প্রীতিভোজ: যুগের সঙ্গে বদলেছে বিয়েবাড়ির মেনুও। জায়গা করে নিয়েছে নতুন নতুন খাবার।—ফাইল চিত্র
জলপাইগুড়ি নেহাত মাছের মুখে বুলি নেই। পরিচিতেরা এখনও বলেন, যদি মাছের বুলি থাকত, তবে নির্ঘাত চেঁচিয়ে শিবদাস বসুকে বলতেন, “আর টানাটানি করবেন না, কত্তা! আমি ধুবুরি থেকেই আসছি!’’ শিবদাস বসু কল্পিত নাম। তবে, ঠিক এমনই এক চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত জলপাইগুড়ি।
সে বার শিবদাসবাবুর ভাইয়ের বিয়ে। শিবদাসবাবু যখন বাজারের থলে নিয়ে জলপাইগুড়ির দিনবাজারে ঢোকেন তখন তাঁকে চেনা যায় না! এ দোকানের মাছ টিপে, ও দোকানের মাছের কানকো টেনে, কখনও বা ছুরি দিয়ে আঁশ উঠিয়ে পর্যন্ত পরখ করে মাছ কিনতেন। বনেদি বংশের ছেলে। খাওয়াদাওয়া নিয়ে বড় হাঁকডাক ছিল শহরে। ভাইয়ের বিয়েতে ধুবুরি থেকে রুই মাছ আনিয়েছিলেন।
সে মাছ আদপে ধুবুরির কি না, তা পরীক্ষা করতেই বাজারে ঘণ্টাদুয়েক কাটিয়েছিলেন। প্রতিটা মাছ মাথা থেকে ল্যাজা আঙুল দিয়ে টিপে, খুঁচিয়ে, কানকো তুলে দেখে তবেই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। প্রায় ছশো লোক খেয়েছিলেন। মেনুও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। ভাত, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগের ডাল, আলু-পটলের কষা, মুড়িঘণ্ট, রুই কালিয়া, খাসির মাংস, চাটনি, বোঁদে এবং দই। কলাপাতায় পরিবেশন, খুড়িতে জল।
আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কায় অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজয় রাজাপক্ষের, রনিলকেই স্বীকৃতি পার্লামেন্টের
মধ্যবিত্ত পরিবার হোক বা বনেদি, সত্তরের দশক পর্যন্ত বিয়েবাড়িতে পদের বাঁধাধরা গত ছিল এমনই। তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে কয়েক বছর মাত্র। একে একে দেশীয় নানা সংস্থা মাথাচারা দিচ্ছে। ঠিক সেই সময়েই উত্তরবঙ্গের বাঙালি অনুষ্ঠানের মেনুতে ‘বিদেশি’ অনুপ্রবেশ। সাদা-কালো টিভিতে অশোককুমার এবং শামি কপূরের পানমশলার বিজ্ঞাপন দেখে অভস্ত বাঙালি দেখল, অতিপরিচিত বাসন্তি পোলাওয়ে লাল টুকটুকে চেরি। সে সময়ই জাফরানি পোলা মেনুতে জাঁকিয়ে বসা শুরু করে। জলপাইগুড়ি শহরের অভিজাত কেটারিং সংস্থার কর্ণধার অরূপ ঘোষ। যাঁকে শহরের খাদ্য রসিকেরা ‘বাবু’ নামেই চেনেন।
আরও পড়ুন: ‘আদালত নয়, রাফাল চুক্তির খুঁটিনাটি বিচার করবেন বিশেষজ্ঞরা’, সুপ্রিম কোর্টে বলল কেন্দ্র
তাঁর কথায়, “তখন স্কুলে পড়ি। পাড়ার এক বনেদি বাড়িতে জাফরানি পোলাও খেয়েছিলাম। বিয়েবাড়িতে তেমন মেনু সেই প্রথম। আর পটলের ভিতরে মাংসের পুর দেখে আমন্ত্রিতেরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন!’’ বিয়ে বাড়ির মেনু বদলাতে শুরু করে নব্বইয়ের দশক থেকে। তার আগে পর্যন্ত ভাত-ডাল-তরকারি, মাছের একরকম পদ এবং মাংসই ছিল ঘরানা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কেটারিং সংস্থাগুলির শুরু। তখনই খাবারের নানা পদে ‘ফিউশনে’র আবির্ভাব। ফুলকপির ডালনা বদলে গেল রোস্টে। টম্যাটো ভাসা লাল ঝোল থেকে ফুলকপি বিদায় নিয়ে রোস্ট হয়ে পাতে পড়ল। সারা শরীরে তার মাখনের প্রলেপ, কাঁচা লঙ্কার কুচি এবং কালোজিরে যেন বিউটি স্পট। তবে তাতেও মুড়োঘণ্টের জনপ্রিয়তা কমেনি। শুধু আনাজের মধ্যে ফুলকপির একাধিপত্য শুরু হল। মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপিও বেশি দিন মেনুতে টিকল না।
উত্তরবঙ্গের মেনুতে দক্ষিণী প্রভাব নব্বই দশকের শুরু থেকে। দক্ষিণী বলতে কৃষ্ণা-গোদাবরীর দেশের নয়, গঙ্গার ও-পারের। উত্তর কলকাতার রাধাবল্লভীর আবির্ভাব হল উত্তরবঙ্গে। বিয়েবাড়িতে প্রথম পাতে রাধাবল্লভী না থাকলে গৃহস্থের মান থাকবে না, এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল মিথ। রাধাবল্লভীর সঙ্গে খাবারের জন্য কাশ্মীরি আলুর দম বা সেই ফুলকপির ডাক পড়ল। ভাতের সঙ্গে খাওয়ার তরকারি চলে গেল রাধাবল্লভীর সঙ্গে। তখনই মাছের আরেকটি পদ রাখা শুরু হল বিয়েবাড়িতে। এই সুযোগ লুফে নিল কেটারিং সংস্থাগুলি। শুরু হল মাছের একেক রকম পদের পরীক্ষানিরীক্ষা। ইলিশ ভাপা, ভেটকি গন্ধরাজ, আড়পাতুরি, রুইয়ের টক-ঝাল। চিলিফিশেরও শুরু এই সময়টাই ধরা যায়। বিয়েবাড়িতে এখন মুচমুচে খাবারের জন্য আলাদা স্টল। সেখানে চোখের সামনে উনুন থেকে নামিয়ে পকোড়া, তন্দুরি, নান, লাচ্ছা পরোটা প্লেটে দেওয়া হয়। নব্বহইয়ের দশক থেকে কেটারিং সংস্থা চালানোর অভিজ্ঞতা থাকা শ্যামল সাহা বলেন, “ফিশ ওরলি, রেশমি কাবাবের মতো মুচমুচে খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।”
বিয়ের মরসুম শুরু হতে চলেছে। বাজার ছেয়ে গিয়েছে নতুন ঋতুর আনাজে। গাঢ়-হালকা সবুজ, হলুদ, বেগুনি রঙে ভরে গিয়েছে আনাজের পসরা। ব্যাগ ভর্তি হেমন্ত-শীতের আনাজ নিয়ে বাজার থেকে ফিরছেন সবাই। যদিও বিয়েবাড়িতে নতুন ওঠা আনাজের তেমন প্রভাব নেই বলেই দাবি রাঁধুনিদের। শুধু পকোড়ায় পেঁয়াজকলি লাগে। তবে পকোড়াও কিছুটা অতীত ফ্যাশন। প্রথম পাতে ঢুকে পড়েছে মোমো। সঙ্গে ফল ও চাট। ভাতের পাতেও চিনা, উত্তরের ভারতের পদ জাঁকিয়ে বসেছে। ফিউশনে চাটনিও প্রায় হাতছাড়া। সেখানে জায়গা নিচ্ছে মিক্সড ফ্রুটস জেলি। বয়স আঁশি ছুঁইছুঁই শিবদাসবাবুর মুখে এল সেই অমোঘ সংলাপ, “সবই পাবলিক! পাবলিক খাচ্ছে, তাই খাওয়ানো হচ্ছে!’’
মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং সহ উত্তরবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy