Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পার সঙ্গে থাকতে রানিগঞ্জে ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার রাজীব!

পুলিশের দাবি, মেজিয়ার ব্যাঙ্ক ম্যানেজার রাজীব জেরায় খুনের কথা স্বীকার করেছেন। তদন্তের প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে খুনের কারণ নিয়ে ধন্দ কাটেনি বলে তদন্তকারীরা জানান।

উদ্ধার হওয়া শিল্পার ব্যাগপত্র। —নিজস্ব চিত্র।

উদ্ধার হওয়া শিল্পার ব্যাগপত্র। —নিজস্ব চিত্র।

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর ও রানিগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:৫০
Share: Save:

শিল্পা অগ্রবাল (২৮) খুনে অভিযুক্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করলেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। ব্যাঙ্কের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, তাঁদের পক্ষ থেকেও ‘রুটিন’ মাফিক বিভাগীয় তদন্ত করা হচ্ছে। ব্যাঙ্কের তরফে পুলিশকে তদন্তে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

রাজীবের বাড়ি পটনায়। বেঙ্গালুরুর কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ২০০৯ সালে তিনি কলকাতায় এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় যোগ দেন। পরে একটি বিমা সংস্থায় কিছুদিন চাকরি করেন। ২০১১ সালে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। মাস ছয়েক আগে ম্যানেজার হয়ে আসেন বাঁকুড়ার মেজিয়া শাখায়। দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে একটি শপিং মলের পিছনের বহুতলের চার তলায় সস্ত্রীক ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন তিনি। রাঁচীর উইমেন্স কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করা স্ত্রী মনীষা কুমারী ওই ব্যাঙ্কেরই দুর্গাপুরের ফুলঝোড় শাখায় সহকারী ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। চার বছরের মেয়ে রাঁচীতে মনীষার মায়ের কাছে থাকে।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার ছুটির পরে মনীষা চলে যান মেয়ের কাছে। বেনাচিতির ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন রাজীব। ওই দিন রাতে মেজিয়ার যুবতী শিল্পা তাঁর সঙ্গেই ফ্ল্যাটে ঢোকেন বলে রাজীব জেরায় জানিয়েছেন বলে দাবি পুলিশের। শনিবার রাতে মারা যান শিল্পা। তাঁর দেহ প্রথমে বাড়ির পরিত্যক্ত রেফ্রিজেটরে ঢুকিয়ে দেন রাজীব। সোমবার মনীষা ফিরে আসেন। জানাজানি হতেই বাজার থেকে বড় ট্রলি-ব্যাগ কিনে এনে দেহ ঢুকিয়ে ফেলা হয় তাতে। ট্রলি-ব্যাগটি ঘর থেকে বের করে রেখে দেওয়া হয় সামনের করিডরে লিফ্‌টের উল্টো দিকের ঘুপচি ঘরে। বৃহস্পতিবার সকালে নীলচে-বেগুনি রঙের ট্রলি-ব্যাগে বন্দি শিল্পার বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার হয়। দেহে পচন ধরতে শুরু করেছে। গ্রেফতার করা হয় রাজীব ও তাঁর স্ত্রী মনীষাকে।

শহর ছাড়াও খবর ছড়িয়ে পড়ে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখা ও অন্য ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্ক কর্মীদের মধ্যে শুরু হয় কানাঘুষো। এর আগে ২০১৫ সালে এমনই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সমরেশ সরকারের (এখন সাসপেন্ডেড) বিরুদ্ধে এক যুবতী ও তাঁর মেয়েকে খুন তাঁদের দেহ লোপাটের অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে এ দিন ব্যাঙ্ক কর্মীদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘‘যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি, সেখানকার কারও বিরুদ্ধে খুন ও দেহ লোপাটের অভিযোগ উঠলে খুব খারাপ লাগে। অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখেন।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক কর্মী বলেন, ‘‘প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্টের পাশাপাশি কর্মীদের মনোবলেও ঘাটতি পড়ে।’’

ব্যাঙ্ক সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যাঙ্কের মানব সম্পদ বিভাগকে ওই আধিকারিকের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আগে যেখানে যেখানে কর্মরত ছিলেন, সেখানে সন্দেহজনক কোনও গতিবিধির রেকর্ড আছে কী না, খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত দু’জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, খুন ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত টানা জেরা চলে। ওই দিন গভীর রাতে তদন্তকারী অফিসারেরা অভিযুক্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে রানিগঞ্জে গির্জাপড়ায় সাধন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে যান। ওই বাড়িতেই প্রায় তিন মাস ভাড়ায় ছিলেন রাজীব। পড়শিরা জানান, সরস্বতী পুজোর দিন এই বাড়িতে একটি চৌকি ও বিছানা নিয়ে এসেছিলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। বাড়ির ভিতর থেকে উদ্ধার হয় দু’টি ব্যাগ, যুবতীর বেশ কিছু পোশাক ও অন্য সামগ্রী। পুলিশ সব বাজেয়াপ্ত করেছে। ওই বাড়ির দরজায় তালা ঝুলি দেয়। বাড়ির মালিক সাধনবাবু বলেন, “মাস তিনেক ভাড়ায় ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে এমন ধারণা ছিল না। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলেই ভরসা করে ভাড়া দিয়েছিলাম।” পড়শি প্রতিমা গডাই, বন্দনা শর্মারা জানান, প্রায়ই শিল্পাকে নিয়ে এই বাড়িতে আসতেন অভিযুক্ত। তবে রাতের দিকে এসে ভোরের দিকে ফিরে যেতেন। কারও সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। বাড়ির সামনে জমাটবাঁধা রক্ত পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে দেখান তাঁরা।

এ দিকে, এই ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার বাঁকুড়ার মেজিয়া ব্যবসায়ী সমিতি আধবেলা বাজার বন্ধ রেখেছিলেন। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে মিছিলও হয়।

পুলিশের দাবি, মেজিয়ার ব্যাঙ্ক ম্যানেজার রাজীব জেরায় খুনের কথা স্বীকার করেছেন। তদন্তের প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে খুনের কারণ নিয়ে ধন্দ কাটেনি বলে তদন্তকারীরা জানান।

যদিও শুক্রবার আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের ডিসি (পূর্ব) অভিষেক মোদী বলেন, ‘‘খুনের কথা স্বীকার করেছেন রাজীব। বালিশ চাপা দিয়ে খুন করা হয় শিল্পাকে। রানিগঞ্জ থেকে রক্তের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে।’’

সহ প্রতিবেদন: নীলোৎপল রায়চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE