চাঁপারুই-এ বিকাশ টুডু ওরফে সুদীপের সেই বাড়ি। ছবি: তাপস ঘোষ।
জঙ্গলমহল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু জঙ্গল ছাড়তে পারেননি। চট করে জঙ্গল ছেড়ে প্রকাশ্যে আসা সম্ভবও ছিল না বিকাশ ওরফে সুদীপের পক্ষে। তাই পশ্চিম মেদিনীপুর-পরুলিয়ার জঙ্গলের মাওবাদী ডেরা থেকে পালিয়ে প্রায় দু’আড়াইশো কিলোমিটার দূরে এমন একটা জায়গায় ঘর বাঁধলেন, যেখানে লোকসমাজ থেকে তাঁকে আড়াল করে রাখবে সেই জঙ্গলই। শেষ রক্ষা কিন্তু হল না। সাবাই ঘাসের জঙ্গল আর বাঁশবনের আড়ালে বিকাশ টুডু আর তারার একচালা ঘরটাতে ঠিক পৌঁছে গেল এসটিএফ।
সাত-আট বছর আগেই মাওবাদী নেতা বিকাশের নাম অন্যতম ত্রাসের কারণ হয়ে উঠেছিল রাজ্য প্রশাসনের কাছে। সিপিআই (মাওবাদী)-র সাংগঠনিক কাঠামোয় কিষেণজির ঠিক পরের ধাপেই যাঁরা ছিলেন সে সময়, বিকাশ টুডু তাঁদের অন্যতম। কিষেণজির ঢঙেই মুখে গামছা ঢাকা দিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে একাধিকবার আবির্ভূত হয়েছেন বিকাশ। বিকাশই প্রথম বলেছিলেন, জঙ্গলমহলের জনসাধারণের কমিটি আসলে মাওবাদীদেরও গণসংগঠন। তার পরই যৌথ বাহিনী ঢোকে জঙ্গলমহলে। তাতে অবশ্য বিকাশদের কার্যকলাপ থেমে যায়নি। আরও তীব্র হয়েছিল। বিকাশের স্ত্রী তারার নেতৃত্বে শিলদার সিআরপিএফ ক্যাম্পে কুখ্যাত হামলা আজও ভুলতে পারেননি যৌথ বাহিনীর কম্যান্ডাররা। কিন্তু কিষেণজির মৃত্যুর পর থেকে দ্রুত আলগা হতে থাকে সংগঠনের রাশ। অনেকে আত্মসমর্পণ করেন। অনেকে গ্রেফতার হয়ে যান। অনেকে সংগঠন ছেড়ে দেন। বিকাশ-তারাও সম্ভবত পথ খুঁজছিলেন সংগঠনের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার। কিন্তু প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণেও রাজি ছিলেন না তাঁরা। ঠিক করেছিলেন অজ্ঞাতবাসে চলে যাবেন। সংগঠনের লোকেরাও জানবে না, পুলিশও জানবে না, কোথায় যাচ্ছেন তাঁরা।
তলে তলে প্রস্তুতি চলছিল বিকাশ-তারার। অজ্ঞাতবাসে চলে যাওয়ার জন্য একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলেন। হুগলির মগরা থানা এলাকার চাঁপারুই এলাকাই অবশেষে বেছে নেন বিকাশ-তারা। চাঁপারুই এলাকা আদিবাসী প্রধান। জনঘনত্ব কম। নির্জন অঞ্চলের অধিকাংশটাই বাঁশবন আর সাবাই ঘাসের জঙ্গলে ঢাকা। ডিভিসি’র একটি ক্যানাল গিয়েছে ওই এলাকার মধ্যে দিয়েই। ক্যানালের বাঁধের ধারে জঙ্গলে ঢাকা খাস জমি বেছে নিয়েছিলেন বিকাশরা। কাঠা দু’য়েক জমি পরিষ্কার করে মাটির একচালা বানিয়ে নিয়েছিলেন দু’জনে মিলে। লম্বা লম্বা সাবাই ঘাস কেটে সেই ঘাসের ঘন পাঁচিল তুলে দিয়েছিলেন একচালার চারপাশে। জঙ্গলে ঢাকা ক্যানালপাড়ে গেলেও সাবাই ঘাসের পাঁচিলের ওপারে কারা থাকেন, কী করেন, কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, চাঁপারুইতে ডেরা বাঁধার পর থেকে বিকাশ খুব একটা ঘরের বাইরে বেরোতেন না। স্ত্রী তারা ক্ষেতমজুরের কাজ করতেন আশপাশের এলাকায়। বাড়িতে বিকাশ মুরগি পুষতেন। শতাধিক মুরগি পাওয়া গিয়েছে তাঁর বাড়ি থেকে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিকাশ দিনে এক বারই বেরোতেন। দোকান-বাজার এবং অন্য প্রয়োজনীয় কাজ চট করে সেরে বা চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় চা খেয়েই চট করে ফিরে যেতেন ক্যানালপাড়ের ঘরে। এলাকার কারও সঙ্গেই তেমন মেলামেশা করতেন না। নাম জিজ্ঞাসা করলে, বলতেন সুদীপ। আদিবাসী এলাকা হওয়ায় ভিড়ে মিশে যেতে বিকাশের খুব একটা সমস্যা হয়নি চাঁপারুইতে।
আরও পড়ুন:
পুলিশের জালে মাওবাদী বিকাশ, মগরায় ডেরা মোস্ট ওয়ান্টেড দম্পতির
এক বছর ধরে বিকাশ-তারার অজ্ঞাতবাস নির্বিঘ্নেই কাটছিল মোটের উপর। কিন্তু কলকাতা পুলিশের স্পশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) কাছে যে খবর পৌঁছে গিয়েছে, তা তাঁরা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেননি। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এসটিএফ তিনটি গাড়ি নিয়ে শুক্রবারই হাজির হয়ে গিয়েছিল চাঁপারুইতে। সে দিন তাঁরা বিকাশের বাড়ির দিকে যাননি। গোটা এলাকা ভাল করে চিনে নেন এসটিএফ কর্মীরা। তার পর ক্যানলপাড়ের খাস জমিতে বিকাশের আস্তানা সব দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। ভোরবেলা তারা ক্ষেতমজুরি খাটতে বেরিয়ে যাওয়ার পরই বিকাশ ওরফে সুদীপের ঘরে ঢুকে পড়ে পুলিশ। উদ্ধার হয় একে ফর্টিসেভেন। ল্যাপটপ এবং মাওবাদী বইপত্র। এসটিএফের একটি দল বিকাশকে নিয়ে ভোরবেলাই রওনা হয়ে যায় কলকাতা। আর একটি দল বিকাশের ঘরেই লুকিয়ে থাকে। তারা তখনও কিছু জানতেন না। বিকেলের দিকে কাজ সেরে তিনি ঘরে ফেরেন। এসটিএফ সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতা রওনা দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy