Advertisement
০৭ মে ২০২৪
ভিআইপি-ভোট

ভোটের অ-সুখ সারবে কবে?

নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই দিয়ে শুরু করা যাক। সারা দেশে এ বার বেশ কিছু প্রার্থী মনোনয়ন পেশ করেছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে এক কিংবা একাধিক ফৌজদারি মামলা (নারী নির্যাতন-সহ) ঝুলছে।

সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় (চিকিৎসক)
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৮
Share: Save:

প্রথম দফার ভোট হয়েছে চলতি মাসের ১১ তারিখ। আবার এই মাসেরই ৭ তারিখ উদ্‌যাপিত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এই বছরের স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান ছিল, ‘Universal health coverage, everyone, everywhere’। অর্থাৎ, সর্ব ক্ষেত্রে সকলের জন্য স্বাস্থ্য। এই সকলের জন্য স্বাস্থ্য স্লোগানটাই খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সুস্থ থাকা। শুধুমাত্র নিরোগ থাকা অর্থাৎ, কোনও রকম রোগব্যাধির অনুপস্থিতিই একমাত্র সুস্বাস্থ্যের মাপকাঠি হতে পারে না। এখন এই ভোটের বাজারে আমাদের জনসাধারণের স্বাস্থ্য কেমন আছে, তা একটু দেখে নেওয়া যাক। শারীরিক অসুবিধার জন্য না হয় ডাক্তারবাবুরা বা হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু এই নির্বাচনের সময়ে আমরা সকলে মানসিক এবং সামাজিক ভাবে ভাল আছি তো?

নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই দিয়ে শুরু করা যাক। সারা দেশে এ বার বেশ কিছু প্রার্থী মনোনয়ন পেশ করেছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে এক কিংবা একাধিক ফৌজদারি মামলা (নারী নির্যাতন-সহ) ঝুলছে। বেশ কিছু প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে বড়সড় আর্থিক দুর্নীতির মামলা। বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত বাহুবলীরা হয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, না হলে দলের পক্ষে সামনে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করছেন। এই সব অভিযুক্তদের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করা হয় মূলত পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করতে। এ ভাবে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে দলকে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে সাহায্য করে। এত সব সত্ত্বেও যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রতিবাদ করার সাহস দেখান, তবে তাঁদের রাষ্ট্রদ্রোহী, মাওবাদী কিংবা ‘আর্বান নকশাল’ বলে দেগে দিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে ভরার চেষ্টা চলে।

কিছু সুবিধাবাদী আমলার দল ও এক শ্রেণির আরক্ষাবাহিনীর সদস্যেরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন ক্ষমতার কাছে ভবিষ্যতের প্রশ্রয় ও প্রসাদের লোভে। আজ তাই প্রশাসনের উপরে সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ভোটের আগে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ রাজনীতিকদের একাংশ প্রায়শই নিজেদের দল ছেড়ে অন্য রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন। যে দলের মতামত তাঁর পূর্ব দলের একেবারেই বিপরীত। কখনও তাঁর এই কাজকে নতুন দলে পুরস্কৃত করা হয় মনোনয়ন দিয়ে বা দলের কোনও উঁচু পদ দিয়ে। এর পিছনে মোটা আর্থিক লেনদেন থাকার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের দেশের কত জন রাজনীতিবিদ নিজের দলের নীতি বা আদৌ কোনও রাজনৈতিক নীতিতে বিশ্বাসী, এ সব দেখে প্রশ্ন জাগে মনে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এই অবক্ষয় গণতান্ত্রিক মানুষকে উৎকণ্ঠিত করে। তবু ভোট আসে। ভারতবর্ষের আমজনতা, যারা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি কিংবা সাইনবোর্ডের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত নন, তাদের মুখহীন অবয়বগুলি ভোটের সকালে বুথের সামনে সার দিয়ে দাঁড়ায়। কারণ, ওই এক দিনই তারা অনুভব করে যে তাদের অস্ত্বিতেরও একটা গুরুত্ব রয়েছে। কালি লাঞ্ছিত আঙুলের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের সুখের আশায় বুক বাঁধে তারা। গণতন্ত্রের প্রদীপের সলতে পুড়তে থাকে।

ইদানীং মোবাইল খুললেই হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ফেসবুকে নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন মেসেজ দেখা যায়। এর অনেকগুলি কোনও নির্দিষ্ট পার্টির হয়ে প্রচার। আবার অনেকগুলি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে কুৎসা। টিভি, সংবাদপত্রে চোখ রাখলেও ভোটারদের নানা ভাবে ভয় দেখানো, বিচ্ছিন্ন রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা এবং এ সব নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের চাপান-উতোরের খবরই বেশি করে চোখে পড়ে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের রাজ্যে বেশ কিছু প্রাণহানিও ঘটেছিল নির্বাচনী হিংসার কারণে। এই নির্বিচার হিংসার বাতাবরণে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার সংগঠিত উদ্যোগে আমজনতার মন কখনও ভাল থাকতে পারে না।

ভোটের সময়ে আরও কিছু সামাজিক অসুখের দেখা মেলে। রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে বহু সামাজিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। যেমন, স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরের সংখ্যা কমে। যাঁরা এই শিবিরগুলি করেন, তাঁদের অনেকেই নির্বাচনী কাজে জড়িয়ে পড়েন।

এমনিতে গরমকালে সাধারণ ভাবে রক্তের আকাল দেখা যায়। নির্বাচন থাকলে তা আরও বাড়ে। বড় মিটিং থাকলে কোনও ঘোষণা ছাড়াই এলাকা থেকে বাস-অটোও তুলে নেওয়া হয়। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের ভোগান্তি বাড়ে।

এই সময়ে মাইকের অত্যাচারও বাড়ে। এ ছাড়া, রাস্তা আটকে নির্বাচনের মিটিংয়ের মঞ্চ এবং বসার ব্যবস্থা, হুকিং করে লাইট ও মাইকের ব্যবহার, সময়ে-অসময়ে রাস্তা আটকে মিছিল করা, এ তো প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত চলছেই। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। কারণ, তা শোনার কোনও লোক নেই। এরই মধ্যে সন্ধ্যায় টিভির টক শো-তে পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের আচার-আচরণ, সভ্য, শিক্ষিত, সমাজের শালীনতার গণ্ডী ছাড়িয়ে যায়। সম্ভাব্য জন-প্রতিনিধিদের দেখে আতঙ্ক, হতাশা আরও বাড়ে।

তবে কি সবটাই অসুখ? সবটাই হতাশা? কোনও আশাই নেই?

অবশ্যই আছে। দেশ জুড়ে বহু মানুষ সংগঠিত হচ্ছেন এই সব অপকীর্তির বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সমস্ত কুপ্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে সুস্থ চিন্তার মানুষেরা জোটবদ্ধ হচ্ছেন। কিছু সুস্থ চিন্তার মানুষ ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু সুস্থ চিন্তার মানুষ‌েরা সুস্থ সরকার গড়বেন, এ আশাও আমার মরেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Health World Health Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE