেই চিঠির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ১৩ জুলাই হাইকোর্টে মামলা করে হোম। বিচারপতি দত্ত ওই চিঠির উপরে স্থগিতাদেশ দেন এবং মামলার পরবর্তী শুনানির ধার্য করেন ১৬ জুলাই। সেই নির্দেশ অনুযায়ী এ দিন আট দম্পতি তাঁদের সদ্য দত্তক নেওয়া শিশুদের নিয়েই হাইকোর্টে হাজির হন। তবে শিশু নিয়ে তাঁদের আদালতে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ।
হোমের আইনজীবী প্রতীক ধর আদালতে জানান, ‘স্পেশ্যালাইজড অ্যাডপশন এজেন্সি’ হওয়ার জন্য সরকারের কোনও বিজ্ঞপ্তি জারির প্রয়োজন হয় না। শুধু অনুমোদন থাকলেই হয়। আর সেই অনুমোদন দিয়েছে শিশু কল্যাণ সমিতি।
অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকলে এখন আবার শিশু ফেরত চাওয়া হচ্ছে কেন? সমিতির আইনজীবী সুরজিৎ সেন আদালতে জানান, তাঁদের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্রুটি ছিল। সেই কারণেই ওই আটটি ছেলেমেয়েকে ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। এই বক্তব্য শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি দত্ত।
সরকারি আইনজীবী শুভব্রতবাবু জানান, আইন মেনে শিশু দত্তক দিতে পারে, এমন ২৪টি সংস্থার নাম আছে সরকারের কাছে। সেই তালিকায় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ওই হোম নেই। ওই হোম এবং শিশু কল্যাণ সমিতির কলকাতা শাখার মধ্যে অশুভ যোগসাজশের যে-সব অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে সরকার তদন্তও শুরু করেছে। শুভব্রতবাবুর আবেদন, বিচারপতি দত্ত এখনই যেন মামলার নিষ্পত্তি না-করেন।
বিচারপতি দত্ত নির্দেশ দেন, মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত শিশুরা তাদের এখনকার অভিভাবকদের কাছেই থাকবে। পরবর্তী শুনানি ২০ জুলাই।
অশুভ আঁতাঁতের অভিযোগ নিয়ে কী বলছে শিশু কল্যাণ সমিতি?
সমিতির কলকাতা শাখার চেয়ারপার্সন ইন্দ্রাণী ব্রহ্ম গুহ ফোনে বলেন, ‘‘মামলাটি বিচারাধীন। আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ হোম-কর্তৃপক্ষ অবশ্য আদালতের বাইরে দাবি করেন, ‘‘আমরা বেআইনি কোনও কাজ করিনি। এবং তার প্রমাণও রয়েছে আমাদের হাতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy