নোট বাতিলের প্রতিবাদে দিল্লিতে রাহুল গাঁধী-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যৌথ সাংবাদিক বৈঠকের পরেও রাজ্য কংগ্রেসের আশার আলো টিমটিম করে জ্বলছিল। বুধবার তা-ও নিভে গেল!
সিবিআইয়ের হাতে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার প্রশ্নে হাইকম্যান্ডের চাপে দৃশ্যত অসহায়ের মতো তৃণমূলের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন অধীর চৌধুরী-আব্দুল মান্নানেরা। এতটাই যে, দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সি পি জোশীকে পাশে নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরবাবুকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে হল, সুদীপবাবুর গ্রেফতারের নেপথ্যে মোদী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা রয়েছে বলেই তাঁরা মনে করছেন। সন্দেহ নেই, এর পর রোজভ্যালি-কাণ্ডে সিবিআইয়ের সাম্প্রতিক ধরপাকড় নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে অধীর-মান্নানদের অবস্থানের আর তেমন কোনও ফারাক রইল না।
মোদী সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলায় আন্দোলন কর্মসূচি চূড়ান্ত করার জন্য বুধবার কলকাতায় এসেছিলেন এআইসিসি-র তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সি পি জোশী। এ ব্যাপারে এ দিন সকালে তিনি দলের সাংসদ ও জেলা সভাপতিদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। কিন্তু অধীরবাবুকে পাশে নিয়ে তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে মূলত রোজভ্যালি তদন্ত ও সুদীপ-গ্রেফতারের ঘটনা নিয়েই বারবার প্রশ্ন ওঠে। শুরুতে কৌশলী জোশী বলেন, ‘‘বিষয়টি বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’ কিন্তু পরে তিনিও জানিয়ে দেন, যে পরিস্থিতিতে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে, তাতেই সন্দেহের উদ্রেক ঘটছে। আবার এই একই প্রশ্নের জবাবে অধীরবাবু বলেন, ‘‘নোট বাতিলের বিরুদ্ধে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে যে ভাবে সংসদে বিরোধীরা এক হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন, তা ভাঙতেই সুদীপবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে আমাদের সন্দেহ। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু গ্রেফতারের সময় নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।’’
সারদা-সহ সমস্ত বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা আব্দুল মান্নান। বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে এত দিন সারদা, রোজভ্যালি-কাণ্ডই ছিল মান্নান-অধীরদের সেরা অস্ত্র। বিধানসভা ভোটের সময় এ প্রসঙ্গে সরাসরি মমতাকে আক্রমণ করে তাতে ধার বাড়াতে সাহায্য পর্যন্ত করেছিলেন সনিয়া-রাহুল। কিন্তু এখন পরিষ্কার যে, সেই অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড! রাহুলের নেতৃত্বে মোদী-বিরোধী যে জোটের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে, তাকে রক্ষা করতে রাজ্য স্তরে কংগ্রেসের ‘ক্ষুদ্র স্বার্থ’ জলাঞ্জলি দিতেও তারা প্রস্তত। তাই সিবিআইয়ের হাতে সুদীপবাবু গ্রেফতার হওয়ার পরেই কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেছিলেন, ‘‘বিরোধীদের জব্দ করতে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে মোদী সরকার।’’ কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারিও এ দিন বলেন, ‘‘সুদীপবাবুর গ্রেফতারের সঙ্গে রোজভ্যালি তদন্তের কোনও সম্পর্ক নেই। নোট বাতিলের বিরুদ্ধে বিরোধী আন্দোলন থমকে দেওয়ার জন্যই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’
প্রশ্ন হল, এর পরে রাজ্যে কংগ্রেসের হাতে আর কী রইল? অধীরবাবু অবশ্য এ দিন বোঝানোর চেষ্টা করেন, অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলন চলবে। কিন্তু তাঁর এক সতীর্থ নেতা আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘খাতায়-কলমে থাকলেও বাংলায় কংগ্রেসের প্রকৃত বিরোধীর মর্যাদা প্রায় খসে পড়ে গেল! এর পরে তৃণমূল-বিরোধী মানুষ কংগ্রেসের পাশে থাকবে কেন?’’ বিধানসভা ভোটে সমঝোতার ফল যা-ই হোক, অর্থলগ্নি কেলেঙ্কারির প্রশ্নে অন্তত বাম-কংগ্রেস গোড়া থেকে এক বিন্দুতে ছিল। অধীরবাবুরা হাইকম্যান্ডের সুরে গলা মেলানোর পরে সিপিএম আলাদা করেই পথে নেমেছে। ভিন্ন সুর বুঝিয়ে দিয়েই সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘নোটবন্দির জন্য গ্রেফতার নয়। আসলে তদন্তের ফাঁস আবার চেপে বসছে বুঝেই তৃণমূল নেত্রী বেশি করে নোটবন্দি বলছিলেন!’’
এর পরেও অবশ্য কৌতূহল থাকল, আপসহীন নেতা হিসাবে পরিচিত অধীরবাবু কেন এই পথ নিলেন? যে অধীর এক সময়ে হাইকম্যান্ডের অবস্থান অগ্রাহ্য করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী পর্যন্ত দিয়েছিলেন! তিনি মঙ্গলবার বলেছিলেন, ‘‘হাইকম্যান্ডের বিরোধিতা করতে পারব না।’’ কিন্তু তাঁর দলেরই এক প্রবীণ নেতা বলেন, অধীরও বুঝতে পারছেন নমনীয়তা না দেখাতে পারলে তাঁর গদিই টলে যেতে পারে। তা ছাড়া, তৃণমূল যে ভাবে মালদহ-মুর্শিদাবাদে থাবা বসিয়েছে, তার পরে হাইকম্যান্ডের পথে হাঁটলে অন্তত বহরমপুর বাঁচবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy