নিহত বিজেপি কর্মী সন্তু ঘোষ।
বিজেপি দাবি করেছে, ‘খুনোখুনির রাজনীতি।’ ভোটে খারাপ ফল করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটাতে শুক্রবার রাতে নদিয়ার চাকদহে তাদের কর্মী সন্তু ঘোষকে খুন করেছে তৃণমূল।
আর তৃণমূলের দাবি, পারিবারিক গোলমাল এবং দলের অন্তর্দ্বন্দ্বকে বিজেপি তৃণমূলের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। অযথা রাজনৈতিক রঙ চড়াতে চাইছে সাধারণ ঘটনায়।
নির্বাচনের ফল বের হওয়ার পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা, হামলা, ভাঙচুর, খুনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক চাপান উতোর, দলগুলির পারস্পরিক দোষারোপ তুঙ্গে উঠেছে।
শুক্রবার রাতে চাকদহ শহরের ২ নম্বর রাধাকৃষ্ণ কলোনি এলাকায় গুলিতে খুন হয়েছেন বিজেপি কর্মী সন্তু ঘোষ। শনিবার কলকাতা বিমানবন্দরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা মেদিনীপুর কেন্দ্রে সদ্য জয়ী প্রার্থী দিলীপ ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘নির্বাচনে খুব খেটেছিল সন্তু। সে জন্য ওকে টার্গেট করা হয়েছিল।’’ চাকদহের এই ঘটনা সম্পর্কে তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘আমাদের কর্মীদের মারা হচ্ছে। পুলিশ নির্বিকার। সবার সামনে গুলি করে মেরেছে। ওখানকার এমএলএ-র ডান হাত, বাঁ হাত সব। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। না হলে আমরা যদি শুরু করি তা হলে হাতের মধ্যে থাকবে না।’’
বিক্ষোভ: শিমুরালি স্টেশনে রেল অবরোধ। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
অন্য দিকে, শনিবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নিজেদের মধ্যে লড়াই কি না, পারিবারিক বিষয় আছে কি না, ওদেরই জিজ্ঞাসা করুন। ওরাই তো জিতেছে চাকদহে। পুলিশ আমাকে কোনও রিপোর্ট দেয়নি।’’ জেলার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, “খুনের কারন এখনও পরিষ্কার জানা যায় নি। এর সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নি। খুনিদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।”
পরিবার ও বিজেপি সূত্রের খবর, বাড়িতে মা-কে রুটি করতে বলে বেরিয়েছিল বছর তেইশের ছেলে। কিছু ক্ষণের মধ্যে গুলির শব্দ পান এলাকার মানুষ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় একশো মিটার দৌড়ে এসেছিলেন সন্তু। তার পর রক্তে মাখামাখি অবস্থায় রাস্তায় পড়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তার বাবা সাধু ঘোষ একটি মিষ্টির দোকানের কর্মী। মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোতে পারেননি সন্তু। লেখাপড়া ছেড়ে কলকাতা বড়বাজারে একটি সোনার দোকানে কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁরা দুই বোন এবং এক ভাই। সন্তু ছিলেন বাড়ির সকলের ছোট।
শুক্রবার রাত থেকে খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে দফায়-দফায় চাকদহ থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। শনিবার সকালে একসঙ্গে রেল ও সড়ক অবরোধ শুরু হয়। বাদকুল্লা, বীরনগর, চাকদহ , শিমুরালি এবং মদনপুর রেল স্টেশনে এবং চাকদহ চৌমাথায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। এর আগে পর পর দু’দিন উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়া রেল স্টেশনে অবরোধ হয়েছিল। ফলে নিত্যযাত্রীদের সঙ্কট অব্যাহত রইল তৃতীয় দিনও।
উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তও তেতে রয়েছে ভোট পরবর্তী হামলা, মারধর, ভাঙচুরের অভিযোগে। শুক্রবার রাতে বাঁকুড়ার তালড্যাংরায় বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সদস্য তৃণমূলের চন্দনা অধিকারীর বাড়িতে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে বিজেপির কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিজেপির বিরুদ্ধে রয়েছে শনিবার কোচবিহার, পশ্চিম মেদিনীপুরের নানা জায়গায় তৃণমূলের কার্যালয়ে ভাঙচুর করা, এলাকার তৃণমূল কর্মীদের বাড়িতে হামলা চলানোর অভিযোগ।
হুগলির আরামবাগে অন্তত ২০টি এবং পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২৩টি তৃণমূলের কার্যালয় দখলে অভিযুক্ত বিজেপি। উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে শুক্রবার তৃণমূলের পার্টি অফিস দখল রুখতে গিয়ে জখম হন দেবস্মিতা পাল নামে এক যুবতী-সহ চার জন। অভিযুক্ত বিজেপি। নদিয়ার শিমুরালিতেও তৃণমূলের পার্টি অফিস দখল হয়েছে বলে অভিযোগ। যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিজেপির দাবি, তৃণমূলের ‘বিক্ষুদ্ধ’ গোষ্ঠী হামলা করছে বা ‘জনরোষ’-এ হামলা হচ্ছে।
দখল হওয়া তৃণমূলের কার্যালয় তিন দিনের মধ্যে পুনরুদ্ধার করতে হবে বলে এ দিন জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের ফল নিয়ে কালীঘাটে শনিবার দলের পর্যালোচনা বৈঠকের পরে মমতা বলেন, ‘‘এখনও নির্বাচনী আচরণবিধি ওঠেনি। পার্টি অফিস যেগুলো দখল হয়ে গিয়েছে, সেগুলো সোমবারের মধ্যে উদ্ধার করতে বলেছি। ভাটপাড়ায় সংঘর্ষ চলছে এখনও। আমার হাতে প্রশাসন থাকলে এ রকম চলতে দিতাম না।’’
এ দিন সকালে আরামবাগের সিয়ারা গ্রামে তৃণমূল নেতা রামপদ সাঁতরাকে রাস্তায় ফেলে বেদম মারধরের ঘটনাতে বিজেপির দিকে আঙুল উঠেছে। তবে বিজেপির আরামবাগ সাংগঠনিক জেলা সম্পাদক বিমান ঘোষ বলেন, “ঘটনাগুলো কারা ঘটাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়।” শুক্রবার রাতে হাওড়ার শ্যামপুরে বিজেপির কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করায় কয়েকজন গ্রামবাসীকেও মারা হয় বলে অভিযোগ। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির শীতলিয়া গোলাবাড়ি এলাকায় বিজেপি বেশি ভোট পাওয়ায় তৃণমূলের এক নেতা দলবল নিয়ে এ দিন গ্রামে ঢুকে ভাঙচুর, মারধর করেন বলে অভিযোগ। প্রতিবাদ করেন মহিলারা। তৃণমূলের ওই নেতা-সহ কয়েক জনকে আটকে রেখে শুরু হয় গণধোলাই। পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে। বিজেপি সূত্রের ইঙ্গিত, বাংলায় ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতির খোঁজ নিতে কেন্দ্রীয় দল পাঠানোর ভাবনা-চিন্তা চলছে দলের অন্দরে। হিংসা থামাতে প্রশাসনিক পদক্ষেপের দাবির পাশাপাশি শান্তি বজায় রাখার জন্য দল-মতনির্বিশেষে সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy