আমলাশোলের শবরপাড়া। পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, টিনের ছাউনির পাকা বাড়ি। নিজস্ব চিত্র
এ তল্লাটের নাম লোকে জেনেছিল হাভাতেদের গাঁ বলে। সেটা ২০০৪। ১৪ বছর পার। সে বামও নেই, সেই আমলাশোলও নেই।
অনাহারের গ্রামে এখন কংক্রিটের রাস্তা, বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ, সকলেরই ইটের ঘর, টিনের ছাউনি। সচল প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এমনকি, সে সময় খেতে না পেয়ে মারা যাওয়া এক পরিবারের ছাদেও ডিশ টিভির ছাতা। এক জনজাতি পরিবারের মাটির দোতলা বাড়িতে এখন চলে ‘হোম-স্টে’। সেখানে শহুরে আরাম ছেড়ে স্বেচ্ছায় দু’-চার দিনের গরিব হয়ে থাকার কারবারও নাকি চলছে ভরপুর। এর পরেও ২০১৮-র আমলাশোলে গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটে হেরে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। জিতেছেন জনজাতিদের দাঁড় করানো নির্দল প্রার্থী অজিত সিং। শুধু আমলাশোল নয়, গোটা বাঁশপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতেই দাঁত ফোটাতে পারেনি শাসক দল। পঞ্চায়েত চলে গিয়েছে জনজাতি নির্দলদের হাতে।
বহিরাগতের কাছে এ এক বিস্ময়! এত উন্নয়ন! শুধু হয়েছে নয়, চোখেও দেখা যাচ্ছে। তার পরেও কেন...?
আরও পড়ুন: কী কী দেবেন মমতা, অপেক্ষায় পাহাড়
কাঁকড়াঝোড়ের আমতলায় খাটিয়ায় বসা ইন্দ্রজিৎ সিং-এর কথায় খানিকটা ইঙ্গিত মিলল। ভূমিজ নেতা বললেন, ‘‘এই তো এলেন রাস্তা দিয়ে। দেখেছেন রাস্তা কত সরু! একটা গাড়ি গেলে অন্য গাড়ি যেতে পারে না। জনজাতি হস্টেলগুলো বন্ধ করে দিল। আর ওরা বলছে, উন্নয়ন হয়েছে?’’ বোঝা গেল, আরও চাইছে আমলাশোল। আগে দাবি ছিল, পাকা রাস্তা। এখন— আরও চওড়া রাস্তা।
ময়ূরঝর্নায় আদিবাসী বাড়িতে সরকারি নলকূপ। নিজস্ব চিত্র
বছর দশেক আগেও ধড়সা মোড় থেকে বেলপাহাড়ির রাস্তা ধরলে মোটরগাড়ি আর গরুর গাড়ির তফাত মালুম হত না। এখন বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে দিঘলপাহাড়ি বা কুলডিহার জঙ্গল ধরে যত ভিতরেই যাওয়া
হোক না কেন, রাস্তা পাকা। দু’ধারে বিদ্যুতের খুঁটি। সাইকেল বা গরুর গাড়ির বদলে হুস হুস করে পেরিয়ে যায় বাইক। মেঘরাজপুর বা বরামশোল, ভালকাচুয়া বা এড়গোদা, ভুলাভেদা বা কেঁউদিশোল, সর্বত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের দেখা মেলে। উন্নয়ন সত্যিই এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তার পরেও বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা, শিমুলপালে শাসক দল গোহারা হেরেছে। বেশ কিছু বুথে এজেন্টও বসাতে পারেনি তৃণমূল। সর্বত্র কেমন যেন অখুশির হাওয়া। হয়তো আরও পাওয়ার বাসনা।
সুকান্ত মান্ডির মুখের কথাও তেমনই। বাঁশপাহাড়ির পথে কুলডিহার ঘন জঙ্গলে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। নজরদারির কাজে। সুকান্ত উচ্চমাধ্যমিক পাশ। এখন বেলপাহাড়ি থানার সিভিক ভলান্টিয়ার। ওঁর মুখেই শুনলাম, ২০১৩ সালে বেলপাহাড়ি থানাতেই ২৮৬ জন যুবক সিভিকের চাকরি পেয়েছেন। আরও অনেকে পেয়েছেন জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরি। রাস্তাঘাট, সৌরবিদ্যুতে চলা জলপ্রকল্প, বিদ্যুৎ— এত কিছুর পরও কেন হার তৃণমূলের? সুকান্তের জবাব, ‘‘এ সব তো পাওয়ারই কথা। আরও আগেই তো জল-রাস্তা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর কী পেয়েছি?’’
প্রায় একই কথা শোনালেন অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে চাটুহাঁসা গ্রাম পঞ্চায়েতের মুদালি গ্রামের মধুচরণ সহিস। পুরুলিয়া জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ সুষেণ মাঝি এখানে হেরে গিয়েছেন। মধুচরণের আক্ষেপ, ‘‘শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষের এলাকা। কিন্তু মুদালি হাইস্কুল এখনও উচ্চমাধ্যমিক হল না। ছ’কিলোমিটার দূরে কাঁটাডিতে পড়তে যেতে হয়।’’ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে পপিল হেমব্রমের দিন কাটে ‘ফেসবুক, হোয়াসঅ্যাপে’। পপিল বলেন, ‘‘বেকার বসে আছি। কাজ নেই। নেতার আত্মীয়েরা চাকরি পেলেন। আমরা পেলাম না।’’
যদিও ওই এলাকার তৃণমূল বুথ সভাপতি রমেশ কুমার মনে করেন, রাস্তা-জল ছাড়াও উন্নয়ন হয়েছে। তার পরেও ভোট আসেনি। উদাহরণ দিয়ে জানান, বলরামপুরের রাজপতি গ্রামে তিনশোর বেশি ঘর, পেনশন, জল, বার্ধক্যভাতা সবই দেওয়া হয়েছে। তার পরেও হেরেছে দল।
কেন? রমেশের কাছে ব্যাখ্যা না থাকলেও তাঁর পাশে বসা সিপিএমের এরিয়া কমিটির সম্পাদক প্রভাকর কুমারের জবাব, ‘‘মানুষের চাহিদার শেষ নেই।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy