হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা।
শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মতোই বাংলার নিজস্ব রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রচলিত কথায় বলে, জগন্নাথ যান মাসির বাড়ি। কিন্তু এই মাসির বাড়ি আসলে জগন্নাথের বান্ধবী ‘পৌর্ণমাসি’-র বাড়ি। সেখানে সাত দিন কাটিয়ে যখন জগন্নাথ মন্দিরে ফেরেন তখন তাঁর অভিমানী স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী তাঁকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন না। পরে অবশ্য জগন্নাথ স্ত্রীর মানভঞ্জন করেন রসগোল্লা পাঠিয়ে। তার পরে মেলে তাঁর মন্দিরে প্রবেশাধিকার। সে কাল থেকে এ কাল রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে মানুষের উৎসাহ এতটুকুও কমেনি।
১৭১৯ সালে বড়িশা গ্রামে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রথযাত্রা শুরু করেছিলেন রায় কৃষ্ণদেব মজুমদার চৌধুরী। সেকালে ন’টি চূড়াবিশিষ্ট রথে শালগ্রামশিলা নিয়ে যাওয়া হত বেনাকি বাড়িতে। পরে ১৯১১-এ বড়বাড়িতে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ ও একটি ত্রিতল রথ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৪ থেকে বিগ্রহগুলিকে রথের সময় হীরালাল বসুর বাড়িতে (মাসির বাড়ি) নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে সর্বজনীন সহযোগিতায় পুরী থেকে কারিগর এনে নতুন রথ তৈরি করা হয়। তবে পুরনো রথের কাঠামো ও লোহার চাকাগুলি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রায় ১২৪ বছর আগে বউবাজার অঞ্চলে গোবিন্দ সেন লেনে জগন্নাথ বিগ্রহ ও রথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চুনিমনি দাসী। পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল এই রথে সাবেক শিল্পরীতির নমুনা দেখা যায়। রথের চার দিকে আছে চারটি পুতুল এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর ছবিও। শোনা যায়, এক বার পুরীর নব কলেবরের সময় অবশিষ্ট এক খণ্ড নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পরিবারের নিমকাঠের জগন্নাথ বিগ্রহটি। এই বিগ্রহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আছে শালগ্রাম শিলা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, স্নানযাত্রার পরে হয় বিগ্রহের অঙ্গরাগ। আগে রথের দিন ও উল্টোরথের দিন পথে রথ বেরতো। এখন আর রথ রাস্তায় বেরোয় না। বাড়ির উঠোনেই টানা হয়। রথ উপলক্ষে আজও জগন্নাথের রাজবেশ এবং বামনবেশ হয়। এই সময় প্রতি দিন বিশেষ ভোগও দেওয়া হয়। তার মধ্যে থাকে খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, চচ্চড়ি, মালপোয়া, গজা, রসগোল্লা ইত্যাদি। এখনও প্রতি বছর পুরী থেকে পাণ্ডারা আসেন রথ উপলক্ষে।
পুরনো শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ।
বউবাজারের চুনিমনি দাসীর বাড়ির রথ।
প্রায় দুশো বছর ধরে দর্জিপাড়ায় রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে হয়ে আসছে কূলদেবতা রাজরাজেশ্বরের রথযাত্রা। বাড়ির সকলে এ দিন চামর দিয়ে বাতাস করতে করতে তিন বার রথকে প্রদক্ষিণ করেন। পুজোয় করবী ফুল দিয়ে হোম করা হয়। এই উপলক্ষে দেওয়া হয় হরির লুঠ। রথের আর এক ঐতিহ্য ইলিশবরণ। নোড়ার উপর জোড়া ইলিশ রেখে ছোট মাছটির মাথায় সিঁদুর দেওয়া হয়। পরে ধানদূর্বা দিয়ে মাছ দু’টিকে বরণ করা হয়।
তবে শুধু কলকাতায় নয়, মফসসলে এবং বিভিন্ন জেলাতেও পালিত হয় প্রাচীন রথযাত্রা। ছ’শো বছরেরও বেশি পুরনো শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ। ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন। বর্তমান রথটি প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। সে যুগে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা এবং দু’টি তামার ঘোড়া। ইতিহাস বলে সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্ন পেয়ে গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে দারুমূর্তি তৈরি করেন। প্রতি বছর রথের আগে বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়ে থাকে। রথের দিন জিটি রোড দিয়েই রথ টানা হয়। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও বসে মেলা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানি’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রথযাত্রা।
তেমনই হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অনেকে গুপ্তিপাড়াকে গুপ্তবৃন্দাবন মনে করেন। এখানেই রয়েছেন শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। বৃন্দাবন জিউর মন্দিরেই থাকেন জগন্নাথ। শোনা যায়, স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৭৮৪-এ জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী মধুসূদনানন্দ। সেই থেকেই রথযাত্রার প্রচলন। ন’টি চূড়াবিশিষ্ট এই রথে থাকে নানা রঙের আকর্ষণীয় পতাকা। একটি সাদা ও নীল ঘোড়া ছা়ড়াও থাকে সারথি এবং আরও কয়েকটি কাঠের পুতুল। এখনও অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয় এই উপলক্ষে। তবে রথের আরও এক আকর্ষণ ভাণ্ডার লুঠ।
নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা বিজয় রাধাবল্লভ জিউর রথযাত্রা আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। বসে মেলাও। রথযাত্রার শুরু ১৮৬২ থেকে। সূচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন তমলুকের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সেখানে থাকাকালীন সেখানকার কারিগরদের দিয়ে একটি রথ তৈরি করিয়েছিলেন। সেই রথ রূপনারায়ণ এবং গঙ্গা যোগে নৈহাটির ঘাটে নৌকা করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
কাঁচরাপাড়ার কৃষ্ণ জিউ জির রথ।
নৈহাটির বিজয় রাধাবল্লভ জিউর রথ।
১৮৬২-র রথযাত্রার দিনই শুরু হয় শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট ট্রেন চলাচল। সেই সময় এই রথযাত্রা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে রথের সময় বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করত। আট দিন ধরে বসত রথের মেলা। সেই প্রথা আজও অব্যাহত। রথটি উৎসর্গ করা হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের মা দুর্গাসুন্দরী দেবীর নামে। তাই তিনি সবার আগে রথের রশিতে টান দিতেন। আজও প্রথা অনুসারে জগন্নাথ নন, রথে ওঠেন রাধাবল্লভ ও বলরাম। এই রথযাত্রাকে নিয়ে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ১৮৭৫-এ রথ উপলক্ষে ছুটি নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র নৈহাটির বাড়িতে এসেছিলেন। ঠিক সেই বছরই রথের মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটি শুনে বঙ্কিম নিজেও মেলার মধ্যে মেয়েটির অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনাটির কয়েক মাস পরেই বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘রাধারানি’ উপন্যাসটি।
উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলার সংযোগস্থল কাঁচরাপাড়ার রথতলার কৃষ্ণরাই-এর রথযাত্রা বিশেষ ঐতিহ্যপূর্ণ। শোনা যায়, কৃষ্ণরাই বিগ্রহটি বহু প্রাচীন। পুরনো মন্দিরটি নদীগর্ভে বিলীন হলেও, এখানকার জমিদার বীরেশ্বর নন্দীর পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি কাঠের রথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। কোনও এক সময় সেই রথটি অপবিত্র হয়ে যাওয়ায় লোহার একটি রথ তৈরি করা হয়। আজও এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের সমাগম হয়। মন্দির সংলগ্ন মাঠে আজও বসে মেলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy