আইটিআই প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদ।
ঘটনা গুরুতর বুঝে রবিবার রাতেই সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য কে বা কারা দায়ী, তা খুঁজে বার করার জন্য সোমবার সারা দিন টানাপড়েন চলল।
রাজ্যের কারিগরি শিক্ষা দফতর সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার পরেও পুলিশের কাছে কোনও এফআইআর দায়ের করেনি বলে সিআইডি সূত্রের অভিযোগ। কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বিকেলে দাবি করেন, তাঁর দফতর এফআইআর করেছে। কিন্তু কোথায় কার কাছে সেটা করা হয়েছে, সেই তথ্য দিতে পারেননি মন্ত্রী। এই চাপান-উতোরের মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। বেশি রাতে জানা যায়, উজ্জ্বলবাবুর দফতর রাত ১১টার পরে নিউ টাউন থানায় এফআইআর করেছে। প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
সিআইডি অবশ্য তার আগেই এ দিন প্রথামাফিক বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নিউ টাউনের কারিগরি ভবনে গিয়েছিল। সেখানে তারা কথাও বলে আধিকারিকদের সঙ্গে। তখনও তো এফআইআর-ই হয়নি। সিআইডি তা হলে কারিগরি ভবনে গেল কেন?
এক সিআইডি-এক কর্তা বলেন, প্রশ্ন ফাঁস বা বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটলে যে বা যারাই তদন্ত করুক, এলাকাটি কলকাতা পুলিশের বাইরে হলে সিআইডি প্রথা মেনে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে। স্রেফ তথ্য সংগ্রহের জন্যই এটা করা হয়। এফআইআর নিয়ে গড়িমসি চলায় রাত পর্যন্ত বিশেষ তদন্তকারী দলও গড়তে পারেনি সিআইডি।
এফআইআর নিয়ে টালবাহানা তো ছিলই। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে রবিবার মন্ত্রী বিভাগীয় তদন্তের যে-নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারেও অগ্রগতি হয়নি। সিআইডি-কে তদন্তভার সঁপে দেওয়ার পরে আর বিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ আমলারাই। শুধু প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ড নয়, এক পরীক্ষার্থীর অ্যাডমিট কার্ডে কুকুরের ছবি কী ভাবে লাগানো হল, সেই ঘটনা নিয়েও তদন্ত ঘোঁট পাকিয়েছে কারিগরি শিক্ষামন্ত্রীর একটি নির্দেশে। সোমবার উজ্জ্বলবাবু ওই পরীক্ষার্থীকেই গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়ায় তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। কারণ, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সৌম্যদীপ মাহাতো নামে ওই পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতারের কোনও কারণই খুঁজে পায়নি। তারা জানায়, ওই পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার কোনও নির্দেশই তাদের কাছে পৌঁছয়নি।
এ দিন সকালেই গোয়ালতোড়ের জিরাপাড়া পঞ্চায়েতের পেরুমারা গ্রামের বাড়িতে সৌম্যদীপের খোঁজে যায় পুলিশ। তিনি তখন গোয়ালতোড়ে সাইকেল গ্যারাজে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে তদন্তের জন্য লিখিত আবেদন করতে বলা হয়। তিনি কোন সাইবার ক্যাফে থেকে কী ভাবে ফর্ম পূরণ করেছিলেন, তা লিখতে বলা হয় অভিযোগপত্রে। সৌম্যদীপ পরে জানান, তিনি তদন্তের জন্য অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।
পুলিশি সূত্রের খবর, অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে গোয়ালতোড়ের পুলিশ সৌম্যদীপকে নিয়ে মেদিনীপুর শহরে রাঙামাটির একটি সাইবার ক্যাফেতে যায়। তিনি মেদিনীপুর আইটিআই সংলগ্ন ওই ক্যাফেতেই অনলাইনে প্রবেশিকা পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করেছিলেন। মেদিনীপুর আইটিআইয়ের অদূরে, রাঙামাটিতে ঘর ভাড়া নিয়ে ওই ক্যাফে চালান মৃন্ময় মাইতি নামে এক ব্যক্তি। পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মৃন্ময়বাবুর বক্তব্য, অনেকেই ওখানে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করেছেন। ফর্ম পূরণের পরে প্রিন্টকপি বার করে দেওয়া হয়ে থাকে। ভুল কিছু থাকলে তখনই তা ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। তাঁর কথায়, “ফর্ম পূরণের জন্য ওই পরীক্ষার্থী (সৌম্যদীপ) ১৬ জুন আমার ক্যাফেতে এসেছিলেন। ফর্ম পূরণের সময় ওঁর পাশেই ছিলাম। পরীক্ষার্থীর বক্তব্য, প্রিন্ট কপিতে তাঁরই ছবি ছিল। পরে কী করে এমন (কুকুরের ছবি) হল, বুঝতে পারছি না।”
এ দিন দুপুরে নিউ টাউনে নিজের দফতরে বসে মন্ত্রী উজ্জ্বলবাবু ওই প্রবেশিকার জন্য অনলাইনে জমা দেওয়া একটি আবেদনপত্র দেখান। তাঁর দাবি, আবেদনপত্রটি সৌম্যদীপের। দেখা যায়, তাতে কুকুরের ছবির নীচে সৌম্যদীপের সই রয়েছে। মন্ত্রীর দাবি, নির্ধারিত ফি এবং রসিদ জমা দিতে হয় কারিগরি শিক্ষা দফতরে। সেই সঙ্গে ছবি সাঁটা ফর্মটিও জমা দিতে হয়। অর্থাৎ ফর্মের ছবি বা তথ্যে কোনও ভুল থাকলে সেখানেই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা।
দফতরের এক কর্তা বলেন, সৌম্যদীপও অনলাইনে ফর্ম পূরণের পরে প্রিন্ট কপি জমা দিয়েছিলেন মেদিনীপুর আইটিআইয়ে। সেখানে তথ্য যাচাই করে তা জমা নেওয়া হয়। কোনও ভুল থাকলে তখনই তা চোখে পড়ার কথা। এ ক্ষেত্রে মেদিনীপুর আইটিআই-কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারেন না। ওই আইটিআই-র টিচার-ইনচার্জ রণবীর সিংহ বলেন, “এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না।”
সৌম্যদীপ যেখানে পড়তেন, সেই গোয়ালতোড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তাপস পাল বলেন, ‘‘ছেলেটি পড়াশোনায় মাঝারি মানের। তবে খুব ভদ্র, নম্র স্বভাবের ছিল।’’ সৌম্যদীপের পড়শি মনোরঞ্জন মাহাতোও বলেন, ‘‘দারিদ্রের মধ্যেও গ্যারাজে কাজ করে ও নিজের পড়াশোনা চালিয়েছে। স্বভাবের দিকে থেকে সৌম্যদীপ ভদ্র ও অমায়িক।’’ এ-সব জানার পরেও বিকেলে মন্ত্রী বলেন, ‘‘অ্যাডমিট কার্ডে কী ভাবে কুকুরের ছবি এল, তা জানতে ওই ছাত্রকেই জেরা করতে হবে। তাই ওঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’’
তদন্তকারী পুলিশ অবশ্য তদন্তে সৌম্যদীপের কোনও গাফিলতি খুঁজে পায়নি। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে গ্রেফতারের কোনও নির্দেশ আসেনি। আমি নিজে ওই ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তদন্তে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
সন্ধ্যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার যখন সংবাদিক বৈঠক করছেন, তখনই নিউ টাউনে স্পেশ্যাল সুপার দীপশঙ্কর রুদ্রের নেতৃত্বে সিআইডি-র একটি দল কারিগরি ভবনে যায় প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। ভবানী ভবন সূত্রের খবর, কোথায় প্রশ্নপত্র ছাপা হয় এবং কী ভাবে সেগুলো পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়, মূলত তা জানতেই গিয়েছিল ওই দল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy