Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
শিক্ষকের অভাবে বহু বিষয়ে ভর্তি বন্ধ

স্কুলবেলাতেই স্বপ্নভঙ্গ অনেক পড়ুয়ার

একাদশ শ্রেণিতে উঠেছেন ওঁরা সকলেই। ভবিষ্যতের দিশা ঠিক করে নিয়ে পড়াশোনার বিষয় নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। ওঁদের কেউ চাইছেন ইতিহাস নিয়ে পড়তে। কেউ বা ভূগোল নিয়ে। কারও বা পছন্দের বিষয় সংস্কৃত। কেউ কেউ আবার জীবনবিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরেই এগোতে চান জীবনের পথে।

অর্ঘ্য ঘোষ ও সুপ্রিয় তরফদার
ময়ূরেশ্বর ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৬ ০৯:০০
Share: Save:

একাদশ শ্রেণিতে উঠেছেন ওঁরা সকলেই। ভবিষ্যতের দিশা ঠিক করে নিয়ে পড়াশোনার বিষয় নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। ওঁদের কেউ চাইছেন ইতিহাস নিয়ে পড়তে। কেউ বা ভূগোল নিয়ে। কারও বা পছন্দের বিষয় সংস্কৃত। কেউ কেউ আবার জীবনবিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরেই এগোতে চান জীবনের পথে।

কিন্তু নির্দিষ্ট পথে এগোনোর সূচনাতেই হোঁচট খেতে হচ্ছে ওঁদের। কারণ? পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগই মিলছে না। কারণ? বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব। ফলে পড়ুয়ার পছন্দের তালিকায় যে-বিষয়টি শীর্ষে আছে, সংশ্লিষ্ট স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে সেটা বাদ চলে যাচ্ছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন ঠিক সময়ে শিক্ষক নিয়োগ করতে না-পারায় নিজেদের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ হারাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। দূরবর্তী কোনও স্কুলে হয়তো সেই বিষয় পড়ানো হয়। কিন্তু দূরে গিয়ে পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা চালানোর সামর্থ্য সব পড়ুয়ার নেই।

নিছক শিক্ষকের অভাবেই যে অনেক পড়ুয়ার পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা চালানোর স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ছে, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ওই সূত্রের খবর, গোটা রাজ্যে ছ’হাজার উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আছে। কিন্তু বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষক নেই বহু স্কুলেই। নিয়ম অনুসারে দু’বছর অন্তর প্রতিটি স্কুলকে একটি ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হয় সংসদে। সংশ্লিষ্ট স্কুলে কোন কোন বিষয় পড়ানো হয়, সেই ফর্মে তার উল্লেখ করতে হয়। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিতে হয় বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যাও।

সংসদের এক কর্তা বলেন, ‘‘যদি দেখা যায় যে, কোনও স্কুলে বিষয় হিসেবে ইতিহাস রাখা হয়েছে কিন্তু শিক্ষক নেই, সে-ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্কুলে ইতিহাস পড়তে আগ্রহী ছেলে বা মেয়েদের ভর্তি করতে নিষেধ করা হয়। বাতিল করে দেওয়া হয় ওই বিষয়ে পঠনপাঠনের অনুমোদনও।’’

গোল বেধেছে এই নিয়মটি নিয়েই।
কারণ, ২০১২-র পরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কোনও শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। অবসরের প্রক্রিয়া কিন্তু থমকে নেই। অবসরজনিত শূন্যতা এবং নিয়োগ বন্ধ থাকায় শিক্ষক-ঘাটতি, এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে পছন্দের বিষয় পড়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেকের।

শিক্ষকের অভাবে বীরভূম, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৫০টিরও বেশি স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের নিয়ে পঠনপাঠন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। যেমন বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া হাইস্কুল। প্রতি বছর সেখানে ২০০ জন ছাত্রছাত্রী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ বছর ওই স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে দর্শন, সংস্কৃত ও জীববিজ্ঞান পড়ানোর অনুমোদন দেয়নি সংসদ। কারণ, ওই সব বিষয় পড়ানোর শিক্ষক বা শিক্ষিকাই নেই! প্রিয় বিষয় না-পেয়ে অনেকে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু যাঁদের দূরের স্কুলে গিয়ে পড়ার সুযোগ বা সামর্থ্য নেই, প্রিয় বিষয় পড়ার ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁদের থেকে যেতে হয়েছে ওই স্কুলেই।

ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি জয়ন্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শিক্ষক না-থাকায় তিনটি বিষয় পড়ানোর অনুমোদন পাওয়া যায়নি। এমনকী ওই সব বিষয় পড়ানোর জন্য আমরা কোনও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকও পাইনি।’’ একই ভাবে ময়ূরেশ্বরের তুড়িগ্রাম হরিপদ হাইস্কুলে শিক্ষকের অভাবে এ বছর থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সংস্কৃত পড়ানোর অনুমোদন। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শেখ আলিম জানান, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে ওই সব বিষয়ে ছাত্র ভর্তি নেওয়া যাবে না বলে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা দফতর। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও কোনও সাড়া মেলেনি। তাই বাধ্য হয়েই উচ্চ মাধ্যমিকে ওই তিনটি বিষয়ে ছাত্র ভর্তি বন্ধ রাখা হয়েছে।’’

উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের এক কর্তার বক্তব্য, তাঁদেরও নিয়ম মেনে কাজ করতে হচ্ছে। শিক্ষক না-থাকলে সেই বিষয়ে ছাত্র ভর্তি করে কী হবে? কে পড়াবেন ছাত্রদের? পরিস্থিতি বিবেচনা করেই কিছু বিষয়ে ভর্তি বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগই বা হচ্ছে না কেন? ‘‘স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি দেখার কথা স্কুলশিক্ষা দফতরের। প্রকৃত অবস্থাটা কী, আমরা শুধু সেটুকুই তাদের জানাতে পারি। তা জানানোও হচ্ছে,’’ মন্তব্য ওই সংসদ-কর্তার।

কিন্তু বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্কের মতো অপরিহার্য বিষয়ের শিক্ষক না-থাকলে কী হবে? ওই বিষয়গুলি পড়ানোর অনুমোদনও কি প্রত্যাহার করে নেবে সংসদ?

সংসদের ওই কর্তার দাবি, এই সব বিষয়ের জন্য প্রতিটি স্কুলেই যথেষ্ট শিক্ষক আছেন। অভাব নেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরও। যেখানে নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক নেই, সেখানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করার অনুমতি দিয়েই রেখেছে সংসদ।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগ নিয়েও কিন্তু সমস্যায় পড়ছে অনেক স্কুল। কী রকম সমস্যা?

হাওড়ার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অভিজ্ঞতা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করার জন্য শিক্ষা দফতর যে-সব শর্ত চাপিয়েছে, সেগুলো
মেনে অনেকেই কাজে যোগ দিতে চাইছেন না। এর জন্য সরকারের নীতিকেই দুষছেন শিক্ষক সংগঠনের অনেক নেতানেত্রী। ‘‘নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সরকারের তরফে এর থেকে লজ্জাজনক পদক্ষেপ আর হয় না। সঙ্কোচনের এই নীতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না,’’ বলছেন পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির বীরভূম জেলা সাধারণ সম্পাদক অধীরকুমার দাস।

কিন্তু স্থায়ী পদেই বা শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না কেন?

২০১৩ থেকে শিক্ষক নিয়োগের কোনও পরীক্ষাই নিতে পারছে না সরকার। স্কুল সার্ভিস কমিশনের এক কর্তা জানান, মামলা আছে। সেই সঙ্গেই ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশন (এনসিটিই) শিক্ষক নিয়োগের নিয়মে কিছু রদবদল ঘটিয়েছে। মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে রাজ্য সরকার এনসিটিই-র নিয়মের উপরে ভিত্তি করে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বললেই তা করা হবে। কিন্তু সেটা কবে হবে, তা জানাতে পারেননি ওই এসএসসি-কর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

teachers education pupil
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE