দিল্লিতে বাজপেয়ীকে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর দল আমি করিনি। তবে তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস আমি পেয়েছিলাম। অটলজির সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটাই ছিল ব্যক্তিগত। সব কথা আজ এই পরিসরে বলব না। বলা উচিতও নয়। কিন্তু স্মৃতিচারণের সুযোগে এটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁর নিজের দলের অনেকের থেকে বেশি ‘কাছের লোক’ মনে করতেন আমাকে। এমন অনেক বিষয় আছে, যা নিয়ে তিনি তাঁর বাড়িতে খাবার টেবিলে আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন। মাঝেমঝেই কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ডাক আসত আমার কাছে। আমি তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখা করতাম। তিনি বলতেন, ‘‘মমতাজি, তোমাকে ডেকেছি তোমার মতামত শুনব বলে।’’
একটি উদাহরণ দিই। ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে কলকাতায় অটলজির ফোন এল। বললেন, ‘‘দিল্লি এসো। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’’ জানতে চাইলাম, ‘‘কী বিষয়ে একটু বলবেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কথা বলব।’’ দিল্লিতে নামতেই দেখলাম বিমানবন্দরে সুধীন্দ্র কুলকার্নি এসেছেন আমার জন্য। তাঁর সঙ্গে সেখান থেকে সোজা চলে গেলাম অটলজির কাছে। অটলজি বললেন, ‘‘কাকে রাষ্ট্রপতি করলে সবাই মেনে নেবে? তোমার কোনও প্রস্তাব আছে?’’ তাঁর কাছে এ পি জে আব্দুল কালামের নাম বললাম। সম্ভবত, আমিই প্রথম আব্দুল কালামের নাম বলেছিলাম। বাজপেয়ীজি শুনে উৎসাহিত হলেন। বললেন, ‘‘কংগ্রেস মেনে নেবে তো?’’ আমার উত্তর ছিল, ‘‘এ পি জে আব্দুল কালামের মতো ব্যক্তিকে মেনে না নেওয়ার কোনও কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।’’
এনডিএ-র বৈঠকে কালামজির বায়োডেটা পেশ করা হল। সবাই একবাক্যে সমর্থন জানালেন। কংগ্রেস-সহ বিরোধীরাও সমর্থন দিল। আব্দুল কালাম রাষ্ট্রপতি হলেন।
এনডিএ-তে থাকার ওই সময়ে আমি দীর্ঘ আটমাস কেন্দ্রে দফতরবিহীন মন্ত্রী ছিলাম। এক রাতে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর খাওয়ার টেবিলে আমার ডাক পড়ল। তিনি আমাকে কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে বললেন। আমি রাজি নই। বলেছিলাম, ‘‘কিছুদিন বাদেই নির্বাচন। আমি এমন একটি মন্ত্রকের দায়িত্বে যাব না।’’ অটলজি হেসে আমাকে বললেন, ‘‘মাস তিনেকের জন্য দায়িত্ব নাও। তোমারও তো দল আছে। ভোট করতে হয়।’’ তাঁর কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বললাম, ‘‘ক্ষমা করবেন। এই রকম রাজনীতি আমি করি না।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাকে প্রণাম বাজপেয়ীর। ২০০০ সালে কালীঘাটের বাড়িতে। —ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: জিন্স, টি-শার্টে কাকভোরেই সমুদ্রসৈকতে তখন প্রধানমন্ত্রী
অটলজি সোজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘‘মমতাজি, আমি তোমার কাছে এমনই একটি উত্তর আশা করেছিলাম। জবাব পেয়ে গিয়েছি। কয়লা মন্ত্রক তোমাকেই নিতে হবে।’’ আমি ফের আপত্তি জানাতে থাকলাম। একসময়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘‘তুমি যতক্ষণ রাজি না হবে, আমি খাব না।’’ রাত দশটা বাজে। সবিনয়ে অনুরোধ করলাম, ‘‘রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনি প্লিজ খেয়ে নিন।’’ উনি বললেন, ‘‘তুমি তাহলে রাজি হয়েছ, এটাই ধরে নেব।’’ তাঁর স্নেহের দাবি ফেলতে পারিনি। কয়লামন্ত্রী হয়েছিলাম এবং অফিসে ঢুকে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভোটের আগে কারওকে কোনও কোল-ব্লক দেওয়া হবে না।
কেন জানি না, আমার প্রতি স্নেহবশত তিনি নিজেই আমার কালীঘাটের বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। নিজের মুখে বলতে সঙ্কোচ হয়, তবু সেটুকু ভেঙেই আজ বলি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মমতাজি, তোমার মা রত্নগর্ভা। যিনি এই মেয়ের জননী, আমি তাঁকে দেখতে চাই।’’ পালিতা কন্যা নমিতাকে নিয়ে আমাদের হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। যৎকিঞ্চিৎ আপ্যায়ন হাসিমুখে গ্রহণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন: দৃষ্টান্তমূলক উচ্চতার রাজনীতিক
আসলে যে কথা আমি প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই বলেছি, আজকের বিজেপির সঙ্গে অটলজির কোনও তুলনাই চলে না। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল, উদার, অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্ব। গুজরাতের দাঙ্গার পরে তিনি সেখানে ‘রাজধর্ম’ পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন। এখন সবই দেখি অন্যরকম।
২০১১-য় তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আমি তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম। তখনই দেখেছিলাম, তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য আর আগের মতো নেই। ক্রমশ তিনি প্রায় অন্তরালেই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছিলেন আমাদের মতো অনেকের সশ্রদ্ধ স্মৃতিতে। থাকবেনও চিরকাল।
(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর জানতে পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy