কোভিড ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু দল তৈরি করেছে রাজ্য। ফাইল চিত্র।
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি বজায় রেখে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে ২১৯৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিন। তাঁদের মধ্যে কলকাতায় সংক্রমিত ৬৪৮ জন। মহানগরীর লাগোয়া জেলা উত্তর ২৪ পরগনায় সংখ্যাটা ৫৫৪। ওই সময়ে মারা গিয়েছেন ২৭ জন।
রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ কিন্তু জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের করোনা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। শনিবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি জানান, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এখনই সার্বিক লকডাউনের পথে হাঁটতে চাইছে না রাজ্য সরকার। শুধু ‘কন্টেনমেন্ট জ়োন’ বা গণ্ডিবদ্ধ এলাকার ভিত্তিতেই নিয়ন্ত্রণ বিধি বলবৎ থাকবে।
মুখ্যসচিবের কথায়, “পরিস্থিতির গুরুতর পরিবর্তন হলে তবেই ব্যাপক লকডাউনের কথা ভাবা যেতে পারে। তবে সেই সময় এখনও আসেনি।”
কিন্তু প্রতিদিন যে-ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে সাধারণ মানুষ শঙ্কিত। তাই সামান্যতম উপসর্গ দেখা দিলেই অনেকে হাসপাতালে ছুটছেন। শারীরিক সমস্যা বাড়লে কখন কেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, জেলায় জেলায় বৃহৎ অংশের মানুষ সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছেন নিরন্তর।
বঙ্গে মোট আক্রান্ত ৪০,২০৯
অ্যাক্টিভ আক্রান্ত ১৫,৫৯৪
২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ২১৯৮
২৪ ঘণ্টায় মৃত ২৭
করোনায় মৃত ১০৭৬
কো-মর্বিডিটির কারণে মৃত ৮৮৯
(সূত্র: রাজ্য সরকার)
রাজ্য সরকারের বক্তব্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মানদণ্ড অনুযায়ী যে-হারে পরীক্ষা করার কথা, তার চেয়েও বেশি পরীক্ষা হচ্ছে বাংলায়। ফলে আগামী দিনে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে। কোভিড-মৃত্যুর জাতীয় হার ২.৫৩%, বঙ্গে তা ২.৭৬%। সরকারের যুক্তি, রাজ্যে ১৪,৭০৯ অ্যাক্টিভ কোভিড কেসের মধ্যে মাত্র ৬৬২ জন রোগীকে গুরুতর অসুস্থতার গোত্রে ফেলা যায়। ১২৫০ জনের অসুস্থতা মাঝারি মাত্রার। এই ১৯১২ জন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করলেই চলে। বাকি ১২,৭৯৬ জন উপসর্গহীন। মুখ্যসচিব বলেন, “আমাদের এখানে এমন কিছু হচ্ছে না, যা ‘অ্যালার্মিং’ (উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো)। নতুন কিট পাঠিয়েছে আইসিএমআর। তাতে পরীক্ষায় আরও ভাল ফল আসবে।”
আরও পড়ুন: উড়ান বন্ধই সার, যাত্রী আসা কি ঠেকানো গেল?
আরও পড়ুন: আধাসেনার বাধা, অর্জুনের ছেলে ও সিআইএসএফের বিরুদ্ধে মামলা পুলিশের
কোভিড ব্যবস্থাপনায় এ দিন বেশ কিছু দল তৈরি করেছে রাজ্য। আইএএস অফিসার মনোজ পন্থের নেতৃত্বে ‘কোভিড ইনফ্রাস্ট্রাকচার অগমেন্টেশন টিম’ সাহায্য করবে স্বাস্থ্য দফতরকে। সৌমিত্রমোহনের নেতৃত্বে ডাক্তারদের নিয়ে গড়া দল সেফ হোম দেখভাল করবে। কলকাতা পুরসভার কমিশনার বিনোদ কুমারের নেতৃত্বাধীন দলটি নজর রাখবে মৃতদেহ সৎকারে। হাসপাতালে চিকিৎসা দেখাশোনা করবে কোভিড ম্যানেজমেন্ট টিম। একটি দল টেলি-পরিষেবায় নজরদারি চালাবে। ফোনে পাওয়া তথ্য দেখভাল করবে অন্য দল। হাসপাতালগুলিকে যথাযথ দিশা দেখাতে প্রোটোকল ম্যানেজমেন্ট টিম গড়া হয়েছে সিনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে। সব ঠিক থাকলে সাত দিন বাদে হাসপাতাল থেকে কাদের ছাড়া যেতে পারে, তা দেখবে এক্সটার্নাল এক্সপার্ট টিম। হাসপাতাল-ভিত্তিক কুইক রেসপন্স টিমও গড়ে তোলা হয়েছে।
মুখ্যসচিব বলেন, “এত বড় রাজ্যে কোথাও কোথাও ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। তবে সেটা সার্বিক ছবি নয়। রোজ ১০০-১২০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। কলকাতায় ৭২% শয্যা ভর্তি, জেলাগুলিতে ভর্তি ৩৫%। ৩২টি বেসরকারি হাসপাতালেও কোভিড চিকিৎসা চলছে। তার উপরে রয়েছে ২২টি সরকারি হাসপাতাল। পাঁচ জেলার জন্য ৫৪টি হাসপাতাল আছে। ৩১ অগস্টের মধ্যে ১৫ হাজার শয্যার সঙ্গে আরও পাঁচ হাজার যুক্ত হবে। সেফ হোমে আছে ছ’হাজার শয্যা।”
আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে রাজ্যের পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা নিয়ে চিকিৎসকেরা অবশ্য পৃথক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ দেবকিশোর গুপ্ত বলেন, “রাজ্যের জনসংখ্যা যা, তাতে স্বল্প শতাংশের মানুষ গুরুতর অসুস্থ হলেও সেটা চিন্তার। কো-মর্বিডিটির সমস্যা তো রয়েছেই। আবার কমবয়সিরাও মারা যাচ্ছেন। ফলে পরিস্থিতি চিন্তার নয়, এটা পুরোপুরি বলা যায় না।” মেডিসিন বিশেষজ্ঞ শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, “পরিস্থিতিতে এখনই ক্রাইসিস রয়েছে, এমন কথা বলা যায় না।” আবার এসআই জোকার কমিউনিটি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মুখ্যসচিব উদ্বিগ্ন না-ই হতে পারেন। কিন্তু কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসক হিসাবে আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। হাসপাতালে শয্যা মানে কেবল খাট-বিছানা নয়। গুরুতর এবং মাঝারি মাত্রার প্রায় দু’হাজার অসুস্থ রোগীর জন্য পর্যাপ্ত সিসিইউ, হাই-ফ্লো অক্সিজেন বেড আছে কি? থাকলে চিন্তার কারণ নেই।’’ টেস্টের সংখ্যা নিয়েও সন্তুষ্টির জায়গা নেই বলে মত তাঁর। কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোতে হবে। সামাজিক ভীতির কারণে অনেকে পরীক্ষা না করে জ্বর লুকিয়ে যাচ্ছেন, এটা যেমন ঠিক। তেমন অনেকে চেয়েও পরীক্ষা করাতে পারছেন না, এই নজিরও রয়েছে।’’
রাজ্যের বক্তব্য, উপসর্গহীন বা সামান্য উপসর্গ থাকলে বাড়িতে থাকাই যে ভাল, আইসিএমআর-ও সে-কথাই বলছে। বাড়িতে সমস্যা হলে যে-কেউ ‘সেফ হোমে’ যেতে পারেন। গুরুতর উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে সেফ হোমের ব্যবস্থাপনা এবং হাসপাতালে শয্যা না-পাওয়ার অভিযোগ ওঠায় মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে।
রাজ্য জানিয়েছে, প্রধানত যাঁরা উপসর্গহীন, যাঁরা হোম আইসোলেশন বা গৃহে পৃথক ভাবে থাকবেন, তাঁদের জন্য ২৪x৭ অর্থাৎ সপ্তাহে সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা পরিষেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ১৮০০-৩১৩-৪৪৪-২২২ নম্বরে ফোন করলেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে, মিলবে অ্যাম্বুল্যান্স। বেসরকারি হাসপাতালের কোথায় কোথায় শয্যা খালি হচ্ছে, জানিয়ে দেওয়া হবে তা-ও। প্রশ্নোত্তরের সুবিধাও থাকবে। তা ছাড়া প্রতিটি সেফ হোমে অক্সিজেন এবং মেডিক্যাল টিমের সুবিধা থাকছে। প্রতিটি সেফ হোমের সঙ্গে একটি করে কোভিড হাসপাতাল যুক্ত থাকবে। সেফ হোমের প্রত্যেকের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স প্রস্তুত থাকবে দিনভর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy