Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তিতে কি ছিঁড়ল বাঁধন, দূরত্ব রাখছেন মমতা

পদবি তাঁর মিত্রই আছে। কিন্তু দলে তাঁর সঙ্গে মিত্রতা কি কমে এসেছে অনেকের? জেল-ফেরত মন্ত্রী মদন মিত্রকে ঘিরে শাসক দলের অন্দরের সমীকরণ এবং ঘটনাপ্রবাহ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে! সারদা-কাণ্ডে সিবিআই পরিবহণমন্ত্রীকে গ্রেফতার করার পরে যে দল পথে নেমেছিল স্বয়ং দলনেত্রীর নেতৃত্বে, ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির নীচে ক্রীড়াবিদদের নিয়ে ধর্নার আয়োজন হয়েছিল, ৩২৪ দিনের জেল হাজত থেকে বেরনোর পরে সেই মদনকে নিয়েই শাসক দলে হিরণ্ময় নীরবতা!

রবিবার দুপুরে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পরে মদন মিত্র। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

রবিবার দুপুরে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পরে মদন মিত্র। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

পদবি তাঁর মিত্রই আছে। কিন্তু দলে তাঁর সঙ্গে মিত্রতা কি কমে এসেছে অনেকের?

জেল-ফেরত মন্ত্রী মদন মিত্রকে ঘিরে শাসক দলের অন্দরের সমীকরণ এবং ঘটনাপ্রবাহ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে! সারদা-কাণ্ডে সিবিআই পরিবহণমন্ত্রীকে গ্রেফতার করার পরে যে দল পথে নেমেছিল স্বয়ং দলনেত্রীর নেতৃত্বে, ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির নীচে ক্রীড়াবিদদের নিয়ে ধর্নার আয়োজন হয়েছিল, ৩২৪ দিনের জেল হাজত থেকে বেরনোর পরে সেই মদনকে নিয়েই শাসক দলে হিরণ্ময় নীরবতা! যে দলের নেত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জ দিবস উদযাপনের জন্য টুইট করেন, রাষ্ট্রপতির সহিষ্ণুতার বার্তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করেন, তাঁর টুইটার হ্যান্ড্‌ল এবং ফেসবুক পেজ মদনকে নিয়ে চুপ! রবিবার দুপুরে উত্তরবঙ্গের উড়ান ধরতে যাওয়ার পথে নেহাত সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলেন। তাই মুখ খুলতে হয়েছে। এবং সেখানেও মন্ত্রিসভা ও দলে দীর্ঘ দিনের সহকর্মীর জামিনে মুক্তিকে স্বাগত জানানো নেই! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বলেছেন, ‘‘এটা আদালতের ব্যাপার। এই নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না!’’

তা হলে কি কোথাও তাল কেটে গিয়েছে? তৃণমূলের অন্দরের খবর বলছে, গিয়েছে! সারদা-কাণ্ডে মদনকে ‘ফাঁসানো’ হয়েছে বলে এক সময় সরব ছিলেন মমতা। তাঁর গ্রেফতারির প্রতিবাদে দলকে পথে নামিয়েছিলেন। বিরোধীদের লাগাতার সমালোচনা অগ্রাহ্য করেও জেলবন্দি মদনকে মন্ত্রিত্বে রেখে দিয়েছিলেন। মদন নিজে পদত্যাগপত্র পাঠালেও সেটা রাজভবনে পাঠিয়ে দেননি। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতে থাকা স্বাস্থ্য দফতরের সৌজন্যেই বন্দি মদন জেল ছেড়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন সরকারি হাসপাতালে। জামিনের আদেশের পরে সেই সরকারি হাসপাতালই রাতারাতি মন্ত্রীকে সুস্থ ঘোষণা করে বাড়ি যাওয়ার রাস্তা খুলে দিয়েছে। অথচ মদনের অনুগামীরা কি না শহরে বারবার হোর্ডিং দিয়ে প্রচার করেছেন, ‘দাদা’ জেলে আছেন বলে উন্নয়ন আটকে আছে! আদালতে জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য হলে সেই মদনই কি না ঘনিষ্ঠ মহলে দলনেত্রীর বিরুদ্ধেও অভিমান-অনুযোগ উগরে দিয়েছেন! আক্ষেপ করেছেন, তাঁকে ছাড়ানোর জন্য তৃণমূল নেত্রী সে ভাবে ঝাঁপালেন না! এ বার সেই মদন যখন ১০ মাসের বন্দিদশা থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছেন, তখন দিদিই বা আর বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখাতে যাবেন কেন?

তৃণমূলের অন্দরের সূত্রে জানা যাচ্ছে, মদনের সঙ্গে দলনেত্রীর সম্পর্কের এই শীতলতার আরও মোক্ষম দু’টি কারণ ঘটে গিয়েছে এর মধ্যে। প্রথমত, আলিপুরের নিম্ন আদালত থেকে মন্ত্রী মদনের হঠাৎ জামিনে শাসক দলের কোনও ‘ভূমিকা’ ছিল না বলেই তৃণমূল সূত্রের দাবি। সে বিরোধীরা যতই ওই জামিনকে ‘মোদী-দিদির সখ্যের ফল’ বলে দেখাতে চান না কেন! জামিনের আদেশের বিরোধিতা করে সিবিআই কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হচ্ছে, হাইকোর্ট আগেই প্রভাবশালীর তত্ত্বে মন্ত্রীর জামিনের আর্জি খারিজ করেছিল। এখনও কোনও কারণে জামিনের আদেশ হাইকোর্টে খারিজ হয়ে গেলে মুখ পুড়বে সরকার তথা শাসক দলেরই। সেই আশঙ্কা মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মদন-মুক্তি থেকে সন্তর্পণে দূরত্ব বজায় রাখছেন।

আর দ্বিতীয়ত, তৃণমূলে অধুনা ব্রাত্য মুকুল রায়ের নতুন রাজনৈতিক ইনিংস নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, অভিমানী মদনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জন মারফত মুকুলের বার্তা বিনিময় হয়েছে বলে তৃণমূলের শীর্ষ মহলে খবর। সেই অস্বস্তিও লুকোতে পারছেন না তৃণমূল নেত্রী। তাই এ দিন মদন সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব মুখ্যমন্ত্রীকে দিতে দেখা গিয়েছে যথাসম্ভব কঠিন মুখে! যে পরিস্থিতি আন্দাজ করে শাসক দলের এই শীর্ষ নেতা বলছেন, ‘‘দিদিমণি যে পথ দিয়ে এক বার চলে এসেছেন, সে দিকে তো আর ফিরে তাকাতে চান না!’’

এর পরিণাম কী হচ্ছে? মদনের মুক্তি আসলে বিরোধীদের কুৎসা, অপপ্রচারের জবাব— এই চেনা পথে এ বার আর তৃণমূলের বিশেষ হইচই নেই। জামিনের আদেশের পরে দলের মহাসচিব শুধু স্বাগত জানিয়ে নিয়মরক্ষার বিবৃতি দিয়েছিলেন মাত্র! ‘দাদা’র ঘরে ফেরাকে উ়দযাপন করতে যাঁরা মশাল, ব্যানার নিয়ে উদ্দীপনা দেখাচ্ছেন, তাঁরাও কামারহাটি ও অন্যত্র একান্তই মদনের অনুগামী মহল। তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘মদন তো অনেক লোকের উপকার করেছে। সেই বৃত্তটা ওর সঙ্গে আছে। তারা ছাড়া বাকিদের জন্য এখনও মদনের হয়ে আসরে নামার নির্দেশ নেই!’’ ভবানীপুরের বাড়িতে ফিরে আসার পরে রাতে অবশ্য আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তবে তিনিও জানিয়েছেন, তাঁর এই সফর নেহাতই ‘ব্যক্তিগত’!

সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরাও। বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য যেমন বলছেন, ‘‘মন্ত্রীর মুক্তিতে ওঁর সহকর্মীদের উচ্ছ্বাস দূরের কথা, অনেককে যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছে!’’ তৃণমূলে ‘কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরোলেই পাজি’ নীতির উল্লেখ করেই সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম রসিকতার সুরে বলছেন, ‘‘ডাকাত দলের কেউ ধরা পড়ে জেল খেটে এলে পুরনো দলে তাকে আবার চট করে অভিযানে নেয় না! মনে করে, সে পুলিশের লোক হয়ে গিয়েছে! তৃণমূলেও ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম!’’ বিরোধীরাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সারদা-কাণ্ডে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তৎকালীন সাংসদ সৃঞ্জয় বসু তৃণমূলই ছেড়ে দিয়েছেন, কুণাল ঘোষ দলে থেকেও নেই। সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের কাছে মুকুল হাজিরা দিয়ে ফেরার পর থেকেই দলনেত্রীর সঙ্গে তাঁর হটলাইনে ইতি! মদনের বেলাতেও সেই একই উপসর্গ, বলছেন বিরোধীরা। তাৎপর্যপূর্ণ যে, এ সবের জবাব দেওয়ার জন্য তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে এ দিন কেউ এগিয়ে আসেননি!

বরং, তৃণমূলের এক নেতাই ধরিয়ে দিচ্ছেন, আগে আদালতে পেশ করার দিন থাকলেই বাইরে বেরিয়ে মন্ত্রী মদন স্লোগান দিতেন ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’। জামিনে মুক্তির পরে তাঁর মুখে এখন শুধু ‘সত্যের জয় হল’! আর সেই সঙ্গে ‘‘ম্যাচ আমরাই জিতলাম!’’ ‘আমরা’ কারা, প্রকাশ্যে অন্তত স্পষ্ট করেননি কামারহাটির বিধায়ক। দলের এক নেতা তাই বলছেন, ‘‘মদন কি আজ থেকে তৃণমূল করছে? এই অবস্থাতেও ওকে মন্ত্রী রেখেছে কে? ওরই কি উচিত ছিল না কালীঘাটে প্রথম ফুলটা দেওয়া?’’

শাসক দল সূত্রের ইঙ্গিত, এর পরেও হাইকোর্টে ‘অঘটন’ না ঘটলে দফতর ফিরে পাবেন মন্ত্রী মদন। অঘটন না ঘটলে সামনের বছর বিধানসভায় টিকিটও পাবেন। কিন্তু দল এবং নেত্রীর সঙ্গে হারানো বাঁধন কি জুড়বে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE